পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 8>S গৌরী রাগিণীতে গেল গেল দিন গাহিত ও গায়ের দুই-চারি জন লোক আশেপাশে জমা হইত, তাহার কথা আজ আর কাহারও মনে নাই। গঙ্গাতীরের ভগ্ন দেবালয়গুলিরও যেন বিশেষ কী মাহাত্ম্য আছে । তাহার মধ্যে আর দেবপ্রতিমা নাই । কিন্তু সে নিজেই জটাজুটবিলম্বিত অতি পুরাতন ঋষির মতো অতিশয় ভক্তিভাজন ও পবিত্র হইয়া উঠিয়াছে। এক-এক জায়গায় লোকালয়—সেখানে জেলেদের নৌকা সারি সারি বাধা রহিয়াছে। কতকগুলি জলে, কতকগুলি ভাঙায় তোলা, কতকগুলি তীরে উপুড় করিয়া মেরামত করা হইতেছে ; তাহদের পাজরা দেখা যাইতেছে। কুঁড়ে ঘরগুলি কিছু ঘন ঘন কাছাকাছি— কোনো-কোনোটা বাকীচোরা বেড়া দেওয়া— দুইচারিটি গোরু চরিতেছে, গ্রামের দুই-একটা শীর্ণ কুকুর নিষ্কৰ্মার মতো গঙ্গার ধারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ; একটা উলঙ্গ ছেলে মুখের মধ্যে আঙুল পুরিয়া বেগুনের খেতের সম্মুখে দাড়াইয়া অবাক হইয়া আমাদের জাহাজের দিকে চাহিয়া আছে। হাড়ি ভাসাইয়া লাঠি-বাধা ছোটো ছোটো জাল লইয়া জেলের ছেলেরা ধারে ধারে চিংড়িমাছ ধরিয়া বেড়াইতেছে। সমুখে তীরে বটগাছের জালবদ্ধ শিকড়ের নীচে হইতে নদীস্রোতে মাটি ক্ষয় করিয়া লইয়া গিয়াছে, ও সেই শিকড়গুলির মধ্যে একটি নিভৃত আশ্রয় নির্মিত হইয়াছে। একটি বুড়ি তাহার দুই-চারিটি হাড়িকুড়ি ও একটি চট লইয়া তাহারই মধ্যে বাস করে। আবার আর-এক দিকে চড়ার উপরে বহুদূর ধরিয়া কাশবন ; শরৎকালে যখন ফুল ফুটিয়া উঠে তখন বায়ুর প্রত্যেক হিল্লোলে হাসির সমুদ্রে তরঙ্গ উঠিতে থাকে। যে কারণেই হউক, গঙ্গার ধারের ইটের পাজাগুলিও আমার দেখিতে বেশ ভালো লাগে ; তাদের আশেপাশে গাছপালা থাকে না, চারি দিকে পোড়ো জায়গা এবড়ো-খেবড়ো, ইতস্তত কতকগুলা ইট খসিয়া পড়িয়াছে, অনেকগুলি ঝাম ছড়ানো, স্থানে স্থানে মাটি কাটা— এই অন্তর্বরতা-বন্ধুরতার মধ্যে পাজাগুলো কেমন হতভাগ্যের মতো দাড়াইয়া থাকে। গাছের শ্রেণীর মধ্য হইতে শিবের দ্বাদশ মন্দির দেখা যাইতেছে ; সমুখে ঘাট, নহবতখানা হইতে নহবত বাজিতেছে। তাহার ঠিক পাশেই খেয়াঘাট। কাচা ঘাট, ধাপে ধাপে তালগাছের গুড়ি দিয়া বাধানে। জার, দক্ষিণে কুমারদের বাড়ি, চাল হইতে কুমড়া ঝুলিতেছে। একটি প্রৌঢ় কুটিরের দেওয়ালে গোবর দিতেছে ; প্রাঙ্গণ পরিষ্কার, তক্তক্‌ করিতেছে ; কেবল এক প্রান্ডে মাচার উপরে লাউ লতাইয়া উঠিয়াছে, আর-এক দিকে তুলসীতল। স্বর্যাস্তের নিস্তরঙ্গ গঙ্গায় নৌকা ভাসাইয়া দিয়া গঙ্গার পশ্চিম-পারের শোভা ৰে দেখে নাই সে বাংলার সৌন্দর্য দেখে নাই বলিলেও হয়। এই পবিত্র শান্তিপূর্ণ অনুপম সৌন্দৰছবির বর্ণনা সম্ভবে না। এই স্বর্ণচ্ছায়া মান সন্ধ্যালোকে দীর্ঘ