পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি H86 এতদিন আদর্শনের পরে ফিরাইয়া দিতে পারিল না। এমন-কি, তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দই হইল, কৌতুহলও কম হইল না। বিশেষত হেমনলিনী যখন কাছে নাই, তখন রমেশের দ্বারা কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করা যায় না। পত্রবাহকটিকে সঙ্গে করিয়া যোগেন্দ্র নিজেই রমেশের সন্ধানে চলিল। দেখিল, সে একটি মুদির দোকানে একটা শূন্ত কেরোসিনের বাক্স খাড়া করিয়া তাহার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে ; মুদি ব্রাহ্মণের হুকায় তাহাকে তামাক দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু চশমা-পরা বাৰুটি তামাক খায় না শুনিয়া মুদি তাহাকে শহর-জাত কোনো অদ্ভুতশ্রেণীয় পদার্থের মধ্যে গণ্য করিয়াছিল। সেই অবধি পরস্পরের মধ্যে কোনোপ্রকার আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টা হয় নাই । যোগেন্দ্ৰ সবেগে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল ; কহিল, “তোমার সঙ্গে পারা গেল না। তুমি আপনার দ্বিধা লইয়াই গেলে । কোথায় একেবারে সোজা আমার বাসায় আসিয়া হাজির হইবে, না, পথের মধ্যে মুদির দোকানে গুড়ের বাতাসা ও মুড়ির চাকতির মাঝখানে অটল হইয়া বসিয়া আছ!” রমেশ অপ্রতিভ হইয়া একটুখানি হাসিল। যোগেন্দ্র পথের মধ্যে অনর্গল বকিয়া যাইতে লাগিল ; কহিল, “যিনিই যাই বলুন, বিধাতাকে আমরা কেহই চিনিতে পারি নাই। তিনি আমাকে শহরের মধ্যে মানুষ করিয়া এতবড়ো শাহরিক করিয়া তুলিলেন, সে কি এই ঘোর পাড়াগায়ের মধ্যে আমার জীবাত্মাটাকে একেবারে মাঠে মারিবার জন্য ?” রমেশ চারি দিকে তাকাইয়া কহিল, "কেন, জায়গাটি তো মন্দ নয়।” যোগেন্দ্র । অর্থাং ? রমেশ । অর্থাৎ, নির্জন— যোগেন্দ্র । এইজন্য আমার মতো আরও একটি জনকে বাদ দিয়া এই নির্জনত আর-একটু বাড়াইবার জন্য আমি অহরহ ব্যাকুল হইয়া আছি। রমেশ । যাই বল, মনের শাস্তির পক্ষে— যোগেন্দ্র। ও-সব কথা আমাকে বলিয়ে না— কয়দিন প্রচুর মনের শান্তি লইয়া আমার প্রাণ একেবারে কণ্ঠাগত হইয়া আসিয়াছে। আমার সাধ্যমত এই শাস্তি ভাঙিবার জন্য ক্রটি করি নাই। ইতিমধ্যে সেক্রেটারির সঙ্গে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইয়াছে। জমিদার-বাবুটকেও আমার মেজাজের ষে-প্রকার পরিচয় দিয়াছি সহজে তিনি আমার উপরে আর হস্তক্ষেপ করিতে আসিবেন না। তিনি আমাকে দিয়া ইংরাজি খবরের কাগজে র্তাহার নকিবি করাইয়া লইতে ইচ্ছুক ছিলেন