পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বল্মীকস্তূপ ফুঁড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। আর, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেইসব নির্মানবায়নের প্রবণতাকে উপেক্ষা করে বহুধা-বিপন্ন মানুষেরই পাশে দাঁড়াচ্ছে। কেননা নয়া ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিকার সংক্রমণকে প্রতিহত করার জন্যে এটাই সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। কিন্তু বাংলাকে অবশ্যই সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে তার আপন ভাষা-অভিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই সময়ের প্রকৃত সত্যকে ধারণ করতে হবে। কথাটা এইজন্যেই জরুরি যে সময়েরও আছে অজস্র আপাত-রূপ অর্থাৎ সত্যভ্রমের চতুর আয়োজন। এই আয়োজন আসলে মেধাবী প্রকাশের নামে নির্মননের সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিকতার পূর্বধার্য ভঙ্গির নামে জাতীয় সত্তার শিকড় উৎপাটন। রাজনৈতিক ভূগোলের চাপ যত বেশিই হোক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরম্পরা তাতে আচ্ছন্ন হতে পারে না। আমাদের যৌথ ভাবনা-প্রতিভার অজস্র মোটিফে ও আর্কেণ্টাইপে, অনুপুখে ও মেটা ন্যারেটিভে উচ্চাবচতাময় অভিজ্ঞতার বিবরণে ও অন্তরীকৃত উদ্ভাসনে আমরা জেনে এবং না-জেনে অভিব্যক্তির ঐতিহ্যকে সম্প্রসারিত করে চলেছি। এর কোনও ব্যত্যয় হতে পারে না; যদি হয়, তা আর যা-ই হোক, বাঙালির সার্বিক চেতনাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আপাত-সময়ের বর্নিল আরাখায় যাঁরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, প্রাগুক্ত মৌলিক সত্যটি তাদের যেন স্বধর্মে ফিরিয়ে আনে।

 পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে-সমস্ত উপভাষাভাষী বাঙালিরা আছেন, ইতিহাস তাঁদের ভূগোলকে কতখানি ছিন্নমূল করে দিয়েছে, বাংলা ভাষার অন্য শরিকেরা ভুলেও কখনও সেইসব কথা ভাবেন না। কিন্তু সেইসব অঞ্চলের আলো হাওয়া রোদেও আছে নিজস্ব ছন্দ নয়, আছে জমি ও আকাশের দ্বিরালাপ, আছে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ভরা পিপাসা না-ফুরোনোর যন্ত্রণা, আছে বৃত্তবন্দি অস্তিত্বের আর্তনাদ এবং ঘটাকাশের শর্ত পূরণ করেও দূরবর্তী কোনও মহাকাশের জন্য তৃষ্ণা। আছে রিক্ততা ও সীমাবদ্ধতার বোধ পেরিয়ে যাওয়ার জন্যে আরোপিত মননমুদ্রাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে তথাকথিত মূলস্রোতের পঙক্তিভুক্ত হওয়ার জন্যে অপ্রকাশ্য ব্যাকুলতা। আছে মন্থর সমাজের সঙ্গে অনন্বয়-ক্লিষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব চক্রব্যুহ রচনা। এই উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে ভৌগোলিকভাবে বহুদূরে বসবাসকারী কোনও কবি যখন লেখেন:

‘আমি আজ চূড়ান্ত চিনি না
চিনিনা মানুষ। মরুভূমি
কাকে বলে? কাকে বলে ভূমি?
ভূমি যাকে আমার চাবুকে
বিক্ষত করেছি? আমি চিনি?
আমি চিনি না; কে আকাশ,
কে গাছ, কে গর্দভ, কার পিঠে
আঁকা ভারতের রেলপথ।’

(বাড়ি থেকে পালিয়ে)
১৮১