পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১৪৩ পলাইয়া গিয়াছিল। পেড়াশাহ পত্নীকে বড়ই ভালবাসিতেন, সে তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে তিনি তাহার বিরহে জৰ্জ্জরিত হন। নিকটে এক প্রৌঢ়ার বাড়ী ছিল, পেড়া তাহার কাছে কখন কখন হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ করিতেন। স্ত্রীর কথা কহিতে কহিতে তাহার নয়ন দিয়া জলধারা বহিত। একদিন সেই প্রৌঢ়া তাহাকে বলিল “তুমিত স্ত্রীর জন্য কাদিতেছ কিন্তু সে দুষ্ট কি তোমায় স্মরণ করিতেছে, সে হয়তঃ এখন উপপতির সহিত রসালাপে মত্ত আছে। এত কাদিতে পারিতে যদি খোদার নামে, তবে খোদা থাকিতে পারিতেন না, তোমায় দেখা দিতেন, তোমার দুঃখ তাপ দূর করিতেন।" পেড়া স্থির হইয়া কথাগুলি শুনিলেন, দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “ঠিক বলিয়াছ, কিন্তু খোদাকে ডাকা আমার মতো গরিব কিরূপে পরিবে, পোড়া পেটই এখন বৈরী, কে আমার আহার যোগাইবে বল?" স্ত্রীলোক বলিল—“আমি দিব, তুমি খোদার উপর নির্ভর কর।” পেড়া শাহা জঙ্গলে লুক্কাইত হইলেন, মনুষ্যসঙ্গ একবারে পরিত্যাগ করিলেন; মাত্র দিবসের মধ্যে একবার আসিয়া সেই মোসলমানীর গৃহে আহার করিয়া যাইতেন; কাহারও সহিত আলাপ করিতেন না । দরিদ্রা রমণী কোন প্রকারে শাক অন্ন যোগাইত। একদিন তাহার বাড়ীতে তদীয় জামাতা আসিবার কথা ছিল, এবং সেই জন্য ভাল তণ্ডুল সংগৃহীত হইয়াছিল। ভাল তণ্ডুল দৃষ্টে তিনি বধূকে সাধুর জন্য তাহা পাক করিতে বলিলে, বধূ নিতান্ত অনিচ্ছার সহিত তাহা পাক করে। খাইতে আসিলে সেই তণ্ডুলের অন্ন তাহাকে দিতে আসিলে তিনি বলিলেন, “এ অন্ন খাইব না, ইহা জামাতার জন্য আনা হয়, ইহা আমাকে দিতে তোমার বধূর ইচ্ছা ছিল না।" পেড়া শাহা বধূর মনের কথা কিরূপে জ্ঞাত হইলেন? ফলতঃ এই ঘটনা হইতে তিনি সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া খ্যাত হন; তিনি যাহাকে যাহা বলিতেন, তাহা সফল হইত। তিপূলি বিলের ধারে জলডুবে একস্থানে তিনি বসিয়া রহিতেন। ইনি মুসিম শাহ নামক এক ব্যক্তিকে বড়ই স্নেহ করিতেন। মুসিম শাহও কালে গুরুর ন্যায় লোকের শ্রদ্ধার পাত্র হইয়াছিলেন। বহুলোক ঔষধপ্রাপ্তির আশায় তাহার কাছে যাইত। টাকা পয়সাকে তিনি "চাড়" (মৃৎপাত্রাদির ভগ্ন অব্যবহার্য খণ্ড) বলতেন। অল্প কয়েক বৎসর হইল ইহারও মৃত্যু হইয়াছে। শিবচন্দ্র ন্যায়পঞ্চানন শিবচন্দ্র ন্যায়পঞ্চাননের জন্মভূমি বাণিয়াচঙ্গ। বাণিয়াচঙ্গের জাতুকৰ্ণ গোত্রীয় ব্রাহ্মণকুলে তাহার উদ্ভব হয়। ইদানীন্তন কালে ইনি একজন সুবিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। “ন্যায়, স্মৃতি, ব্যাকরণ, পুরাণ, সাহিত্য প্রভৃতি প্রায় প্রত্যেক বিভাগেই তাহার তুল্য এবং প্রগাঢ় অধিকার ছিল। এতদ্ব্যতীত ধৰ্ম্ম-ক্রিয়ানুষ্ঠান জ্যোতিষ গণনা, গদ্য পদ্য সংস্কৃত রচনা ইত্যাদি বিষয়েও তিনি প্রধান শ্রেণীতে আসন পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি অতিশয় তীক্ষবুদ্ধি ও মেধাবী ছিলেন।” "প্রাচীন বয়সে নিজ পরিবারস্থ ছেলেদিগকে ইংরেজী স্কুলে পড়াইতে দিয়া তিনি নিজে উহাদের অধ্যয়ন পরীক্ষাচ্ছলে, ইংরেজী, ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক, জ্যামিতি ইত্যাদিতেও বিশেষ ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। সামাজিক এমন অনেক ব্যবহার আছে, যাহা কেবল শাস্ত্রদ্রষ্টা দ্বারা মীমাংসা হয় না, ঐ সকল বিষয়ে তাহার নিকট এমন সদুপদেশ ও মীমাংসা পাওয়া যাইত, যাহাতে ব্যক্তিমাত্রেই তদীয় প্রখর বুদ্ধিকে ধন্যবাদ না দিয়া পারিতেন না।"