পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একটু সন্দেহ ছিল-কারণ তহির মগজকোষটি বানরের চাইতে অনেকটা বড়ো হইলেও আজকালকার সভ্য মানুষের তুলনায় খুবই ছোটো এবং কপালটাও বানরের মতো চ্যাপটা। তাহার দুইটা দাঁত পাওয়া গিয়াছিল, সে দুইটা দেখিলে গরিলার দাঁতের কথাই মনে হয়। কিন্তু তাহার উরুর হাড় দেখিয়া স্পষ্ট বোঝা গেল যে সে মানুষের মতো খাড়া হইয়া চলিত। এই প্রাচীন মানুষটির অর্থাৎ জন্তুটির নাম দেওয়া হইয়াছে বানর-মানুষ। ইহার চাইতে প্রাচীন কোনো মানুষের কংকাল আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

 ইউরোপে সেকালের মানুষের যে-সকল চিহ্ন পাওয়া যায়, এই বানর-মানুষের তুলনায় তাহাদের খুব প্রাচীন বলা চলে না। কিন্তু তাহারাও এক-একজন প্রায় পাঁচলক্ষ বৎসর আগেকার মানুষ। ধনুকের মতো বাঁকা ছোটো-ছোটো পা, বানরের মতো উঁচু-উঁচু ভ্রূ, একটু-আধটু কথা বলিতে পারে সেই-সব মানুষ এখন পৃথিবী হইতে লোপ পাইয়াছে। এই-সব মানুষের চেহারা কেমন ছিল তাহা এই-সকল কংকাল হইতেই কতকটা বোঝা যায়।

 মানুষ যখন সভ্য হয় নাই, যখন সে অস্ত্র গড়িতে বা আগুন জ্বালাইতে শিখে নাই, তাহারও অনেক আগে সে এমন একটি বিদ্যা শিখিয়াছিল যাহা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পশুর জানা নাই। সেই বিদ্যাটি খাড়া হইয়া চলিবার বিদ্যা। কেবলমাত্র পায়ের সাহায্যেই যখন সে চলিতে শিখিল তখন হইতে তাহার হাত দুইটা ছাড়া পাইল। সেই সময় হইতে সে হাত দুটাকে যে কতরকম কাজে লাগাইয়াছে এবং কত কৌশল শিখিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই।

 সেই-সব মানুষেরা যে-সকল চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে পরিষ্কার দেখা যায় যে, হাতের ওস্তাদি কেমন করিয়া যুগের পর যুগ বাড়িয়া চলিয়াছে। প্রথম যে মানুষ অস্ত্রের ব্যবহার করিতে শিখে, তাহার অস্ত্র ছিল গাছপাথর জানোয়ারের শিং ও হাড়। এই অতি প্রাচীন মানুষটি যদি অস্ত্রশস্ত্রের আরো উন্নতি করিতে পারিত, তবে হয়তো সে আরো কিছুকাল টিকিয়া থাকিত। কিন্তু পাথরের অস্ত্রওয়ালা মানুষের সঙ্গে সে পাল্লা দিয়া পারে নাই। প্রাচীনকালের নানারকম পাথরের অস্ত্র পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই পাওয়া গিয়াছে। সবচাইতে পুরানো যেগুলি সেগুলিকে হঠাৎ দেখিয়া অন্ত্র বলিয়া বুঝা যায় না, কারণ সে সময়ে এক-এক টুকরা পাথরকে ঠুকিয়া ঠুকিয়া নিতান্তই মোটা রকমের উবড়োখবড়ো অস্ত্র গড়া হইত। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এইরকম অস্ত্রের সাহায্যে তাহারা পৃথিবীতে শিকার করিয়া ফিরিয়াছিল। যে-সকল পর্বতে গুহায় তাহারা বাস করিত সেই গুহার মধ্যে পাথরে আঁচড় কাটিয়া তাহারা যে-সকল ছবি আঁকিত, তাহারও চিহ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে। সেই ছবিগুলি দেখিলে তোমরা হয়তো হাসিবে-কারণ আজকালকার পাঁচ-সাত বৎসরের শিশুও অমন ছবি আঁকিতে পারে। কিন্তু পণ্ডিতেরা এই-সমস্ত ছবি দেখিয়া সেই গুহাবাসী মানুষদের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য খবর জানিতে পারিয়াছেন। এই মানুষদের গায়ে লম্বা লম্বা লোম হইত, তাহাদের চেহারা ছিল কতকটা এস্কিমোদের মতো, তাহারা চাষবাস জানিত না, বেদে জাতির মতো নানা স্থানে ঘুরিত আর দল বাঁধিয়া শিকার করিত। সম্ভবত ইহাদের অনেকেই কাঁচা মাংস খাইত

নানা নিবন্ধ
২২৩