পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৭২ রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্বার রুদ্ধ করিয়া মনে মনে এই কথা বলিল, ‘ষে লোক এত দুঃখ সহ করিতেছে ভগবান নিশ্চয় তাহার একটা গতি করিয়া দিবেন।’ মুকুন্দবাবু তাহার দুইটি চাকর সঙ্গে লইয়া গাড়ি করিয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন। বাড়িতে প্রবেশের দরজায় ভিতর হইতে হুড়কা বন্ধ । সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। দ্বারের কাছে রব উঠিল, “মুকুন্দবাবু ঘরে আছেন কি ?” নবীনকালী চকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ওই গো, নলিনাক্ষ ডাক্তার আসিয়াছেন। বুধিয়া, বুধিয়া!” বুধিয়া-নামধারিণীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন নবীনকালী কহিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, যাও তে, শীঘ্র দরজা খুলিয়া দাও গে। ডাক্তারবাবুকে বলে, কর্তা হাওয়৷ থাইতে বাহির হইয়াছেন, এখনি আসিবেন ; একটু অপেক্ষা করিতে হইবে।” কমলা লণ্ঠন লইয়। নীচে নামিয়া গেল— তাহার পা কঁাপিতেছে, তাহার বুকের ভিতর গুর গুরু করিতেছে, তাহার করতল ঠাণ্ড হিম হইয়া গেল। তাহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে এই বিষম ব্যাকুলতায় সে চোখে ভালো করিয়া দেখিতে না পায় । কমলা ভিতর হইতে হুড়ক খুলিয়া দিয়া ঘোমটা টানিয়া কপাটের অন্তরালে দাড়াইল । নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কর্তা ঘরে আছেন কি ?” কমলা কোনোমতে কহিল, "না, আপনি আস্থন ।” নলিনাক্ষ বসিবার ঘরে আসিয়া বসিল। ইতিমধ্যে বুধিয়া আসিয়া কহিল, “কর্তাবাবু বেড়াইতে গেছেন, এখনি আসিবেন, আপনি একটু বন্ধন।” কমলার নিশ্বাস প্রবল হইয় তাহার বুকের মধ্যে কষ্ট হইতেছিল। যেখান হইতে নলিনাক্ষকে স্পষ্ট দেখা যাইবে, অন্ধকার বারন্দার এমন একটা জায়গা সে আশ্রয় করিল, কিন্তু দাড়াইতে পারিল না। বিক্ষুব্ধ বক্ষকে শাস্ত করিবার জন্য তাহাকে সেইখানে বসিয়া পড়িতে হইল। তাহার হৃৎপিণ্ডের চাঞ্চল্যের সঙ্গে শীতের হাওয়া যোগ দিয়া তাহাকে থরথর করিয়া কাপাইয়া তুলিল। k নলিনাক্ষ কেরোসিন-আলোর পাশে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া কী অবিতেছিল। অন্ধকারের ভিতর হইতে বেপথুমতী কমলা নলিনাক্ষের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। চাহিতে চাহিতে তাহার দুই চক্ষে বাক্ষ বার জল আসিতে লাগিল।