পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর ; প্রথম খণ্ড ২১

 কই পৃথিবী ত ধ্বংস হয় নাই। তাই বলি, একবার একই সঙ্গে সকলে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও,—সময়ে সবই সহিয়া যাইবে। স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে।

 এখন প্রশ্ন হইতে পারে, কি করিলে লুপ্ত রত্ন উদ্ধার হইবে? কি করলে আমরা দেশের উপযুক্ত কন্যা হইব? প্রথমতঃ সাংসারিক জীবনের পথে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংকল্প আবশাক। এবং আমরা যে গোলামজাতি নই, এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে।

 পুরুষের সমকক্ষতা[১] লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেড়ীমাজিষ্ট্রেট, লেডীব্যারিষ্টার, লেডীজজ - সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী Viceroy হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে “রাণী করিয়া ফেলিব!! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?[২]

 আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক। কার্য্যক্ষেত্রেও পুরুষের পরিশ্রমের মূল্য বেশী, নারীর কাজ সস্তায় বিক্রয় হয়। নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যে কাজ করিলে মাসে ২ বেতন পায়, ঠিক সেই কাজে স্ত্রীলোকে ১ পায়। চাকরের খোরাকী মাসিক ৩ আর চাকরাণীর খোরাকী ২। অবশ্য কখন কখন স্ত্রীলোককে পারিশ্রমিক বেশী পাইতেও দেখা যায়।


  1. আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ। একটা পরিবারের পুত্র ও কন্যায় যে প্রকার সমকক্ষতা থাকা উচিত, আমরা তাহাই চাই। যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র, আমরা সমাজের কন্যা! আমরা ইহা বলি না যে “কুমারের মাথায় যেমন উষ্ণীষ দিয়াছেন, কুমারীর মাথায়ও তাহাই দিবেন।” বরং এই বলি, কুমারের মস্তক শিরস্ত্রাণ সাজাইতে যতখানি যত্ন ও ব্যয় করা হয়, কুমারীর মাথা ঢকির ওড়াখানা প্রস্তুতের নিমিত্তও এতখানি যত্ন ব্যয় করা হউক।”
  2. কিন্তু আমাদিগকে তাহা করিতে হইবে কেন? কৃষক প্রজা থাকিতে জমীদার কাঁধে লাঙ্গল লইবন কেন? শুধু রাজার চাকরী ছাড়া আর কিছু উচ্চদরের কার্য্য কি আমরা করািত পারি না? কেরাণী ইত্যাদির কথা কেবল উদাহরণ স্বরূপ বলা হইল। যেমন স্বরে বর্ণনায় বলিতে হয় সেখানে শীত নাই, - গ্রীষ্ম নাই, কেবল চিরবসন্ত বিরাজমান থাকে। স্বচোধানে মরকত লতিকায় হীরক-প্রসূন ফোটে!! তাই আমাদের উচ্চ আশা বুঝাইবার নিমিত্ত লেভাইসরয় হইবার কথা না বলিলে কিসের সহিত আমাদের সে উচ্চদরের কার্য্যের উপমা দিব? আবার ইহাও বলি, লেড়ীকেরানী হওয়ার কথা কেবল বঙ্গদেশে যেমন shocking বোধ হয়, সেরূপ অন্যত্র বোধ হয় না। আমেরিকায় লেডীকেরাণী বা লেডীব্যারিষ্টার প্রভৃতি বিরল নহে। এবং এমন একদিনও ছিল, যখন অনান্য দেশের মুসলমানসমাজে “স্ত্রীকবি, স্ত্রীদার্শনিক, স্ত্রীঐতিহাসিক, শ্রীবৈজ্ঞানিক, স্ত্রীবক্তা, স্ত্রীচিকিৎসক, স্ত্রীরাজনীতিবিদ” প্রভৃতি কিছুরই অভাব ছিল না। কেবল বঙ্গীয় মোসলেমসমাজে ওরূপ রমণীরত্ন নাই।