পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর : দ্বিতীয় খণ্ড ৬৭

অভ্য, অরাজক দেশকে শান্তিপূর্ণ এবং একটা জনপ্রাণীবিরল নগণ্য উপদ্বীপকে এক মহা সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়া তুলিলেন। তাহার শিষ্যমণ্ডলী ইউরােপে ধর্ম্ম ও জ্ঞানের আলােক: লইয়া গেলেন, এই দুইটী বস্তু সেখানে প্রায় ছিলই না। তাহার অনুবর্তিগণ পৃথিবীতে বড় বড় সামাজ্যের ভিত্তি স্থান করিলেন। তাহারা সমবিশ্বাসীগণ এমন নিষ্ঠার সহিত এলাহীর ধ্যান ও অবণে নিমগ্ন হইলেন যে, তাহার আদর্শ অন্য কোন ধর্ম্মে পাওয়া সম্ভবপর কি না সন্দেহ। কারণ আপনারা একটু চিন্তা করিলে এবং ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাইবেন যে, অন্য কোন ধর্ম্ম এমন নাই, যাহাতে এমন অকপটহৃদয় সত্যবিশ্বাসী লােক পাওয়া যায়। এই কান বিশ্বাস তাহারা (মুসলমানেরা) আরবদের পয়গম্বর হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।

 যদি বেন সাহেবের কথামত ইহাই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় যে, সাধারণ আচার ব্যবহার হইতে ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহা হইলে আপনারা ঐ ধর্ম্মের অনুবর্তিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন এবং ভাবিয়া দেখুন, তাহার (হজরতের) বাক্যসমূহ তাহার শিষ্যবর্গের হৃদয়ে কেমন স্পষ্টভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। মুসলমানেরা আরবের পয়গম্বর হইতে যে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে তাহাদের বিশ্বাস এমন সুদৃঢ় যে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ স্থান পায় না।

 একজন মুসলমান—যদ্যপি এমন কোন স্থানে এমন কতকগুলি লােক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, যাহারা তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ছুরিকায় খণ্ড খণ্ড করে এবং তাহার পয়গম্বরের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে—নমাজে মস্তক অবনত করিতে কিছুমাত্র লজ্জিত বা কুষ্ঠিত হয় না।[১]

 আপনারা আরও একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, পয়গম্বরের সুপারিশের (শাফা'আতের) প্রতি তাহাদের বিশ্বাস কেমন অটল যে, তাহারা মৃত্যুভয় একেবারে জয় করিয়া ফেলিয়াছে। আফ্রিকার দরবেশবৃন্দের সৎসাহসের তুলনা কেহ আমাকে দেখাইতে পারেন কি? -যাহারা ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু তােপ-কামানের সম্মুখে স্থিরভাবে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইবার জন্য এমনই আনন্দের সহিত অগ্রসর হইতেন, যেন বরযাত্রিরূপে কোন বিবাহ সভায় যাইতেছেন! এবং যে পর্য্যন্ত তাহাদের দলের কয়েক ব্যক্তি শত্রুসেনা পর্য্যন্ত পৌছিতে না পারিতেন, সে পর্য্যন্ত দলে দলে কামানে ধ্বংস হইতেন। সে কোন্ উদ্দীপনা ছিল, যাহা তাহাদিগকে এমন ভীষণ মৃত্যুমুখে লইয়া যাইত? তাহা কেবল পয়গম্বরের-কোরআনের মহিমা, এবং ইসলামপ্রেম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, (তাহাদের) এই ভক্তি পৃথিবীতে ভবিষ্যতেও অটল রহিবে, বরং বর্তমান যুগ অপেক্ষা ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল আলােক বিকীর্ণ করিবে। (আমীন।)।

 ভদ্র মহােদয়গণ! এখন আমি আরবীয় পয়গম্বরের সত্যনিষ্ঠা সম্বন্ধে একটি প্রমাণ আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি। তাহা এই যে-পয়গম্বরের “নবুয়তে” সর্বপ্রথমে বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাঁহার সহধর্শিনী যিনি তাঁহার গার্হস্থ্য জীবনের সমুদয় রহস্য অবগত ছিলেন, আর তাহার অতি অন্তরঙ্গ আত্মীয়া ছিলেন বলিয়া তাহার আশৈশব জীবনের স্বভাব-চরিত্র সমুদয় উত্তমরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এই যদি আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখেন, তবে, পয়গম্বরের সত্যপরায়ণতা সম্বন্ধে অতি জ্বলন্ত প্রমাণ পাইবেন। আপনারা নিজেরাই


  1. মিসিস এনি বেশান্তের বর্ণিত মুসলমান কি আমরাই? ছি! ছি! ধিক আমাদের! আমরা মুসলমান নামের কলঙ্ক। বঙ্গদেশে দড়ি ও কলসী একেবারে নাই কি?