পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর: দ্বিতীয় খণ্ড ৬৫

থাকিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। বাস্তবিক কার্যতঃও তাহাই হইয়াছিল। শিক্ষা, বা অধ্যয়ন বলিতে একটি অক্ষরের সঙ্গেও তাহার পরিচয় হয় নাই, নীতি বা আচার নিয়মের 'অনুশাসনের বাতাস পর্যন্ত তাঁহাকে স্পর্শ করে নাই। তথাপি তাহার শৈশবকাল, অতি পবিত্র ' জীবনের উচ্চ আদর্শ ছিল। তাহার নির্ম্মল জীবনে মানবের বাঞ্ছনীয় যাবতীয় সদগুণরাজি―যথা, দয়া, সৌজন্য, প্রেম, ধৈর্য্য, নম্রতা, বিনয়, শান্তিপ্রিয়তা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি স্বভাবতঃ বিরাজমান ছিল। তিনি নানা গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।

 বাল্যজীবন অতিক্রম করিয়া তিনি কৈশোরে উপনীত হইলেন। এখন জীবিকা-অর্জনের নিমিত্ত তিনি আপন কোন বিধবা আত্মীয়ার গৃহে কর্ম্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলেন। উক্ত বিধবা খদিজা বিবি তাহাকে পণ্যদ্রব্যসহ বাণিজ্য উপলক্ষে শামদেশে প্রেরণ করিতেন। এই বিষয়কর্ম্মে খজিদাবিবি দেখিতে পাইলেন যে তাহার এই নূতন কর্ম্মচারী অতিশয় ধর্ম্মভীরু, ন্যায়পরায়ণ, মিতব্যয়ী এবং অতি বিশ্বাসী। অতঃপর তিনি ইহার সহিত পরিণীতা হন।

 ইহা স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে, এই নবীন যুবক যাহার নাম মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওসাল্লাম) ছিল, সে সময়ে পয়গম্বর হন নাই। আর তাহার পত্নী হজরত খদিজাও তাহার ধর্ম্মবিশ্বাসের অনুবর্ত্তিনী ছিলেন না; নি স্বয়ং অল্পবয়স্ক তরুণ এবং তাহার জায়া তদপেক্ষা দ্বিগুণ বয়োজেষ্ঠা ছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তাহারা এমন সুখের দাম্পত্য জীবন ভোগ করিয়াছিলেন যে, পৃথিবীতে তেমন মধুর দাম্পত্যজীবনের উচ্চ আদর্শ আর কেহ দেখাইতে পারিয়াছে কি না সন্দেহ-আর তেমনই ভাবে তাহাদের বিবাহ জীবনের পূর্ণ ২৬ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর হজরত খদিজার মৃত্যু হইল। অতঃপর পয়গম্বর সাহেবের স্বভাব চরিত্র ও কার্যকলাপ সর্বদাই অতি প্রশংসনীয় ছিল। যখন তিনি মক্কার সঙ্কীর্ণ গলিকুচাতে যাতায়াত করিতেন, সে সময় তত্রত্য ক্রীড়ারত অবোধ শিশুগণ তাহার পদযুগল জড়াইয়া ধরিত, আর তিনি সততই তাহাদের সহিত স্নেহসিক্ত মিষ্টভাষায় কথা বলিতেন, তাহাদের মস্তকে হস্তামর্শন করিতেন। কেহ কখনও শুনে নাই যে, তিনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সর্বদা বিপদগ্রস্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন; বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্ত্বনা ও প্রবোধ দান তাহার নিত্য কর্ম্ম ছিল। প্রতিবেশিবর্গ তাহাকে “আমীন” (বিশ্বস্ত) বলিয়া ডাকিত। “আমীন” শব্দের অর্থ বিশ্বাসভাজন—এমন উচ্চ ভাবপূর্ণ উপাধি কেবল শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিই বিশ্ব জগতের নিকট প্রাপ্ত হইতে পারেন। এখন আপনারা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন ত; যে ব্যক্তির বাহ্যিক জীবন জগতের পক্ষে এমন উপকারী এবং সুখ শান্তিপ্রদ ছিল, তাহার আভ্যন্তরীণ জীবন কেমন হইতে পারে। অহো! (সত্য তত্ত্বজ্ঞান লাভের নিমিত্ত) তাঁহার আন্তরিক ব্যাকুলতার বন্যাস্রোতের তাড়না তাহাকে বনে বনে ও জনপ্রাণিশূন্য মরুভূমে ভাসাইয়া লইয়া যাইত। তিনি কতবার দিবানিশি অনশনে অনিদ্রায় বিপৎসঙ্কুল পর্বতকন্দরে বাস করিতেন। তিনি যে ভাবে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বর্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মর্ম্ম কেবল তাহারাই বুঝিতে পারেন, যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন।

 ক্রমে হজরত মোহাম্মদের (দঃ) এই প্রকার ধ্যান-আরাধনা এত বৃদ্ধি পাইল যে, তিনি লোকালয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক দূরে ― অতি দূরে ― ঘোর অরণ্যে চলিয়া যাইতেন; দুর্গম ও

রোব ৫