পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বোঝেন না তা নয়, বরঞ্চ তাদের বুদ্ধি বেশি বলেই তারা বুঝতে চান না, কেবল বোঝাতেই চান । তারা যখন ধর্মের দিক থেকে অর্থাং সকলের চেয়ে বড়ো সত্যের দিক থেকে এ সব কথা অস্তরের সঙ্গে বুঝতে চাইবেন তখন তোমার বাবার বুদ্ধির জন্তে তাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে না । এখন তারা অন্য দিক থেকে দেখছেন, এখন আমার কথা তাদের কোনো কাজেই লাগবে না ।” গোরাদের কথা যদিও স্বচরিতা শ্রদ্ধার সহিত শুনিতেছিল, তবু তাহা তাহার সংস্কারের সহিত বিবাদ বাধাইয় তাহার অন্তরের মধ্যে বেদনা দিতেছিল । সে শাস্তি পাইতেছিল না। আজ পরেশবাণুর সঙ্গে কথা কহিয়৷ সেই বিরোধ হইতে সে ক্ষণকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল । গোরা বিনয় বা আর-কেহই যে পরেশবাবুর চেয়ে কোনো বিষয়ে ভালে বুঝে, এ কথা মুচরিতা কোনোমতেই মনে স্থান দিতে চায় না । পরেশবাবুর সঙ্গে যাহার মতের অনৈক্য হইয়াছে স্বচরিত। তাহার উপর রাগ না করিয়া থাকিতে পারে নাই । সম্প্রতি গোরার সঙ্গে আলাপের পর গোরার কথা একেবারে রাগ-বা অবজ্ঞা করিয়। উড়াইয়া দিতে পারিতেছিল না বলিয়াই স্বচরিত। এমন একটা কষ্ট বোধ করিতেছিল । সেই কারণেই আবার শিশুকালের মতো করিয়া পরেশবাবুকে র্তাহার ছায়াটির ন্যায় নিয়ত আশ্রয় করিবার জন্ত তাহার হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলত উপস্থিত হইয়াছিল । চৌকি হইতে উঠিয়া দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়| আবার ফিরিয়া আসিয়া স্বচরিতা পরেশবাবুর পিছনে তাহার চৌকির পিঠের উপর হাত রাখিয়া কহিল, “বাবা, আজ বিকালে আমাকে নিয়ে উপাসনা কোরো ।” পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা ।” তাহার পরে নিজের শোবার ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়ু বসিয়া স্বচরিতা গোরার কথাকে একেবারে অগ্রাহ করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু গোরার সেই বুদ্ধি ও বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুখ তাহার চোখের সম্মুখে জাগিয়া রছিল । তাহার মনে হইতে লাগিল, গোরার কথা শুধু কথা নহে, সে যেন গোরা স্বয়ং ; সে কথার আকৃতি আছে, গতি আছে, প্রাণ আছে—তাহা বিশ্বাসের বলে এবং স্বদেশপ্রেমের বেদনার পরিপূর্ণ। তাহা মত নয় যে তাহাকে প্রতিবাদ করিয়াই চুকাইয়া দেওয়া যাইবে— তাছা যে সম্পূর্ণ মানুষ— এবং সে মানুষ সামান্ত মানুষ নহে। তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিতে যে হাত ওঠে না। অত্যন্ত একটা দ্বন্ধের মধ্যে পড়িয়া স্বচরিতার কান্না আসিতে লাগিল। কেছ যে তাহাকে এত বড়ো একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলিয়া দিয়া সম্পূর্ণ উবাগীনের মতো অনায়ালে দূরে চলিয়া যাইতে পারে এই কথা মনে করিয়া তাহার বুক ফাটা বাইতে চাহিল, অথচ কষ্ট পাইতেছে বলিয়াও ধিক্কারের সীমা রছিল না।