পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

wbr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের বাড়ির বন্ধু শ্ৰীকণ্ঠবাবু দিনরাত গানের মধ্যে তলিয়ে থাকতেন। বারান্দায় বসে বসে চামেলির তেল মেখে স্নান করতেন ; হাতে থাকত গুড়গুড়ি, অম্বুরি তামাকের গন্ধ উঠত আকাশে ; গুন গুন গান চলত, ছেলেদের টেনে রাখতেন চার দিকে। তিনি তো গান শেখাতেন না, গান তিনি দিতেন, কখন তুলে নিতুম জানতে পারতুম না। ফুর্তি যখন রাখতে পারতেন না, দাঁড়িয়ে উঠতেন ; নেচে নেচে বাজাতে থাকতেন সেতার, হাসিতে বড়ো বড়ো চােখ জ্বল জ্বল করত, গান ধরতেন “মায় ছোড়ো ব্ৰজকী বাসরী।” সঙ্গে সঙ্গে আমিও না গাইলে ছাড়তেন না।. তার পরে যখন আমার কিছু বয়স হয়েছে তখন বাড়িতে খুব বড়ো ওস্তাদ এসে বসলেন যদুভট্ট। একটা মস্ত ভুল করলেন, জেদ ধরলেন আমাকে গান শেখাবেনই- সেইজন্যে গান শেখাই হল না। কিছু-কিছু সংগ্রহ করেছিলুম। লুকিয়ে-চুরিয়ে। ভালো লাগল কাফি সুরে রুম ঝুম বরখে আজু বান্দরওয়া’; রয়ে গেল। আজ পর্যন্ত আমার বর্ষার গানের সঙ্গে দল বেঁধে । গান সম্বন্ধে আমি শ্ৰীকণ্ঠবাবুর প্রিয়শিষ্য ছিলাম। তাহার একটা গান ছিল— ‘ম্যয় ছোড়ো ব্ৰজকী বাসরী।” ঐ গানটি আমার মুখে সকলকে শোনাইবার জন্য তিনি আমাকে ঘরে ঘরে টানিয়া লইয়া বেড়াইতেন। আমি গান ধরিতাম, তিনি সেতারে ঝঙ্কার দিতেন এবং যেখানটিতে গানের প্রধান ঝোক ‘ম্যয় ছেড়েী', সেইখানটাতে মাতিয়া উঠিয়া তিনি নিজে যোগ দিতেন ও অশ্রান্তভাবে সেটা ফিরিয়া ফিরিয়া আবৃত্তি করিতেন এবং মাথা নাড়িয়া মুগ্ধদৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাহিয়া যেন সকলকে ঠেলা দিয়া ভালো লাগায় উৎসাহিত করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতেন। ইনি আমার পিতার ভক্তবন্ধু ছিলেন। ইহারই দেওয়া হিন্দিগান হইতে ভাঙা একটি ব্ৰহ্মাসংগীত আছে- ‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে, ভুল না রে তঁায়।’ এই গানটি তিনি পিতৃদেবকে শোনাইতে শোনাইতে আবেগে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেন। সেতারে ঘন ঘন ঝঙ্কার দিয়া একবার বলিতেন ‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে, আবার পালটাইয়া লইয়া তাহার মুখের সম্মুখে হাত নড়িয়া বলিতেন ‘অন্তরতর অন্তরতম তুমি যে’। 8 সাহিত্যের শিক্ষায়, ভাবের চর্চায়, বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন। তিনি নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে র্তাহার আনন্দ ।... . এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাহার অঙ্গুলিনুত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। আমি এবং অক্ষয়বাবু তাহার সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম। গান বঁধিবার শিক্ষানবিসি এইরূপে আমার আরম্ভ হইয়াছিল। । আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে গানচর্চার মধ্যেই আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমার পক্ষে তাহার একটা সুবিধা এই হইয়াছিল- অতি সহজেই গান আমার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার অসুবিধাও ছিল। চেষ্টা করিয়া গান আয়ত্ত করিবার উপযুক্ত অভ্যাস না হওয়াতে শিক্ষা পাকা হয় নাই। সংগীতবিদ্যা বলিতে যাহা বোঝায় তাহার মধ্যে কোনো অধিকার লাভ করিতে পারি নাই।