পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচুর : দ্বিতীয় খণ্ড ৬৩

হইবার অধিকার প্রাপ্ত হইবে। অধিকন্তু জগতের বড় বড় শক্তিপুঞ্জ ভারতসন্তানকে একজাতি সালথা স্বীকার করিবে। যখন হিন্দু মুসলমানে, পারসী-খ্রীষ্টানে, জৈন-য়ীহুদীতে এবং বৌদ্ধ শখে প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে আলিঙ্গ হইবে, তখন আমি মনে করিব যে, ধর্মের জয় এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পবিত্র নাম শান্তিপ্রদ হইয়াছে।

 অদ্য আমি ইসলাম সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিব এবং আগামী কল্য ও পরশ্ব অবশিষ্ট দই ধর্ম্ম সম্বন্ধে, এবং অনন্তর সমুদয় ধর্ম্মের প্রকৃত মর্ম্ম-সারতত্ত্ব অর্থাৎ সেই থিয়ােসফী (বজ্ঞান বা “এলমে-এলাহী”) সম্বন্ধে আলােচনা করিব, যাহাতে প্রত্যেক ধর্ম্মবিশ্বাসের সারভাগ আছে এবং যাহা সকলের উপর একই প্রকার অধিকার রাখে—যাহাকে কোন বিশেষ ব্যক্তি তাহার নিজস্ব বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম বলিতে পারে না; বরং তদ্বিপরীত যে কোন ধর্ম্মবিশ্বাসের অধিকারী বলিতে পারে যে, ইহাই আমারও ধর্ম্ম। অদ্য সমিতির সম্মাৎসরিক অধিবেশন দিনে আমার এই প্রার্থনা যে, বিশ্ব-সংসারের সমুদয় ধর্মগুরুদের পবিত্র-আত্মা আমাদের ও আমাদের কার্যকলাপের প্রতি তাহাদের আশীর্বাদপূর্ণ দৃষ্টিপাত করুন—যেন তাহাদের শিষ্যমণ্ডলী একজন অপরকে ভাল বাসিতে পারেন। আমীন!

ইসলাম

কোন ধর্ম্ম পরীক্ষা করিতে হইলে, আমাদিগকে চারিটি বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করিতে হয়। সর্বপ্রথম সেই ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস, যাহার প্রভাব তাহাতে (সেই ধর্ম্মে) লুক্কায়িত থাকে। দ্বিতীয়, তাহার প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মত অথবা শাখা পল্লব, যাহার সহিত সাধারণে সম্পর্ক রাখে। তৃতীয়, ধর্ম্মের দর্শন, যাহা বিদ্বান এবং সুশিক্ষিত লােকদের জন্য। চতুর্থ, ধর্ম্মের গূঢ় রহস্য, যাহাতে সাধারণতঃ মানবের আপন অহং বা অস্তিত্বজ্ঞানের ভাণ্ডারের সহিত মিশিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা প্রকাশ পায়। আমি এই কষ্টিপাথরে ইসলামকে পরীক্ষা করিয়া আপনাদিগকে দেখাইতে চাই যে, সর্বপ্রথমে আরব ও শামদেশের অবস্থার প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া দেখুন, সে দেশের কি দশা ছিল।

 খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে যখন সমস্ত আরব, শাম ও আজমদেশে অসভ্যতার ঘাের অন্ধকারে কুসংস্কারের প্রবল ঝঞানিল বহিতেছিল; যুদ্ধকলহ ও পরস্পরের রক্তারক্তি এক দলকে অন্য দল হইতে পৃথক করিতেছিল; হিংসা দ্বেষ প্রবল ছিল যে, একই বিষয়ের ঝগড়া কয় পুরুষ পর্য্যন্ত চলিত;[১] যথা এক ব্যক্তি কোন বিষয় লইয়া অন্য একজনের সহিত বিবাদ করিল, অনন্তর শত বৎসর পরে একের পৌত্র অপরের পৌত্রকে শুধু এই অজুহাতে হত্যা করিত যে, “ইহার পিতামহ আমার পিতামহের শত্রু ছিল!” ইহা সেই আরব দেশ—সেখানে কেবল এই কথায় যুদ্ধ আরম্ভ হইত যে, “তােমার উষ্ট আমার উষ্ট্রকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইল কেন?” বাস, এই সামান্য কারণে রক্তনদী প্রবাহিত হইত—শবরাশি স্থূপীকৃত


  1. আশ্চর্যের বিষয়, এই সভ্যযুগেও বঙ্গীয় মুসলমানদের ঘরে ঐরূপ বংশানুক্রমে চিরস্থায়ী বিবাদ দেখা যায়। এইজন্য আমরা কলিকাতা হাইকোর্টে “Hereditary enemy” শব্দ শুনিতে পাই। আহা! কবে আমাদের প্রতি খােদাতালার রহমৎ হইবে!