পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৪৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-তৃতীয় খণ্ড ভূমি প্রাপ্ত হইলেন। গয়ঘড়ের দক্ষিণ সংলগ্ন সেই যৌতুক প্রাপ্ত ভূমিতে বাসের জন্য যাদব এক বৃহৎ বাটিকা নির্মাণ করিলেন, তাহার বাসহেতু উক্ত স্থানে ঘোষউঢ়া গ্রাম নামে খ্যাত। যাদব অতঃপর ইটার রাজ বংশীয় দেওয়ানগণ সহ পরিচিত হইলেন। তাহারা সদ্বংশীয় বিদ্বান যাদবের গুণের আদর করিতে ভুলিলেন না, যাদবের বাড়ীর সংলগ্নই তাহদের অধীকৃত বুরঙ্গী নামক গ্রাম ছিল। দেওয়ান যাদবকে উক্ত বুরঙ্গী গ্রাম দান করেন। দানপ্রাপ্ত বুরঙ্গীর সামিলে ঘোষ উড়ার পরিসর অনেকটা বৰ্দ্ধিত হয়। সন্তান-সন্তুতি কিছুকাল পরে যাদব ঘোষের একপুত্র জনিল, যাদব তাহার নাম বিষ্ণুঘোষ রাখিলেন, ইহার জন্মের কয়েক বৎসর পরেই যাদবের মৃত্যু হয়। বিষ্ণুঘোষ পিতার মুখে শুনিতে পারলেন না যে, তিনি কোন মহাবংশে জাত হইয়াছেন। যাহাহউক, তিনি সংস্কৃত শিক্ষার মনোযোগ দিলেন এবং অনতিবিলম্বেই বিদ্যা-বিনয়ে বিভূষিত হইয়া উঠিলেন, ধৰ্ম্মে তাহার স্বাভাবিকী রতি উপজাত হইল; তাহার বংশেরই গুণ বলিয়া সকলে বলিতে লাগিল। বিষ্ণুঘোষ প্রবিষ্ট হইয়া একটা দীর্ঘিকা খনন করাইলেন, এবং উহার সন্নিকটবৰ্ত্তী একটি বাটিকাও প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, কিন্তু কাল গ্রাসে পতিত হয়ে সেই বাড়ীতে যাইতে পারে নাই। বিষ্ণুঘোষের শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য নামে দুই পুত্র হয়। ইহারা উভয়েই পরম ধৰ্ম্মপরায়ণ ছিলেন। তাহাদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায় কনিষ্ঠ শ্রীচৈতন্য ঘোষ ইটার দেওয়ান বংশের অধীনে একটি কৰ্ম্ম স্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি চতুৰ্দ্দিকেই শাক্ত মতের বিজয়-পতাকা উড়িতে দেখিতেন, তদঞ্চলে তৎকালে বৈষ্ণব মতের কিছুই আদর ছিল না; শিশুদিগকে পৈতৃক গুরু শক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়া যাইতেন। তদবস্থায় এই ভ্রাতৃদ্বয়ের মনে শিশুকালাবধি বিষ্ণু ভক্তির উদয় হওয়াই এক আশ্চর্য ব্যাপার। কৃষ্ণ ঘোষ কাহাকেও কোন কথা বলতেন না, কিন্তু আপন মনে ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করিতেন যেন দেশে বৈষ্ণব ধৰ্ম্মের শান্ত প্রবাহ বহিতে আরম্ভ হয়, মদ্য মাংসের প্রসার কমিয়া যায়, লোক যেন উগ্রতা ত্যাগে যথার্থ সাত্বিক ভাবাপন্ন হয়। মনু নদীর মাহাত্ম্যের কথা তিনি অবগত ছিলেন। সত্যযুগে এই মনু তীরেই ভগবান মনু শিলাচ্চনা করিয়াছিলেন বলিয়া কথিত হয়; এই মনু মাহায্যে মোহিত মহারাজ অমর মাণিক্য মনুতে তনুত্যাগ করেন। কৃষ্ণ ঘোষ এই মনুতীরে কখন কখন একাকী পরিভ্রমণ করিতেন, নানা ভাবে অভিভাবিত হইতেন । কৃষ্ণঘোষের জাগ্রত স্বপ্ন একদা এইরূপ পরিভ্রমণ করিতেছেন, সেদিন মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী । মনু নদীর মাহাত্ম্য স্মরণে ইহাকে তিনি পূত সলিলা সুর তরঙ্গিনী বলিয়াই বোধ করিতেছেন; তাহার মনে তখন নদীয়ার সুরধনী তীরের কথা-গৌর অবতারের বিচিত্র পুণ্যগাথা জাগিয়া উঠিয়াছে; তিনি তন্ময় হইয়া-যেন বাহ্য জ্ঞান বিরহিত হইয়া বিচরণ করিতেছেন। একি? হঠাৎ সম্মুখে শত শশধর উদিত হইল, সিদ্ধ জ্যোতি উদ্ভাসিত হইয়া তরঙ্গে তরঙ্গে লীলা লহরী বিস্তার করিল; কৃষ্ণ ঘোষ বিক্ষিত-নেত্রে সুব তরঙ্গিনী-তীর-বিহারী নদীয়ার মাকথিত আছে যে পূৰ্ব্বে ঐ স্থানে বুরঙ্গা নামে এক কুকি সর্দার বাস করিত বলিয়া তাহার নামেই উহা খ্যাত হয়।