পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৪ রোকেয়া রচনাবলী

হইত! এ সেই আরব দেশ—যেখানে নিষ্ঠুর পিতা, মাতার ক্রোড় হইতে শিশু কন্যাকে কাড়িয়া লইয়া গর্ত খনন করিয়া তাহাতে জীবন্ত প্রােথিত করিয়া আসিত। আর হত ভাগিনী নিরুপায় মাতা আপন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহপূর্ণহৃদয়ের অসহ্য বেদনা লইয়া মরমে মরিয়া থাকিত। স্ত্রীলােক হওয়ার দরুণ পাষণ্ড স্বামীর ঐ নিম্মম অত্যাচারে আপত্তি করিতে পারে, এতটুকু ক্ষমতাও তাহার ছিল না। কাহাকেও জামাতা বলিতে না হয়, এইজন্য কন্যা হত্যা করা হইত। ইহা সেই দেশ, যেখানে ঘৃণিত পৌত্তলিকতা বিরাজমান ছিল—ঘরে ঘরে নতুন দেবতা; এক ঠাকুর আবার অন্য ঠাকুরের প্রাণের শত্রু! প্রতিমার সম্মুখে নরবলিদান’ ত নিত্য ক্রীড়া ছিল; যেখানে মানবজাতির প্রতি স্নেহ মমতার পরিবর্তে বিলাসিতা ও আত্মপরায়ণতা পূর্ণ মাত্রায় রাজত্ব করিত। যে কোন প্রবল ব্যক্তি আপন দুৰ্বল প্রতিবেশীকে বিনা কারণে কিম্বা অতি সামান্য কারণে হত্যা করিয়া ফেলিত; তাহার ঐ দুস্ক্রিয়ায় বাধা দিবার লােক’ ত দূরে থাকুক, একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবারও কেহ ছিল না।

 তদানীন্তন আরবে বিলাসিতার ও অন্যান্য “মকারাদি” কুক্রিয়ার অন্ত ছিল না; এক স্বামী ভেড়া ছাগল প্রভৃতি পশুর ন্যায় অসংখ্য ভার্য্যা গ্রহণ করিত; আর এই বিষয়ে গৌরব করা হইত যে অমুক ধনী ব্যক্তি এত অসংখ্য স্ত্রীর স্বামী। ঈশ্বরের সৃষ্টি—স্ত্রীজাতি এমন জঘন্য দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল যে, তাহারা নিতান্ত অসহায় গৃহপালিত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করিত। মােটের উপর এমন কোন নিকৃষ্ট পাপ ও জঘন্য দোষ নাই, যাহা তৎকালীন আরবে না ছিল।

 সেই স্বার্থ, অত্যাচার ও আত্মপরতার পূতিগন্ধময় জলবায়ু পরিবেষ্টিত এক কোরেশগৃহে একটি শিশু (সে পবিত্র শিশুরত্নের উদ্দেশে সহস্র দরুদ!) জন্মগ্রহণ করিলেন, যাঁহার পিতা তাহার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পূৰ্বেই ইহধাম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। আর তিনিও সেইরূপ পিতা ছিলেন, যিনি তদীয় পিতৃকর্তৃক কোন প্রতিমার সম্মুখে নরবলিরূপে আনীত হইয়াছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ দেবালয়ের সেবিকার কৃপায়—সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছিলেন।[১] এই শিশু এমন একটি হতভাগিনী দুঃখিনী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ইনি ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্ব্বেহ বিধবা হইয়াছিলেন, আর দারুণ বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কয়েক মাস পরেই এ অবােধ দুগ্ধপােষ্য শিশুকে নিঃসহায় অবস্থায় ফেলিয়া স্বামীর অনুগমন করেন। ইহার ফলে এই পিতৃমাতৃহীন শিশু কিছুদিন স্বীয় পিতামহ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁহার পিতামহও কয়েক বৎসর পরে দেহত্যাগ করিলেন। তখন সেই অসহায় বালক বয়ােপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত, স্বীয় পিতৃব্য আবু তালেবের আশ্রয়ে রহিলেন। ইহা ত অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এইরূপ বিপদগ্রস্ত পিতৃমাতৃহীন সহায়সম্পদশূন্য একটি অজ্ঞান বালক যে শিক্ষাদীক্ষা হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত


  1. হজরতের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব যে স্বীয় পুত্র হজরত আবদুল্লাকে প্রস্তরমূর্তির নিকট বলিদান করিতে গিয়াছিলেন, এ কথার সত্যতায় আমার একটু দ্বিধা বােধ হয়। আলেম ফাজেলগণ দয়া করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করিলে বিশেষ বাধিত হইব। বাঙ্গালা “আমির হামজা” পুঁথিতে দেখিয়াছি, - (হজরত আবদুল মুত্তালিবের অন্য পুত্র হজরত আমির হামজা পিতাকে বলিলেন) “কাফেরে খাজানা দিবে মােছলমান হৈয়া। আমি এয়ছা বেটা তবে কিসের লাগিয়া।” (এ ঘটনাটা সত্য)