পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ©©Ꮼ কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, "কেন কী ! আমি তোমাকে আর-এক দিন বলেছি, প্রায়শ্চিত্ত হতে পারবে না ।” গোরা কহিল, "বলে তো ছিলেন, কিন্তু কারণ তো কিছু দেখান নি।” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, "কারণ দেখাবার আমি কোনো দরকার দেখি নে । আমরা তো তোমার গুরুজন, মান্তব্যক্তি ; এ-সমস্ত শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম আমাদের অমুমতি ব্যতীত করবার বিধিই নেই। ওতে যে পিতৃপুরুষদের শ্রাদ্ধ করতে হয় তা জান ?” গোর বিস্মিত হইয়া কহিল, "তাতে বাধা কী ?” কৃষ্ণদয়াল ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া কছিলেন, “সম্পূর্ণ বাধা আছে। সে আমি হতে দিতে পারব না ।” গোর হৃদয়ে আঘাত পাষ্টয়া কহিল, “দেখুন, এ আমার নিজের কাজ ! আমি নিজের শুচিতার জন্যই এই আয়োজন করছি— এ নিয়ে বৃথা আলোচনা করে আপনি কেন কষ্ট পাচ্ছেন ?” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “দেখো গোরা, তুমি সকল কথায় কেবল তর্ক করতে যেয়ে না । এ-সমস্ত তর্কের বিষয়ই নয় । এমন ঢের জিনিস আছে যা এখনো তোমার বোঝবার সাধ্যই নেই । আমি তোমাকে ফের বলে যাচ্ছি— হিন্দুধর্মে তুমি প্রবেশ করতে পেরেছ এষ্টটে তুমি মনে করছ, কিন্তু সে তোমার সম্পূর্ণই ভুল। সে তোমার সাধ্যই নেট— তোমার প্রত্যেক রক্তের কণা, তোমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার প্রতিকূল । হিন্দু হঠাৎ হবার জো নেই, ইচ্ছা করলেও জো নেই । জন্মজন্মাস্তরের স্বকৃতি চাই ।” গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল । সে কহিল, “জন্মাস্তরের কথা জানি নে, কিন্তু আপনাদের বংশের রক্তধারায় যে অধিকার প্রবাহিত হয়ে আসছে আমি কি তারও দাবি করতে পারব না ?” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “আবার তর্ক ? আমার মুখের উপর প্রতিবাদ করতে তোমার সংকোচ হয় না ? এ দিকে বল হিন্দু! বিলাতি কাজ যাবে কোথায় ! আমি যা বলি তাই শোনো । ওসমস্ত বন্ধ করে দাও।” গোরা নতশিরে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল। একটু পরে কহিল, “যদি প্রায়শ্চিত্ত না করি তা হলে কিন্তু শশিমুখীর বিবাহে আমি সকলের সঙ্গে বসে খেতে পারব না ।” ի কৃষ্ণদয়াল উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বেশ তো । তাতেই বা দোষ কী ? তোমার জন্যে নাহয় আলাদা আসন করে দেবে s"