পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২ রোকেয়া রচনাবলী

যদি বল, আমরা দুর্বলভুজা, মূখ, হীনবুদ্ধি নারী। সে দোষ কাহার? আমাদের। আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা। বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না? এখন একবার জ্ঞানচর্চা করিয়া দেখি ত এ অনুর্বর মস্তিষ্ক (dull head) সুতীক্ষ্ণ হয় কি না।

 পরিশেষে বলি, আমরা সমাজেরই অৰ্দ্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাধিয়া রাখিলে, সে খোড়াইয়া খোড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-~একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতা-—উভয়েরই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে—সর্বত্র আমরা যাহাতে তাহাদের পাশাপাশি চলিতে পারি, আমাদের এরূপ প্রণের আবশ্যক। প্রথমতঃ উন্নতির পথে তাহারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হইলেন—আমরা পশ্চাতে পড়িয়া রহিলাম। এখন তাহারা উন্নতিরাজ্যে গিয়া দেখিতেছেন সেখানে র্তাহাদের সঙ্গিনী নাই বলিয়া র্তাহারা একাকী হইয়া আছেন! তাই আবার ফিরিয়া দাড়াইতে বাধ্য হইতেছেন! এবং জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছেন, তাহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন। আমাদের উচিত যে তাঁহাদের সংসারের এক গুরুত্বর বােঝা বিশেষ না হইয়া আমরা সহচরী সহকস্মিণী সহধর্মিণী ইত্যাদি হইয়া তাহাদের সহায়তা করি। আমরা অকর্ম্মণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত।

 ভরসা করি আমাদের সুযােগ্যা ভগ্নীগণ এ বিষয়ে আলােচনা করিবেন। আন্দোলন না করিলেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবেন।

নিরীহ বাঙ্গালী

আমরা দুর্বল নিরীহ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সুমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ হয়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন্ বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য, চন্দ্রের চন্দ্রিকা, মধুর মাধুরী, যূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলের তরলতা—এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে! আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধুর ঐপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সরল।

 আমরা মূর্তিমতী কবিতা—যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজী ধরনের একটি অট্টালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা (drawing roon) এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা (drawing room suit}! যদি ভারতবর্ষকে একটা সরােবর মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহাতে পদ্মিনী! যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা!![১] অতএব আমরা মূর্ত্তিমান্ কাব্য।


  1. “নায়িকা” বলিয়া আমি ব্যাকরণের নিয়মভঙ্গ করি নাই। কারণ অনেকে বাঙ্গালী পুরুষকে “বেচারী” বলে। উর্দু ভাষায় পুরুষকে “বেচারা ও স্ত্রীলােককে “বেচারী" বলে। যদি আমরা “বেচারী” হইতে পারি, তবে “পদিনী”, “নায়িকা” ও পুরুষিকা” হইলে দোষ কি?