পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬২ রোকেয়া রচনাবলী

ডাকে; একই ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্রণালীতে হয়; একই সৰ্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লােকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলে ইহাই মনে করে যে, আমরা সকলে একই গন্তব্যস্থানে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি, এবং এইরূপ পার্থক্যের মধ্যে একতা থাকে; যদি কোন দেশের ঐ অবস্থা হইত, (কিন্তু অদ্যাপি এমন কোন ভাগ্যবতী দেশের বিষয় জানা যায় নাই।) – আমার মতে সে দেশ নিশ্চয়ই ধর্ম্মে প্রধান হইত।

 অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মবিশ্বাসী লােক আছে, কিন্তু ভারতবর্ষ এই আদর্শের অদ্বিতীয় দেশ—ইহার তুলনা এ ভারত নিজেই। এদেশে এত স্বতন্ত্র ধর্ম্ম এবং এত পৃথক বিশ্বাসের লােক বাস করে যে, মনে হয় যেন ভারতবর্ষে সমস্ত পৃথিবীর ধর্ম্ম-মতসমূহের প্রদর্শনী-ক্ষেত্র। এবং এই দেশই সেই স্থান, যেখানে পরস্পরের একতা, মিত্রতা এবং সহানুভূতির মধ্যে ধর্ম্মের সেই আদর্শ—যাহাকে আমি ইতঃপূর্ব্বে বাঞ্ছনীয় বলিয়াছি—পাওয়া যাইতে পারে।

 আপনাদের স্মরণ থাকিতে পারে, তিন চারি বৎসর পূর্বে আমি আপনাদিগকে চারিটি প্রধান ধর্ম্মের, অর্থাৎ বৌদ্ধ, খ্রীষ্টীয়, হিন্দু এবং অনল-পূজার বিষয়ে বলিয়াছিলাম, কিন্তু তিনটি শ্রেষ্ঠ ধর্ম্মের, অর্থাৎ ইসলাম, জৈনমত, এবং শিখধর্ম্মের আলােচনা রহিয়া গিয়াছিল। এই তিন ধর্ম্ম—যাহা ভারতবর্ষের প্রধান সাতটী ধর্ম্মের অন্তর্গত—ইহাদের পরস্পরে এত অনৈক্য দেখা যায় যে, ইহারা একে অপরের রক্তপিপাসু হইয়া উঠে এবং দুইজনের মনের মিলনের পক্ষে এই ধর্ম্ম-পার্থক্য এক বিষম অন্তরায় হইয়া আছে।

 আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, ভারতবর্ষ হেন দেশে যদি সকলে চক্ষু হইতে, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আবরণ উন্মোচন করিয়া ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করতঃ চিন্তা করিয়া দেখেন, তবে তাহারা বুঝিতে পারিবেন যে “আমরা প্রকৃতপক্ষে একই প্রভুর উপাসনা বিভিন্ন প্রণালীতে করিতেছি—একই প্রভুকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ও ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকিতেছি।”

[পুরাও পুরাও মনস্কাম,
 কাহারে ডাকিছে অবিশ্রাম
জগতের ভাষাহীন ভাষা?”
 ড. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“সকলে তারেই ডাকে,
 আমি যারে ডাকি,
রাঙ্গা রবি নিয়া বুকে  উষা ডাকে সােণামুখে
 গােধূলি বালিকা ডাক।
 শ্যাম ছটা মাখি।”
 মানকুমারী দেবী।]

 আর, একই স্থান হইতে আমরা আসিয়াছি এবং সেইখানে পুনরায় যাইতেছি। ইহার ফল এই হইবে যে, একে অপরের সহিত নিতান্ত আন্তরিক ও প্রকৃত ভ্রাতৃভাবে মিশিতে পারিবে। একের দুঃখে অপরে দুঃখিত হইবে—সমুদয় ভারতবাসী একই জাতি বলিয়া পরিগণিত