পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԾԳՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দময়ী কহিলেন, "খাওয়াছোওয়া নিয়ে আমি কিছু বাছ-বিচার করি নে। কিন্তু আজকে থাক— গোরা ফিরে আস্থক, তার পরে খাব।” আনন্দময়ী গোরার অসাক্ষাতে গোরার অপ্রিয় কোনো আচরণ করিতে পারিলেন না । বরদাসুন্দরী বিনয়ের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “এই-ষে বিনয়বাবু এখানে ! আমি বলি আপনি আসেন নি বুঝি।” বিনয় তৎক্ষণাং বলিল, “আমি ষে এসেছি সে বুঝি আপনাকে না জানিয়ে যাব ভেবেছেন ?” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “কাল তো নিমন্ত্রণের খাওয়া ফাকি দিয়েছেন, আজ নাহয় বিনা নিমন্ত্রণের খাওয়া খাবেন ।” বিনয় কহিল, “সেইটেতেই আমার লোভ বেশি । মাইনের চেয়ে উপরি-পাওনার টান বড়ো ।” হরিমোহিনী মনে মনে বিস্মিত হইলেন । বিনয় এ বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে— আনন্দময়ীও বাছ-বিচার করেন না । ইহাতে র্তাহার মন প্রসন্ন হইল না । বরদাসুন্দরী চলিয়া গেলে হরিমোহিনী সসংকোচে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, তোমার স্বামী কি—” আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী খুব হিন্দু।” হরিমোহিনী অবাক হইয়া রহিলেন । আনন্দময়ী তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “বোন, যতদিন সমাজ আমার সকলের চেয়ে বড়ো ছিল ততদিন সমাজকেই মেনে চলতুম, কিন্তু এক দিন ভগবান আমার ঘরে হঠাৎ এমন করে দেখা দিলেন যে আমাকে আর সমাজ মানতে দিলেন না । তিনি নিজে এসে আমার জাত কেড়ে নিয়েছেন, তখন আমি আর কাকে ভয় করি ।” হরিমোহিনী এ কৈফিয়তের অর্থ বুঝিতে না পারিয়া কহিলেন, “তোমার স্বামী—” আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার স্বামী রাগ করেন ।” হরিমোহিনী । ছেলেরা ? আনন্দময়ী। ছেলেরাও খুশি নয়। কিন্তু তাদের খুশি করেই কি বঁচিব ? বোন, আমার এ কথা কাউকে বোঝাবার নয়— যিনি সব জানেন তিনিই বুঝবেন। বলিয়া আনন্দময়ী হাত জোড় করিয়া প্রণাম করিলেন । হরিমোহিনী ভাবিলেন হয়তো কোনো মিশনারির মেয়ে আসিয়া আনন্দময়ীকে খৃস্টানি ভজাইয়া গেছে। র্তাহার মনের মধ্যে অত্যস্ত একটা সংকোচ উপস্থিত হইল ।