পাতা:স্বদেশ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

АЭ а স্বদেশ থাকিতে হয়, তাহাতে তাহাদের নির্জনত্বের সহজ অধিকার, একাকিত্বের আব্রুটুকু থাকে না। না থাকে স্থানের অবকাশ, না থাকে কালের অবকাশ, না থাকে ধ্যানের অবকাশ । এইরূপে নিজের সঙ্গ নিজের কাছে অত্যস্ত অনভ্যস্ত হইয়া পড়াতে, কাজের একটু ফাক হইলেই মদ খাইয়া, প্রমোদে মাতিয়া, বলপূর্বক নিজের হাত হইতে নিস্কৃতি পাইবার চেষ্টা ঘটে । নীরব থাকিবার, স্তব্ধ থাকিবার, আনন্দে থাকিবার সাধ্য আর কাহারো থাকে না । যাহারা শ্রমজীবী তাহাদের এই দশা । যাহারা ভোগী তাহারা ভোগের নব নব উত্তেজনায় ক্লান্ত । নিমন্ত্রণ খেলা নৃত্য ঘোড়দৌড় শিকার ভ্রমণের ঝড়ের মুখে শুষ্কপত্রের মতো দিনরাত্রি তাহারা নিজেকে আবর্তিত করিয়া বেড়ায় । ঘূর্ণাগতির মধ্যে কেহ কখনো নিজেকে এবং জগৎকে ঠিক ভাবে দেখিতে পায় না, সমস্তই অত্যন্ত ঝাপসা দেখে। যদি এক মুহুর্তের জন্য তাহার প্রমোদচক্ৰ থামিয়া যায় তবে সেই ক্ষণকালের জন্য নিজের সহিত সাক্ষাৎকার, বৃহৎ জগতের সহিত মিলনলাভ তাহার পক্ষে অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয় । ভারতবর্ষ ভোগের নিবিড়তাকে আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া লঘু করিয়া দিয়াছে, এবং কর্মের জটিলতাকেও সরল করিয়া আনিয়া মাতুষে মানুষে ৰিভক্ত করিয়া দিয়াছে। ইহাতে ভোগে কর্মে এবং ধ্যানে প্রত্যেকেরই মনুষ্যত্বচর্চার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। ব্যবসায়ী সেও মন দিয়া কথকতা শোনে, ক্রিয়াকর্ম করে ; শিল্পী সেও নিশ্চিন্তমনে সুর করিয়া রামায়ণ পড়ে। এই অবকাশের বিস্তারে গৃহকে মনকে সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প হইতে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করিয়া রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করিয়া রাখে না,এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশেই জমিতে দেয় না। পরস্পরের কাড়াকড়িতে ঘে বাঘেষিতে যে রিপুর দাবানল জলিয়া উঠে, ভারতবর্ষে তাহা প্রশমিত থাকে।