পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬ রোকেয়া রচনাবলী

ভয়ঙ্কর গিরিগুহায় মাসাধিককাল পর্যন্ত বাস করিতেন—সেখানে শুধু সিজদায় (নতশিরে) পড়িয়া অনবরত রােদন ও বিলাপ ব্যতীত তাহার অন্য কোন কাজ ছিল না। এমনকি তিনি অন্যূন পঞ্চদশ বর্ষ এই ভাবে যাপন করিলেন—অবশেষে সেই শুভ মুহূর্ত আসিল, যখন দৈববাণী তাহাকে সম্বােধন করিয়া কহিল, “উঠ! খােদায় পাকের (পবিত্র ঈশ্বরের) নাম উচ্চারণ কর!” কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সে শব্দ কাহার; অথবা ঐ আকাশবাণী বাস্তবিকই বিশ্বাসযােগ্য দৈববাণী কি না? কারণ তিনি বেশ জানিতেন যে, তিনি নিরক্ষর লােক ছিলেন। তাঁহার সন্দেহ হইত যে, ইহা হয়ত তাহার ভ্রম বা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র—কিম্বা তাহার অহংজ্ঞান তাঁহাকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত ঐরূপ করিতেছে; এবং সম্ভবতঃ ইহা সেই দৈববাণী নহে, যাহা স্বয়ং খােদাতালার নিকট হইতে পয়গম্বরগণ শুনিতে পাইতেন, যাহাকে “এলহাম” কিম্বা “অহি” বলে।

 অবশেষে আর একবার যখন তিনি ঈশ্বর-চিন্তায় অত্যন্ত আকুল ছিলেন, সহসা তাহার চতুম্পার্শ্ব এক অলৌকিক স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, আর সেই আলােকরাশির মধ্যে একটা জ্যোতিন্মান মূর্তি দেখা দিয়া বলিলেন, “যাও, সত্য নাম উচ্চারণ কর।” একবার সাহসে ভর করিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি কাহাকে ডাকিব?” ইহার উত্তরে স্বর্গদূত তাহাকে ঈশ্বরের একত্ব, ফেরেশতাদের রহস্য, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং মানবজাতির অস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষাদান করিলেন এবং তাহাকে সেই দায়িত্বপূর্ণ গুরুতর কর্ম্মভারের (পয়গম্বরীর) কথাও বলিলেন, যে জন্য তাহার জন্ম হইয়াছে। অর্থাৎ দেবদূত বলিয়া দিলেন। যে, তাহাকে বিশ্ব জগতের ধর্ম্মপথ প্রদর্শক এবং উপদেষ্টার কার্যভার সমর্পণ করা হইয়াছে।

 এদিকে দেবদূত অদৃশ্য হইলেন, ওদিকে হজরত মােহাম্মদ (দঃ) যিনি এখন হইতে আরব দেশের পয়গম্বর নামে অভিহিত হইবেন, অত্যন্ত অস্থির ও ভীতি বিহ্বল চিত্তে গৃহে। প্রত্যাগমন করিলেন এবং অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িলেন। পতিপ্রাণা সতী হজরত খাদিজা উপযুক্ত শুশ্রুষা সহকারে তাহার তাদৃশ বিহ্বলতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে পয়গম্বর সাহেব আনুপূর্বিক সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করিয়া বলিলেন, “বােধ হয় ইহা আমার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।” ইহাতে পতিপরায়ণা সাধ্বী রমণী অতিশয় সানাপূর্ণ মধুর বচনে তাহার নিস্তেজ হৃদয়ে বল সঞ্চার করিয়া বলিলেন, “না, না, তুমি সত্যবাদী বিশ্বাসী“আমীন”; প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান; পিতৃহীনের প্রতি স্নেহ বর্ষণ কর; দরিদ্র, আতুর ও বিধবার প্রতি দয়া করিয়া থাক—এমন লােককে বিশ্বপাতা কখনই অকালে নষ্ট করিবেন না। প্রভু খােদাতালা কখনও বিশ্বাসী ভক্তদিগকে প্রবঞ্চনা করেন না। উঠ, এখন সেই দৈববাণী-প্রকৃত সত্য দৈববাণীর প্রত্যাদেশ অনুসারে কার্য্য কর।” |

 সেই পুণ্যবতী মহিলা, যিনি সর্ব প্রথমে পয়গম্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন, এমনই সঞ্জীবনীসুধা পূর্ণ প্রবােধ বাক্যে তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন যে তিনি—যিনি নিজের দুর্বলতায় জড়ীভূত ও নিরুদ্যম হইয়া সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করিয়া বসিয়া ছিলেন,[১] এখন পূর্ণ সাহসে ও উৎসাহপূর্ণ হৃদয়ে, একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন! আর সে মােহাম্মদ কেবল। মােহাম্মদ মাত্রই রহিলেন না বরং প্রবল প্রতাপশালী পয়গম্বর হইয়া গেলেন। তিনি একটা


  1. ইহা মিসিস বেশান্তের অতিশয়ােক্তি। (আল-এসলাম সম্পাদক)