পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪ রোকেয়া রচনাবলী

যে গলাবন্ধ (dogcollar} দেখি, উহারই অনুকরণে বােধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নিশ্চিত হইয়াছে! অশ্ব স্ত্রী প্রভৃতি পশু লৌহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণ-শৃখলে কণ্ঠ শােভিত করিয়া মনে করি “হার পরিয়াছি”। গােস্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া “নাকাদড়ী” পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে “নােলক” পরাইয়াছেন!! ঐ নােলক হইতেছে “স্বামীর অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন! অতএব দেখিলেন ভগিনি। আপনাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কি হইতে পারে? আবার মজা দেখুন, যাহার শরীরে দাসত্বের নিদর্শন যত অধিক, তিনি সমাজে তুতােধিক মান্যা গণ্যা!

 এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ! যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে। তাই দরিদ্রা কামিনীগণ স্বর্ণরৌপ্যের হাতকড়ী না পাইয়া কাচের চুড়ি পরিয়া দাসী-জীবন সার্থক করে। যে (বিধবা চুড়ি পরিতে অধিকারিণী নহে, তাহার মত হতভাগিনী যেন এ জগতে আর নাই! অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভাল লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি—গর্ব্বে স্ফীত হই।

 অলঙ্কার সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, তাহাতে কোন কোন ভগ্নী আমাকে পুরুষপক্ষেরই গুপ্তচর মনে করিতে পারেন। অর্থাৎ ভাবিবেন যে, আমি পুরুষদের টাকা স্বর্ণকারের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য হ্যত এরূপ কৌশলে ভগ্নীদিগকে অলঙ্কারে বীতশ্রদ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু তাহা নয়, আমি আপনাদের জন্যই দু'কথা বলিতে চাই। যদি অলঙ্কারের উদ্দেশ্য পুরুষদের টাকার শ্রাদ্ধ করাই হয়, তবে টাকার শ্রাদ্ধ করিবার অনেক উপায় আছে। দুই একটি উপায় বলিয়া দিতেছি।

 আপনার ঐ জড়ােয়া চিকটা বাড়ীর আদুরে কুকুরটির কণ্ঠে পরাইবেন। আপনি যখন শকটারােহণে বেড়াইতে যান, তখন সেই শকটবাই অশ্বের গলে আপনার বহুমূল্য হার পরাইতে পারেন! বালা ও চুড়িগুলি বসিবার ঘরের পর্দার কড়া (drawing roor-এর curtain ring) রূপে ব্যবহার করা যাইতে পারে। তবেই “স্বামী” নামধারী নরবরের টাকার বেশ শ্রাদ্ধ হইবে!! অলঙ্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য ঐশ্বর্য দেখান বই ত নয়। ঐরূপে ঐশ্বর্য্য দেখাইবেন | নিজের শরীরের দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিবেন কেন? উক্ত প্রকারে গহনার সদ্ব্যবহার করিলে প্রথম প্রথম লােকে আপনাকে পাগল বলিবে, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য না করিলেই চলিবে।[১] এ পােড়া সংসারে কোন ভাল কাজটা বিনা ক্লেশে সম্পাদিত হইয়াছে? “পৃথিবীর গতি আছে” এই কথা বলাতে মহাত্মা গ্যালিলিও (Galileo) কে বাতুলাগারে যাইতে হইয়াছিল। কোন সাধুলােকটি অনায়াসে নিজ বক্তব্য বলিতে পারিয়াছেন? তাই বলি, সমাজের কথায় কর্ণপাত করিবেন না। এ জুগতে ভাল কথা বা ভাল কাজের বর্তমানে আদর হয় না।


  1. অলঙ্কার পরা ও উক্তরূপে টাকার গাদ্দ করা একই কথা। কিন্তু আশা করা যায় যে উক্ত প্রকারে টাকার শ্রাদ্ধ না করিয়া টাকার সদ্ব্যয় করাই অনেকে ন্যায়সঙ্গত মনে করিবেন।