পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮ রোকেয়া রচনাবলী

বুঝে, জল দুপ্রাপ্য। কিন্তু আঙ্গর বুঝে না-সে দুগ্ধপোষ্য শিশু, নিতান্ত অজ্ঞান। অনাহারে জলাভাবে মাতার স্তন্য শুকাইয়া গিয়াছে— শিশু পিপাসায় কাতর।

 শহরবানু (হোসেনের স্ত্রী) অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহিয়াছেন, আজ আসগরের যাতনা তাহার অসহ্য! তিনি অনেক বিনয় করিয়া হোসেনের কোলে শিশুকে দিয়া জল প্রার্থনা করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, “আর কেহ জল চাহে না; কেবল এই শিশুকে একটু জল পান করাইয়া আন। শত্রু যেন ইহাকে নিজ হাতে জল পান করায়,জলপাত্রটা যেন তোমার হাতে নাই দেয়!!”

 মহাত্মা হোসেন স্ত্রীর কাতরতা এবং শিশুর দুরবস্থা দেখিয়া জল প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন | কাতরস্বরে বলিলেন, “আমি বিদেশী পথিক, তোমাদের অতিথি, আমার প্রতি যত ইচ্ছা অত্যাচার কর, সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এ শিশু তোমাদের নিকট কোন দোষে দোষী নহে। পিপাসায় ইহার প্রাণ ওষ্ঠাগত একবিন্দু জল দাও! ইহাতে তোমাদের দয়াধর্ম্মের কিছুমাত্র অপব্যয় হইবে না!” শত্রুগণ কহিল, “বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে, শীঘ্র কিছু দিয়া বিদায় কর।”

 বিপক্ষ হইতে শিশুর প্রতি জলের পরিবর্তে তীর বৃষ্টি হইল!!

“পিয়াস লাগিয়া জলদে সাধিনু
বজর পড়িয়া গেল।”

 উপযুক্ত অতিথি-অভ্যর্থনা বটে! হোসেন শরবিদ্ধ আঙ্গরকে তাহার জননীর কোলে দিয়া বলিলেন, “আসগর চিরদিনের জন্য তপ্ত হইয়াছে! আর জ্বল জ্বল বলিয়া দিয়া কাঁদাইবে না! আর বলিবে না ‘পিপাসা, পিপাসা’! এই শেষ!”

 শহরবান কি দেখিতেছেন? কোলে পিপাসু শরবিদ্ধ আসগর, সম্মুখে রুধিরাক্ত কলেবর “শহীদ” (সমরশায়ী) আকবর! অমন চাঁদ কোলে লইয়া ধরণী গরবিণী হইয়াছিল— যে আকবর ক্ষতবিক্ষত হইয়া, পিপাসায় কাতর হইয়া মৃত্যুকালে এক বিন্দু জল পায় নাই। শোণিতধারায় যেন লেখা আছে “পিপাসা, পিপাসা”! শহীদের মুদ্রিত নয়ন দুটি নীরবেই বলে যেন “পিপাসা, পিপাসা!! দৃশ্য ত এইরূপ মর্ম্মভেদী তাহাতে আবার দর্শক জননী:আহা!!

যে ফুল ফুটিত প্রাতে,—নিশীথেই ছিন্ন হল,
শিশিরের পরিবর্তে রুধিরে আপুত হ'ল!

 আরও দেখিলাম,—মহাত্মা হোসেন সমরশায়ী। সমরক্ষেত্রে কেবলই পিপাসী শহীদগণ পড়িয়া আছেন। তাহাদের শুষ্ক কণ্ঠ যেন অস্ফুট ভাষায় বলিতেছে “পিপাসা, পিপাসা”। জয়নব (হোসেনের ভগিনী) মুক্ত কেশে পাগলিনী প্রায় ভ্রাতার নিকট বিদায় চাহিতেছেন। ডাকিয়া, উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতেছেন,— “ভাই! তোমাকে মরুভূমে ফেলিয়া যাইতেছি! আসিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে,—যাইতেছি তোমাকে ছাড়িয়া! আসিয়াছিলাম অনেক রত্নে