পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি 8 eఏ এই বলিয়া আহারের আয়োজন কতদূর অগ্রসর হইয়াছে দেখিবার উপলক্ষে কিছুক্ষণের ছুটি লইয়া ক্ষেমংকরী উঠিয়া আসিলেন। তাহার ইচ্ছা, হেমনলিনীকে তিনি কমলার উপর ভিড়াইয়া দিয়া নিরীহ বৃদ্ধটিকে লইয়াই কথাবার্তা কহিবেন। তিনি দেখিলেন, প্রস্তুত অল্প মৃদু আগুনের অঁাচে বসাইয়া রাখিয়া কমলা রান্নাঘরের এক কোণে চুপটি করিয়া এমন গভীরভাবে কী একটা ভাবিতেছিল যে, ক্ষেমংকরীর হঠাৎ আবির্ভাবে সে একেবারে চমকিয়া উঠিল। পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া স্মিতমুখে উঠিয় দাড়াইল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “ওমা, আমি বলি, তুমি বুঝি রান্নার কাজে ভারি ব্যস্ত হইয়া আছ।” কমলা কহিল, “রান্না সমস্ত সারা হইয়া গেছে মা ।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, এখানে চুপ করিয়া বসিয়া আছ কেন মা ? অন্নদাবাবু বুড়োমানুষ, তার সামনে বাহির হইতে লজ। কী ? হেম আসিয়াছে, তাহাকে তোমার ঘরে ডাকিয়া লইয়া একটু গল্পসল্প করোসে। আমি বুড়োমাতুষ, আমার কাছে বসাইয়া রাখিয়া তাহাকে দুঃখ দিব কেন ?” হেমনলিনীর নিকট হইতে প্রত্যাহত হইয়া কমলার প্রতি ক্ষেমংকরীর স্নেহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। কমলা সংকুচিত হইয়া কহিল, "মা, আমি তার সঙ্গে কী গল্প করিব ! তিনি কত লেখাপড়া জানেন, আমি কিছুই জানি না।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে কী কথা! তুমি কাহারও চেয়ে কম নও মা । লেখাপড়া শিখিয়া যিনি আপনাকে যত বড়োই মনে করুন, তোমার চেয়ে বেশি আদর পাইবার যোগ্য কয়জন আছে ? বই পড়িলে সকলেই বিদ্বান হইতে পারে, কিন্তু তোমার মতো আমন লক্ষ্মীটি হওয়া কি সকলের সাধ্য ? এসো মা, এসো। কিন্তু তোমার এ বেশে চলিবে না। তোমার উপযুক্ত সাজে তোমাকে আজ সাজাইব ।” সকল দিকেই ক্ষেমংকরী আজ হেমনলিনীর গর্ব খাটো করিতে উদ্যত হইয়াছেন। রূপেও তিনি তাহাকে এই অল্পশিক্ষিতা মেয়েটির কাছে মান করিতে চান। কমলা আপত্তি করিবার অবকাশ পাইল না। তাহাকে ক্ষেমংকরী নিপুণহন্তে মনের মতো করিয়া সাজাইয়া দিলেন, ফিরোজা রঙের রেশমি শাড়ি পরাইলেন, নূতন ফ্যাশানের খোপা রচনা করিলেন, বার বার কমলার মুখ এ দিকে ফিরাইয়া ও দিকে ফিরাইয়া দেখিলেন এবং মুগ্ধচিত্তে তাহার কপোল চুম্বন করিয়া কহিলেন, “আহ, এ রূপ রাজার ঘরে মানাইত।”