পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 হ্যাঁ, সংস্কৃতি-সেনানী আসলে ভাবাদর্শের যোদ্ধা। সাংস্কৃতিক সংগ্রাম সৃষ্টির সংগ্রাম, পুনর্নির্মাণের সংগ্রাম। শ্রেণীশক্তিগুলির পুনর্বিন্যাসের দিনগুলিতে সংস্কৃতি-সেনানী আলোকস্তম্ভ হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিপূরক মাত্র নন তিনি। এই নিরিখে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো কবির কৃতিকে পুনঃপাঠ করতে পারি আজ। সময়ের কয়েকটি জটিল সন্ধিক্ষণে তারা মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণের প্রস্তাবনাই করেছিলেন। তাদের অবদানকে আলোচকেরা যেভাবেই বিশ্লেষণ করুন না কেন, সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শের নিরন্তর পুনর্বিন্যাসই ছিল তাদের লক্ষ্য। পথ ও পাথেয়র স্বাতন্ত্র্য তাদের নিজ-নিজ ক্ষেত্রে অনন্য করে তুলেছে। প্রথাগত দৃষ্টিকোন থেকে তাদের যদি না-দেখি, আজকের সংশয়-ধূসর প্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ভিন্নতর দ্যোতনা আবিষ্কার করতে পারব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন লেখককে ‘নিছক কলম-পেষা মজুর’ বলেছেন, তেমনই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের সংস্কৃতি-শ্রমিক বলতে পারি। এই শ্রমিক যেহেতু সংগ্রামী, তিনি যোদ্ধা-শ্রমিক। আর, যুদ্ধ মানে যুদ্ধের আয়ুধ-যুদ্ধক্ষেত্র-যুদ্ধের লক্ষ্য-যুদ্ধকৌশল-প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সতর্ক ও অবহিত হওয়া। অর্থাৎ ভাবাদর্শের দৃঢ় ভিত্তিতে অবিচল থাকা।

 নিজস্ব ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা প্রশ্নাতীত। মতান্ধতা কখনও কখনও আন্দোলনের স্বভাবকে আচ্ছন্ন ও গতিকে ব্যাহত করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত নিজের পথ ধরেই তাকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতের উচ্চাবচতা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার কৌশল মাঝে মাঝে বদলে নিতে হয় যদিও, ব্যবহারিক রাজনীতির লেজুড় তা নয় কখনও। অমোঘ শ্রেণী-বাস্তবতা অবশ্যই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও প্রকরণের নিয়ামক, কিন্তু তার পুষ্টি ও প্রকাশের পথ আলাদা। না-লিখলেও চলে যে ভাবাদর্শের প্রতি আনুগত্য মতান্ধতা এক কথা নয়। যদিও আধিপত্যবাদীরা এই দুটোকে এক করে দেখাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। সংস্কৃতি-কর্মী চক্ষুষ্মন, তিনি অন্ধ নন। তার সার্থকতা নির্ভর করে কল্পনাশক্তি ও অন্তদৃষ্টির ওপর। সাংস্কৃতিক সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য কী, তা যদি একটু ভাবি, দেখব, গণতান্ত্রিক চেতনা উজ্জীবনের লক্ষ্যে এবং ইতিবাচক চিন্তার পরিসরকে যতদূর সম্ভব ব্যাপক করার স্বার্থে সমাজের সমস্ত উদ্যোগী, সৃষ্টিশীল ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে পৌছানোই তার অন্বিষ্ট। এটা ঠিক, বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও সংশয় ও দ্বিধাজনিত দোলাচল কাটিয়ে উঠতে পারেন না। তাদের পিছুটান গুলিকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে একমাত্র যথার্থ ভাবাদর্শ-সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং এভাবেই প্রগতি-শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে।

 শ্রেণী-চেতনায় অবিচল থেকেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি-সেনানীরা যদি সৃষ্টিশীল, কল্পনা-সমৃদ্ধ ও স্বতন্ত্র না হতে পারেন—তাহলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে না। এইজন্যে অন্য গণ-সংগঠন পরিচালনার কৌশল দিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনকে

১২৫