পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মূল গ্রিক শব্দের পূর্বপদ এই দৃষ্টির ক্রিয়া বোঝায় আর প্রত্যয়-সূচক উত্তরপদ বোঝায় means, instrument or place। এভাবে ভাষার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতধর্মিতায় চেতনার উন্মেষপর্ব থেকে বিশিষ্ট দৃষ্টিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তত্ত্ব বা Theory-র অব্যাহত যাত্রা কোনো নতুন কথা নয়। গত ত্রিশ বা চল্লিশ বছরে যদি তাত্ত্বিক প্রতিবেদনের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব খুব বেশি মাত্রায় লক্ষ্যগোচর হয়ে থাকে, এর মানে নিশ্চয় এই নয় যে এ কোনো নতুন প্রবণতা। মানুষ যেদিন থেকে অস্তিত্ব ও জগতের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে সচেতন হয়েছে, সেদিন থেকেই তত্ত্বেরও সূচনা হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ যদি কেউ ঘুম ভেঙে উঠে বলেন, এসব তত্ত্বত্ত্ব আবার কেন—তাহলে তিনি আত্মপ্রতারণা করছেন মাত্র।

 যাঁরা খুব বিজ্ঞের মতো গাছ আগে না ফল আগে’ গোছের যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আগে সাহিত্য পরে তত্ত্ব কিংবা আগে সমাজ পরে তত্ত্ব (অথবা আগে অভিজ্ঞতা পরে উপলব্ধির সূত্র) তারা শুধু বিভ্রান্তি ছড়ান। যেখানে কোনো বিভাজন নেই, সেখানে জলবিভাজন রেখা কল্পনা করে তারা নিজেদের চিন্তাদৈন্য ও অগভীরতাকে ধরিয়ে দেন মাত্র। এঁদের অধিকাংশ জেগে-জেগে ঘুমোন বলে তাঁদের ঘুম কেউ ভাঙাতে পারে না। যদি কেউ বুঝব না’ বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে থাকেন, তাকে বোঝাবে কে? আসলে এই বোঝা এবং না-বোঝার ব্যাপারটাও পুরোপুরি অভ্যাসের বিষয়। যেভাবে ভাবতে এবং বুঝতে আমরা বহু প্রজন্ম ধরে অভ্যস্ত, তাতে কোনো ছেদ ঘটলে বা ব্যতিক্রম হলে সমস্ত বোধ তোলপাড় করে প্রত্যাখ্যানের জেদ দেখা দেয়। যা কিছু অভ্যাসের বাইরে, তাকেই সন্দেহের চোখে দেখে অধিকাংশ মানুষ। স্বভাবত সাবধানী মন অতি সতর্কতাবশত ভেবে নেয়, নিয়ম মাফিক কিছু না হলেই বিপত্তির আশঙ্কা। এর চেয়ে ভালো স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপদ সরলীকৃত পথে চলা। সময়ের রূপান্তর এহেন চিত্তবৃত্তিতে কথার কথা মাত্র, চোখের সামনে চেনা-জানা জগৎ অপরিচিত হয়ে গেলেও কিছুতেই স্বেচ্ছাবৃত বৃত্তবন্দিত্ব থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চায় না। একটি বিখ্যাত সংস্কৃত শ্লোকের কথা মনে পড়ছে:

তাতস্য জলোয় ইতি ক্রবাণাঃ।
ক্ষারং জলং কাপুরুষাঃ পিবন্তি।।

 তার মানে, ‘এ আমার পিতৃপুরুষের তৈরি কুয়ো, এই বলে দূষিত কুয়োর জল কাপুরুষেরাই খেয়ে নেয়। বলা বাহুল্য, কাপুরুষ বলতে এখানে গোঁয়ার-গোবিন্দ, মূর্খ অবিবেচকদেরই বোঝানো হচ্ছে।

 জীবনের সর্বস্তরে এখন মুহুর্মুহু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মহাকাশ-প্রযুক্তির কল্যাণে একদিকে ইণ্টারনেট এবং অন্যদিকে দূরদর্শনের অজস্র চ্যানেলে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য ও বিনোদন হাতের মুঠোয় এসে গেছে। বিশ্বায়নের নামে নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভোগবাদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আমাদের চিন্তাচেতনা আজ দুমড়ে মুচড়ে

১৫৪