পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬১ রোকেয়া রচনাবলী
৬১
নূর-ইসলাম


মিসিস এনি বেশান্তের “ইসলাম” শীর্ষক বক্তৃতা পাঠ করিলে বাস্তবিক মােহিত হইতে হয়। “ইসলাম” শব্দের সমভিব্যাহারে মিসিস বেশান্তের নাম শুনিয়া আপনারা কেহ ভীত হইবেন। প্রথমে আমারও আশঙ্কা হইয়াছিল যে, তিনি হয়ত তাহার ‘থিয়ােসফী’ ধর্ম্মের মহিমা প্রচার করিতে গিয়া আমাদের একমাত্র সম্বল ইসলামের উপর, খানিকটা হাত সাফ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু বক্তৃতা পাঠ করিয়া আমার সে ভ্রান্তি দূর হইল। হাত সাফ করা ত অতি দূরে—ইহার পতি পত্র-প্রতি ছত্র সুপক্ক আঙ্গুরের ন্যায় অতি মিষ্ট ভক্তিরসে পরিপূর্ণ! তিনি নূর-ইসলাম (বা ইসলাম-জ্যোতির) এমন উজ্জ্বল জ্যোতিৰ্ময় চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন যে তাহার তুলনা হয় না। এমনকি প্রিয় বঙ্গভাষায় ইহার মর্ম্মোদ্ধার করিবার লােভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না।

 তবে কথা এই যে, অনুবাদ করিবার মত ক্ষমতা ও বিদ্যাবুদ্ধি সকলের থাকে না - বিশেষতঃ আমার ন্যায় লােকের তাদৃশ চেষ্টা! তাহাতে আবার আমি বহু চেষ্টা করিয়াও মিসিস এনি বেশান্তের মূল ইংরাজী বক্তৃতা-পুস্তিকাখানি সংগ্রহ করিতে পারি নাই। আমাকে উহার উর্দু অনুবাদের উপরই নির্ভর করিতে হইতেছে। অনুবাদক মহােদয় অতি উচ্চ (সুফিধর্ম্ম ভাবপূর্ণ) ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন!

 সুতরাং আমি যদি ঐ অনুবাদের অনুবাদ করিতে গিয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া, নিজের ভাব ব্যক্ত এবং বিকৃত ভাষা ব্যবহার করিয়া ফেলি, সে ত্রুটি মার্জনীয় বলিয়া ভরসা করি।

 আর একটি কথা,—মিসিস এনি বেশান্ত যেমন হজরতের নাম উল্লেখ করিতে অত্যধিক সম্মানের ভাষা ব্যবহার না করিয়া, ভক্তের সরল ভাবপূর্ণ ভাষা প্রয়ােগ করিয়াছেন, অনুবাদক মােঃ হাসেনউদ্দিন সাহেবও তদ্রুপ করিয়াছে; যথা “আব ওহ মহম্মদ সিরফ, মহন্দু হি না রহা বাকে ওহ পয়গম্বরে আরব হুয়া” ইত্যাদি। ভাব ও ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমি অনুবাদক মহাশয়ের প্রথা অনুসরণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। আর দিবাকরের সমুজ্জ্বল কান্তি দেখাইবার জন্য, অন্য আলােকের প্রয়ােজন হয় না; পুষ্পের সৌন্দর্য্যবর্ধনের নিমিত্ত অলঙ্কারের প্রয়ােজন হয় না। যাহা হউক, আশা করি, আমি আড়ম্বরপূর্ণ সম্মানসূচক শব্দের বহুল প্রয়ােগ বর্জন করায় দোষী হই নাই।

 এখন আপনারা মনােযােগপূর্ব্বক শ্রবণ করুন, মিসিস বেশান্ত কি বলিতেছেন:

ভদ্র মহােদয়গণ!

প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে – ধর্ম্ম। ধর্ম্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। সে দেশের সমুদয় অধিবাসী একই ধর্ম্মবলম্বী, যে দেশে সকলে একই ভাবে একই ঈশ্বরের পূজা করে — তাঁহাকে সকলে একই নামে ডাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মনােভাব একই সূত্রে গ্রথিত থাকে, সে দেশ অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মতে যে দেশে এক ঈশ্বরকে লােকে বিভিন্ন নামে