পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8VV রবীন্দ্র-রচনাবলী Truth মিথ্যা Falsehood। আমি সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহারকালে ইংরেজির অনুবাদ করি নাই...“সত্য” “মিথ্যা” প্রাচীনকাল হইতে যে অর্থে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, আমি সেই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। সে দেশী অর্থে, সত্য Truth, আর তাহা ছাড়া আরও কিছু। প্রতিজ্ঞা রক্ষা, আপনার কথা রক্ষা, ইহাও সত্য।’ বঙ্কিমবাবু যে অর্থে মনে করিয়া সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা এখন বুঝিলাম। কিন্তু প্রচারের প্রথম সংখ্যার হিন্দুধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধে যে কথাগুলি ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে এই অর্থ বুঝিবার কোনো সম্ভাবনা নাই, আমার সামান্য বুদ্ধিতে এইরূপ মনে হয়। তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহা উদধূত করি। যদি মিথ্যা কহেন, তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।” প্রথমে দেখিতে হইবে সংস্কৃতে সত্য মিথ্যার অর্থ কী। একটা প্রয়োগ না দেখিলে ইহা স্পষ্ট হইবে না। মনুতে আছে— সত্যং ব্রুয়াৎ, প্ৰিয়ং ব্রুয়াৎ ন ব্রুয়াৎ সত্যামপ্ৰিয়ম। প্রিয়ঞ্চ নানুতং ব্রুয়াৎ, এষ ধৰ্মঃ সনাতনঃ। অর্থাৎ- সত্য বলিবে, প্রিয় বলিবে, কিন্তু অপ্ৰিয় সত্য বলিবে না, প্রিয় মিথ্যাও বলিবে না, ইহাই সনাতন ধর্ম- এখানে সত্য বলিতে কেবলমাত্র সত্য কথাই বুঝাইতেছে, তৎসঙ্গে প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝাইতেছে না। যদি প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝাইত। তবে প্রিয় ও অপ্ৰিয় শব্দের সার্থকতা থাকিত না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, এখানে মনু সত্য শব্দে Truth ছাড়া আরও কিছু'-কে ধরেন নাই, এই অসম্পূর্ণতাবশত সংহিতাকার মনুকে যদি কেহ অনুবাদপরায়ণ বা খৃস্টান বলিয়া গণ্য করেন, আবশ্যক? সত্য শব্দের মূল ধাতু ধরিয়াই দেখি আর ব্যবহার ধরিয়াই দেখি- দেখা যায়, সত্য অর্থে সাধারণত Truth বুঝায় ও কেবল স্থলবিশেষে প্ৰতিজ্ঞা বুঝায়। অতএব যেখানে সত্যের সংকীর্ণ ও বিশেষ অর্থের আবশ্যক। সেখানে বিশেষ ব্যাখ্যারও আবশ্যক। দ্বিতীয়ত— ‘সত্য’ বলিতে প্ৰতিজ্ঞা ‘রক্ষা” বুঝায় না। সত্য পালন বা সত্য রক্ষা বলিতে প্ৰতিজ্ঞারক্ষা বুঝায়- কেবলমাত্র সত্য শব্দ বুঝায় না। তৃতীয়ত— বঙ্কিমবাবু সত্য' শব্দের উল্লেখ করেন নাই, তিনি মিথ্যা’ শব্দই ব্যবহার করিয়াছেন। সত্য শব্দে সংস্কৃতে স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায় বটে- কিন্তু মিথ্যা শব্দে তদবিপরীত অর্থ সংস্কৃত ভাষায় বোধ করি প্রচলিত নাই— আমার এইরূপ বিশ্বাস। ভ্ৰম হইবার আর-একটি গুরুতর কারণ আছে। বঙ্কিমবাবু লিখিয়াছেন। ‘যদি মিথ্যা কথা কহেন’- সত্য রক্ষা না করাকে “মিথ্যা কথা কওয়া’ কোনো পাঠকের মনে হইতে পারে না। তিনি হিন্দুই হউন, খৃস্টিয়ানই হউন স্বাধীনচিন্তাশীলই হউন আর অনুবাদপরায়ণই হউন মিথ্যা কথা কহা” শুনিলেই তাহার প্রত্যহপ্রচলিত সহজ অর্থই মনে হইবে। অৰ্জ্জুন যখন প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, যে-কেহ তাহার গাণ্ডীবের নিন্দা করিবে তাহাকে তিনি বধ করিবেন, তখন তিনি মিথ্যা কথা কহেন নাই। কারণ, অৰ্জ্জুন। এখানে কোনো সত্য গোপন করিতেছেন না, তঁহার হৃদয়ের যাহা বিশ্বাস বাক্যে তাহার অন্যথাচরণ করিতেছেন না, তৎকালে সত্য সত্যই যাহা সংকল্প করিয়াছেন তাহাঁই ভাষায় প্রকাশ করিয়াছেন, কোনো প্রকার সত্যের ভানও করেন নাই! আমি যদি বলি যে “আমি কাল তোমার বাড়ি যাইব’ ও ইতিমধ্যে আজই মরিয়া যাই। তবে আমাকে কোন নৈয়ায়িক মিথ্যাবাদী বলিবে? এখানে হৃদয়ের বিশ্বাস ধরিয়া সত্য মিথ্যা বিচার করিতে হয়— আমি যখন বলিয়াছিলাম তখন আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে তোমার বাড়ি যাইতে পারিব। মানুষ যখন অতীত বা বর্তমান সম্বন্ধে কোনাে কথা বলে তখন তাহার জ্ঞান লইয়া সত্য মিথ্যা বিচার করিতে হয়, সে যদি বলে কাল তোমার বাড়ি গিয়াছিলাম। অথচ না