পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२० রবীন্দ্র-রচনাবলী কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “কোনো পণ্ডিতের মত নিতে হবে না। আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি, তোমার প্রায়শ্চিভের প্রয়োজন নেই।” 敬 কৃষ্ণদয়ালের মতো আমন আচারগুচিবায়ুগ্ৰস্ত লোক গোরার পক্ষে কোনোপ্রকার নিয়মসংযম যে কেন স্বীকার করতে চান না— শুধু স্বীকার করেন না তা নয়, একেবারে তাহার বিরুদ্ধে জেদ ধরিয়া বসেন, আজ পর্যন্ত গোরা তাহার কোনো অর্থই বুঝিতে পারে নাই। আনন্দময়ী আজ ভোজনস্থলে গোরার পাশেই বিনয়ের পাত করিয়াছিলেন । গোরা কহিল, “মা, বিনয়ের আসনট একটু তফাত করে দাও।” আনন্দময়ী আশ্চর্য হুইয়া কহিলেন, “কেন, বিনয়ের অপরাধ কী হ’ল ?” গোরা কহিল, “বিনয়ের কিছু হয় নি, আমারই হয়েছে । আমি অশুদ্ধ আছি ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হোক, বিনয় অত শুদ্ধাশুদ্ধ মানে না ।” গোরা কহিল, “বিনয় মানে না, আমি মানি ।” আহারের পর দুই বন্ধু যখন তাহাদের উপরের তলের নিভৃত ঘরে গিয়া বসিল তখন তাহার কেহ কোনো কথা খুজিয়া পাইল না । এই এক মাসের মধ্যে বিনয়ের কাছে যে একটিমাত্র কথা সকলের চেয়ে বড়ো হইয়| উঠিয়াছে সেটা আজ কেমন করিয়া ষে গোরার কাছে পাড়িবে তাহা সে ভাবিয়াই পাইতেছিল না। পরেশবাবুর বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে গোরার মনেও একটা জিজ্ঞাসা জাগিতেছিল, কিন্তু সে কিছুই বলিল না । বিনয় কথাটা পাড়িবে বলিয়। সে অপেক্ষা করিতেছিল । অবশ্ব বাড়ির মেয়ের সকলে কেমন আছেন সে কথা গোরা পরেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কিন্তু সে তো কেবল ভদ্রতার প্রশ্ন । তাহারা সকলে ভালো আছে এইটুকু খবরের চেয়েও আরও বিস্তারিত বিবরণ জানিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে ঔংস্থক্য ছিল । এমন সময় মহিম ঘরের মধ্যে আসিয়া আসন গ্রহণ করিয়া সিড়ি উঠার প্রমে কিছুক্ষণ স্থাপাইয়া লইলেন । তাহার পরে কহিলেন, “বিনয়, এতদিন তো গোরার জন্যে অপেক্ষা করা গেল । এখন আর তো কোনো কথা নেই। এবার দিন ক্ষণ ঠিক করে ফেলা যাক। কী বল গোরা ? বুঝেছ তো কী কথাটা হচ্ছে ?” গোরা কোনো কথা না বলিয়া একটুখানি হাসিল । মহিম কছিলেন, “হাসছ যে ! তুমি ভাবছ আজও দাদা লে কথাটা ভোলে নি । কিন্তু কন্যাটি তো স্বপ্ন নয়, স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি সে একটি সত্য পদার্থ— ভোলবার জো কী ! হাসি নয় গোরা, এবারে যা হয় ঠিক করে ফেলো ।” গোরা কহিল, “ঠিক করবার কর্তা যিনি তিনি তো স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন।”