পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর : প্রথম খণ্ড ২৩

 আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি,—পুঁইশাকের ডাটা, সজিনা ও পুঁটি মৎস্যের ঝােল—অতিশয় সরস। আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি—ঘুত, দুগ্ধ, দধি, ছানা, নবনীত, ক্ষীর, সর, সন্দেশ ও রসগােল্লা—অতিশয় সুস্বাদু। আমাদের দেশের প্রধান ফল, আমু ও কাঁঠাল—বসাল এবং মধুর। অতএব আমাদের খাদ্যসামগ্রী ত্রিগুণাত্মক সরস, সুস্বাদু, মধুর।

 খাদ্যের গুণ অনুসারে শরীরের পুষ্টি হয়। তাই সজিনা যেমন বীজবহুল, আমাদের দেহে তেমনই উড়িটি সুল। নবনীতে কোমলতা অধিক, তাই আমাদের স্বভাবের ভীরুতা অধিক। শারীরিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিষ্প্রয়ােজন; এখন পােষাক পরিচ্ছদের কথা বলি।

 আমাদের বর অঙ্গ যেমন তৈলসিক্ত নবনিগঠিত সুকোমল, পরিধেয়ও তদ্রপ অতি সূক্ষ্ম শিমলার ধূতি ও চাদর। ইহাতে বায়ুসঞ্চলনের (Ventilation-এর) কোন বাধা বিঘ্ন হয় না! আমরা সময় সময় সভ্যতার অনুরােধে কোট শার্ট ব্যবহার করি বটে, কারণ পুরুষমানুষের সবই সহ্য হয়। কিন্তু আমাদের অর্ধাঙ্গী—হেমাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গিগণ তদনুকরণে ইংরাজললনাদের নির্লজ্জ পরিচ্ছদ (শেমিজ জ্যাকেট) ব্যবহার করেন না। তাঁহারা অতিশয় সুকুমারী ললিতা লজ্জাবতী লতিকা, তাই অতি মসৃণ ও সূক্ষ্ম “হাওয়ার সাড়ী” পরেন। বাঙ্গালীর সকল বস্তুই সুদর, স্বচ্ছ ও সহজল।

 বাঙ্গালীর গুণের কথা লিখিতে হইলে অনন্ত মসী, কাগজ ও অক্লান্ত লেখকের আবশ্যক। তবে সংক্ষেপে দুই চারিটা গুণের বর্ণনা করি।

 ধনবুদ্ধির দুই উপায়, বাণিজ্য ও কৃষি। বাণিজ্য আমাদের প্রধান ব্যবসায়। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা (আরব্যোপন্যাসের) সিন্দবাদের ন্যায় বাণিজ্যপােত অনিশ্চিত ফললাভের আশায় অনন্ত অপার সাগরে ভাসাইয়া দিয়া নৈরাশ্যের ঝঞাবাহে এপ্রােত হই না। আমরা ইহাকে (বাণিজ্য) সহজ ও স্বম্পায়াসসাধ্য করিয়া লইয়াছি। অর্থাৎ বাণিজ্য ব্যবসায়ে যে কঠিন পরিশ্রম আবশ্যক, তাহা বর্জন করিয়াছি। এই জন্য আমাদের দোকানে প্রয়ােজনীয় জিনিষ নাই, শুধু বিলাসদ্রব্য-নানাবিধ কেশতৈল ও নানাপ্রকার রােগবর্ধক ঔষধ এবং রাঙা পিস্তলের অলঙ্কার, নকল হীরার আংটী, বোতাম ইত্যাদি বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে। ঈদৃশ ব্যবসায়ে কায়িক পরিশ্রম নাই। আমরা খাটী সােশা রূপা বা হীরা জওয়াহেরা রাখি না, কারণ টাকার অভাব। বিশেষতঃ আজি কালি কোন জিনিষটার নকল না হয়?

 যখনই কেহ একটু যত্ন পরিশ্রম স্বীকার পুর্বক “দীর্ঘকেশী” তৈল প্রস্তুত করেন, অমনই আমরা তদনুকরণে “স্বকেশী” তৈল আবিষ্কার করি। যদি কেহ “কৃষ্ণকেশী” তৈল বিক্রয় করেন, তবে আমরা “শুভ্রকেশী” বাহির করি। “কুন্তলীনের সঙ্গে “কেশলীন বিক্রয় হয়। বাজারে “মস্তিষ্ক স্নিগ্ধকারী” ঔষধ আছে, “মস্তিষ্ক উকারী” দ্রব্যও আছে। এক কথায় বলি, যত প্রকারের নকল ও নিষ্প্রয়ােজনীয় জিনিষ হইতে পারে, সবই আছে। আমরা ধান্য ৩লের ব্যবসায় করি না, কারণ তাহাতে পরিশ্রম আবশ্যক।

 আমাদের অন্যতম ব্যবসায়—পাশ বিক্রয়। এই পাশ বিক্রেতার নাম “বর” এবং ক্রেতাকে “শ্বশুর” বলে। এক একটি পাশের মূল্য কত জন? “অর্ধেক রাজত্ব ও এক রাজকুমারী”। এম, এ, পাশ অমূল্যরত্ন, ইহা যে সে ক্রেতার ক্রেয় নহে। নিতান্ত সস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্য এক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব। আমরা অলস, তরলমতি, শমকাতর, কোমলাঙ্গ বাঙ্গালী কিনা তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি, সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা Old fool শ্বশুরের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করা সহজ।