পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 88& জন্ত আবেদন করার মতো মনের অবস্থা তো তাহার নহে,– বিশেষত ললিতাকে লইয়া যে ব্রাহ্মসমাজে তাহার সম্বন্ধে এত আলোচনা হইয়া গেছে । কোন লজ্জায় কী ভাষায় সে চিঠি লিখিবে ? সে চিঠি যখন ব্রাহ্ম-পত্রিকায় প্রকাশিত হইবে তখন সে কেমন করিয়া মাথা তুলিবে ? সে চিঠি গোরা পড়িবে, আনন্দময়ী পড়িবেন । সে চিঠির সঙ্গে আর তো কোনো ইতিহাস থাকিবে না— তাহাতে কেবল এই কথাটুকুই প্রকাশ পাইবে যে, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করিবার জন্য বিনয়ের চিত্ত অকস্মাং পিপাসু হইয়া উঠিয়াছে । কথাটা তো এতখানি সত্য নহে— তাহাকে আরও-কিছুর সঙ্গে জড়িত করিয়া না দেখিলে তাহার তো লজ্জারক্ষার আবরণটুকু থাকে না । বিনয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয় বরদাসুন্দর ভয় পাইলেন। তিনি কছিলেন, “উনি ব্রাহ্মসমাজের তো কাউকে চেনেন না, আমরাই সব বন্দোবস্ত করে দেব । আমি আজ এখনই পামুবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আর তো সময় নেই— পরশু যে রবিবার।" এমন সময় দেখা গেল সুধীর ঘরের সামনে দিয়া উপরের তলায় যাইতেছে । বরদাসুন্দরী তাহাকে ভাকিয়া কহিলেন, “মুধীর, বিনয় পরশু আমাদের সমাজে দীক্ষা নেবেন ।” স্বধীর অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল । স্বধীর মনে মনে বিনয়ের এক জন বিশেষ ভক্ত ছিল ; বিনয়কে ব্রাহ্মসমাজে পাওয়া যাইবে শুনিয়া তাহার ভারি উৎসাহ হইল । বিনয় যে-রকম চমৎকার ইংরেজি লিখিতে পারে, তাহার যে-রকম বিদ্যাবুদ্ধি, তাহাতে ব্রাহ্মসমাজে যোগ না দেওয়াই তাহার পক্ষে, অত্যস্ত অসংগত বলিয়া স্বধীরের বোধ হইত। বিনয়ের মতো লোক যে কোনোমতেই ব্রাহ্মসমাজের বাহিরে থাকিতে পারে না ইহারই প্রমাণ পাইয়া তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল । সে কহিল, "কিন্তু পরশু রবিবারের মধ্যেই কি হয়ে উঠবে ? অনেকেই খবর জানতে পারবে না ।” স্বধীরের ইচ্ছা, বিনয়ের এই দীক্ষাকে একটা দৃষ্টাস্তের মতো সর্বসাধারণের সম্মুখে ঘোষণা করা হয় । বরদাসুন্দরী কছিলেন, “না না, এই রবিবারেই হয়ে যাবে। স্বধীর, তুমি দৌড়ে যাও, পাল্লুবাবুকে শীঘ্র ডেকে আনে ৷” 翻 যে হতভাগ্যের দৃষ্টাস্তের দ্বারা স্বধীর ব্রাহ্মসমাজকে অজেয়শক্তিশালী বলিয়া সর্বত্র প্রচার করিবার কল্পনায় উত্তেজিত হইয়া উঠতেছিল, তাহার চিত্ত তখন সংকুচিত হইয়া একেবারে বিন্দুবং হইয়া আসিয়াছিল । যে জিনিসটা মনে মনে কেবল তর্কে যুক্তিতে বিশেষ কিছুই নহে, তাহারই বাহ চেহারাটা দেখিয়া বিনয় ব্যাকুল হইয়া পড়িল ।