পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাঁর পক্ষে ভেঙে ফেলা সম্ভবই হত না যদি তিনি প্রতীচ্যের চেতনাবিশ্বকে অস্বীকার করতেন। আসলে প্রতিভার অভিজ্ঞানই হল সংশ্লেষণের ক্ষমতা।

 গোটা বিশ শতক জুড়ে আমরা বারবার দেখলাম, সাহিত্যের অন্তর্বস্তু ও আঙ্গিক পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথ ধরে এগিয়ে যেতে চাইছে। সর্বদা এই উদ্যম যে সফল হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তবুও অব্যাহত থাকছে নিরবচ্ছিন্ন আত্মবিনির্মাণ। এই অসংখ্যবার বাঁক ফেরার পেছনে কিন্তু রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বপরিসর থেকে অনবরত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আত্তীকরণের প্রবণতা। চিন্তায় যখনই নতুন বিভঙ্গ তৈরি হচ্ছে, সাহিত্যে তার অভিঘাত অনিবার্যভাবে এসে পড়ছে। বাঙালির মনন পর্বে-পর্বান্তরে নতুন নতুন তত্ত্ব-প্রস্থান থেকে আধেয় সংগ্রহ করে গেছে বলেই স্রোত সরে গিয়ে চরভূমি বড়ো হয়ে দেখা দেয়নি। কোনো সন্দেহ নেই যে চিন্তা-প্রবাহকে সঞ্জীবিত করার জন্যে বহির্জগৎ থেকে নিয়মিত নতুন নতুন উপকরণের যোগান চাই। অন্তত বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক পাঠ-অভিজ্ঞতা এই সিদ্ধান্তকে অনিবার্য করে তোলে। বিশ শতকের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক প্রেরণাকে নানা মাত্রায় শুষে নিয়ে বাঙালির সৃষ্টিশীলতা এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে পরিক্রমা করেছে। মার্ক্সবাদ-অস্তিত্ববাদ - পরাবাস্তববাদ থেকে শুরু করে হাল আমলের আকরণবাদ-আকরণোত্তরবাদ-নারীচেতনাবাদ-উপনিবেশোত্তর চেতনাবাদ ওই পরিক্রমায় কত বিচিত্র ধুপছায়া ও উচ্চাবচতা এনে দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রণালীবদ্ধ বিশ্লেষণ ছাড়া এত অজস্র তত্ত্ববীজের অঙ্কুরোদ্গম ও পুষ্পয়ন সম্পর্কে যথার্থ ধারণা করা অসম্ভব।

 সাহিত্যতত্ত্ব জীবনের বাইরে যেতে পারে না কখননা। জীবনতত্ত্ব আর সাহিত্যতত্ত্ব একই সত্যের দু-রকম উপলব্ধি মাত্র; জীবনে যা কিছু ঘটে এবং সাহিত্যিক প্রতিবেদনে যা কিছু প্রকাশিত হয়, সমস্তই কোনো-না-কোনো তত্ত্বের পুষ্টিদান করে। জীবনে তত্ত্ব মিশে থাকে জলে মাছের মতো। তেমনি সাহিত্যে তত্ত্ব থাকে ধমনীতে রক্ত-প্রবাহের মতো কিম্বা জৈব অস্তিত্বে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। অর্থাৎ তত্ত্বের অন্তবৃত অস্তিত্ব বুঝে নিতে হয় স্বভাবের পথে। তাই কোথাও যদি সামঞ্জস্য ব্যাহত হয় বা আতিশয্য প্রকট হয়ে পড়ে, তাতে তাত্ত্বিক বিন্যাসের সৌন্দর্য ও মহিমা ক্ষুন্ন হয়। সুতরাং সাহিত্যতত্ত্বের সার্থক অভিব্যক্তি বা অনুশীলন কখনো সামঞ্জস্যবোধকে পীড়িত করতে পারে না। কিন্তু যারা এই বিষয়টিকে গভীরভাবে বুঝতে চান, তাদের জন্যে রয়েছে আবশ্যিক কিছু শর্ত!প্রণালীবদ্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ছাড়া জীবন থেকে উৎসারিত সাহিত্যতত্ত্বের গভীরে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় না। এই উপলব্ধি অর্জনের জন্যে কোনো সরলীকৃত সহজিয়া মার্গ নেই।

 আরও একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। তত্ত্বের অনুধাবন মানে জীবনের অনুধাবন আর জীবনের অনুধাবন মানে সময়-চিহ্নিত পরিসরের অনুধাবন। এইজন্যে কোনো সাহিত্যতত্ত্বই সময় ও পরিসর নিরপেক্ষ নয়। ফলে বিবর্তনশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কোনো বিশিষ্ট সাহিত্যতত্ত্বের উদয়, বিকাশ ও অস্তকে বুঝে নিতে

১৫৭