পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০ রোকেয়া রচনাবলী

সাহায্য করে, ("God helps those that help themselves”)। তাই বলি আমাদের অবস্থা আমরা চিন্তা না করিলে আর কেই আমাদের জন্য ভাবিবে না। ভাবিলেও তাহাতে আমাদের ষােল আনা উপকার হইবে না।

 অনেকে মনে করেন যে পুরুষের উপার্জিত ধন ভােগ করে বলিয়া নারী তাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক। বােধ হয় স্ত্রীজাতি প্রথমে শারীরিক শ্রমে অক্ষম হইয়া পরের উপার্জিত ধনভােগে বাধ্য হয়। এবং সেইজন্য তাহাকে মস্তক নত করিতে হয়। কিন্তু এখন স্ত্রীজাতির মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হওয়ায় দেখা যায়, যে স্থলে দরিদ্র শ্রীলােকেরা সূচিকর্ম্ম বা দাসীবৃত্তি দ্বারা অর্থ উপাৰ্জন করিয়া পতি পুত্র প্রতিপালন করে, সেখানেও ঐ অকর্ম্মণ্য পূরুষেরাই “স্বামী” থাকে। আবার যিনি স্বয়ং উপার্জন না করিয়া প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণীকে বিবাহ করেন, তিনিও ত স্ত্রীর উপর প্রভূত্ব করেন! এবং স্ত্রী তাহার প্রভুত্বে আপত্তি করেন না।[১] ইহার কারণ এই যে বহুকাল হইতে নারীহৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই “দাসী” হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কোন বস্তু নাই এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্য্যন্ত লক্ষিত হয় না! তাই বলিতে চাই:

“অতএব জগ, জাগ গাে ভগিনি !”

 প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গােলযােগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য “কৎল'এর (অর্থাৎ প্রাণদণ্ডের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি[২] (এবং ভগ্রিদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি!) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্ত জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি ত কোন ভাল কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে (but nevertheless it (Earth) does move")!! আমদিগকেও ঐরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে। এস্থলে পাসী নারীদের একটি উদাহরণ দিতেছি। নিম্নলিখিত কতিপয় পংক্তি এক খণ্ড উর্দু সংবাদপত্র হইতে অনূদিত হইল:

 এই পঞ্চাশ বর্ষের মধ্যে পাসী মহিলাদের অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বিলাতী সভ্যতা, যাহা তাঁহারা এখন লাভ করিয়াছেন, পূর্বে ইহার নাম মাত্র জানিতেন না। মুসলমানদের ন্যায় তাহারাও পর্দায় (অর্থাৎ অন্তঃপুরে) থাকিতেন। রৌদ্র ও বৃষ্টি হইতে রক্ষা পাইবার নিমিত্ত তাঁহারা ছত্র ব্যবহারে অধিকারিণী ছিলেন না। প্রখর রবির উত্তাপ সহিতে না পারিলে জুতাই ছত্ররূপে ব্যবহার করিতেন!! গাড়ীর ভিতর বসিলেও তাহাতে পর্দা থাকিত। অন্যের সম্মুখে স্বামীর সহিত আলাপ করিতে পাইতেন না। কিন্তু আজিকালি পাসী মহিলাগণ পর্দা ছাড়িয়াছেন! খােলা গাড়ীতে বেড়াইয়া থাকেন। অন্যান্য পুরুষের সহিত আলাপ করেন। নিজেরা ব্যবসায় (দোকানদারী) করেন। প্রথমে যখন কতিপয় ভদ্রলােক র্তাহাদের স্ত্রীকে (পর্দার) বাহির করিয়াছিলেন, তখন চারিদিকে ভীষণ কলরব উঠিয়াছিল। ধবলকেশ বুদ্ধিমানগণ বলিয়াছিলেন, “পৃথিবীর ধ্বংসকাল উপস্থিত হইল”।


  1. বঙ্গীয় কোন কোন সমাজের স্ত্রীলােক যে স্বাধীনতার দাবী করিয়া থাকেন, তাহা প্রকৃত স্বাধীনতা নহে—ফাকা আওয়াজ মাত্র।
  2. সমাজের সমঝদার (reasonable) পুরুষেরা প্রাণদণ্ডের বিধান নাও দিতে পারেন, কিন্তু “unreasonable" অবলাসৱলাগণ; (হারা যুক্তি তর্কের ধার ধারেন না, তাহার) শতমুখী ও আঁই বঁটীর ব্যবস্থা নিশ্চয় দিবেন, জানি!!