পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুধু হাওয়া খেয়ে থাকে। এরকম বিশ্বাসের কারণ এই যে, বহুরূপী একে তো খায় খুবই কম, তার উপর খাওয়া কাজটি তার চক্ষের নিমেষে এমন চট্‌পট্ শেষ হয়ে যায় যে, একটু ঠাওর করে না দেখলে অনেক সময় বোঝাই যায় না। যতটুকু প্রাণী, জিভটি প্রায় ততখানি লম্বা; সেই জিভটি তীরের মতো ছিটকিয়ে পোকামাকড়ের উপরে পড়ে আর পরক্ষণেই টপ করে মুখের ভিতর ফিরে যায়। এর মধ্যে যে শিকার ধরা, শিকার মারা এবং খাওয়া, এই তিন কাজ শেষ হয়ে গেছে—সেটা বুঝতে অনেক সময় দেরি লাগে।

 বহুরূপীর আর-একটি অদ্ভুত জিনিস তার চোখ দুটি। বড়ো-বড়ো চোখ দুটি এমনভাবে তৈরি যে একবার চোখ পাকালেই উপর নীচ ডাইনে বাঁয়ে ডাঙা এবং আকাশের প্রায় সব খানিই বেশ দেখে নিতে পারে। তার উপর দুইটা চোখ একেবারে আলগাভাবে গাঁথা। একটা যখন সামনের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে, আর-একটা হয়তো ততক্ষণ চারিদিক ঘুরে ঘুরে ঘরবাড়ি গাছপালা সব তদ্‌বির করছে।

 আর আছে বৃদ্ধ জরদ্গবের মতো এক জন্ত-আমেরিকার গেছো-গিরগিটি। গিরগিটি বললাম বটে কিন্তু গোসাপ বললেও চলত, কারণ এর এক-একটি নাকি প্রায় সাড়ে তিন হাত পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা গিয়েছে। গলায় গলকম্বল, পিঠে সাংঘাতিক কাঁটা, তার উপর কোনো কোনোটার গায়ে মাথায় বড়ো-বড়ো আঁচিল, তাতে চেহারাটা কেমন কিম্ভুতকিমাকার হয় তা সহজেই কল্পনা করতে পার।

 খাঁটি গোসাপ-জাতীয় জন্তু আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। 'হিংস্র’ বলতে যা বোঝায় গোসাপেরা ঠিক তা নয় কিন্তু একবার গো ধরলে সেও ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশে কথায় বলে 'কচ্ছপের কামড়', সাহেবেরা বলেন ‘বুলডগের কামড়'—কিন্তু গোসাপ ক্ষেপলে পরে তার কামড় ছাড়ানোও বড় কম শক্ত নয়। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে যে, গিরগিটিটাকে খুব বড়ো করতে পারলেই বুঝি ঠিক গোসাপ হয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু বাস্তবিক গিরগিটি আর গোসাপের গড়নে কিছু তফাত আছে। গোসাপের ঘাড়টা অনেকটা লম্বা গোছের, আর তার জিভটা সাপের মতো চেরা, চলতে ফিরতে লকলক করে। গোসাপেরা আমিষ-খোর, সাপ, টিকটিকি, ইঁদুর, ব্যাঙ, পাখি, এই-সব খেয়ে থাকে-তাদের বিশেষ প্রিয় খাদ্য নাকি কুমিরের ডিম। আমাদের দেশে গোসাপ ডাঙায়ও থাকে জলেও নামে, তাই সাঁতারের সবিধার জন্য তাদের ল্যাজগুলি চ্যাটাল হয়। যে-সব গোসাপ কেবল শুকনো ডাঙায় বা গাছে থাকে, তাদের ল্যাজ হয় চাবুকের মতো গোল।

 আরেকরকমের জন্তু রয়েছে যার গায়ে চক্র চক্র দাগ, সেটি হচ্ছে মেক্সিকোর ‘বীভৎস গিলা’ (gila monster) বা বিষধর গিরগিটি। ছোটো ছোটো পা, তাতে শরীরটা মাটি থেকে আলগাই হয় না—তাকে সাপের মতো এঁকে বেঁকে মাটি ঘষে চলতে হয়। ছোট্টো দুটি চোখ, মুখভরা দাগের মধ্যে চট করে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। দুম্বা ভেড়ার মতো ল্যাজটি চর্বিতে ভরা। যখন খাবার জোটে না, তখন ঐ ল্যাজটা শুকিয়ে আসে, ল্যাজের চর্বি সমস্ত শরীরে শুষে গিয়ে শরীরটাকে তাজা রাখে। কিন্তু আসল দেখবার জিনিসটা ওর মুখের মধ্যে। সেখানে যদি খোঁজ করো তবে দেখবে, ঠিক সাপের মতো তার বিষদাঁত রয়েছে। সে বিষে ছোটোখাটো জন্তু বা পাখি তো মরেই, মানুষ পর্যন্ত মারা গেছে বলে শোনা যায়।

জীবজন্তুর কথা
৩২৫