পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বপ্নবাণী কৃষ্ণলালের অনুবৰ্ত্তী অতিথি দুই জন মধ্যদ্বারপথে উপবেশন-গৃহে সমাগত হইলেন । এই সরল সুন্দর অথচ অনাড়ম্বর গৃহ-সজ্জা দেখিয়া নবাগত অতিথি রাজা অতুলেশ্বর মনে মনে গৃহকত্রীর রুচির প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারিলেন না । • শুমাচরণ এখানে আসিয়াই অন্তঃপুরিকাগণের সছিত প্রথমে দেখা করিতে গেলেন এবং সেখানে প্রণাম-সম্ভাষণাদি শেষ করিয়া দিদিমা ও হাসিকে লইয়া পুনরায় দালানে প্রবেশ করিলেন। অন্ত:পুরের ভোঁজে পরিবেষণ করা দিদিমার একটি কর্তব্য কাজ ছিল। গৃহিণী দ্বারান্তরালে আসিয়া উকি দিতে লাগিলেন। রাজা তখন চিত্ৰলেখ্য দেখিতেছিলেন, ফিরিয়া দাড়াইবামাত্র শুামাচরণ দিদিমার দিকে দৃষ্টিনির্দেশ করিয়া তাহাকে কহিলেন, “ইনি কৃষ্ণলালের মাতা, আর এই আমাদের হাসি—ওরফে স্বগুণ। প্রণাম কর মা একে,”— হাসি তৎক্ষণাৎ মুখভর হাসি হাসিয়া ভূ-নত হইল । রাজা ব্যতিব্যস্ত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, *করেন কি,—করেন কি ?” কিন্তু তাহার মুখের কথা মুখে শেষ হইতে না হইতে হাসি পদধূলি গ্রহণ পুৰ্ব্বক উঠিয়া দাড়াইল । আজ পুরাতন ফ্যাসানের ঝাড় লণ্ঠন এবং দেয়ালগিরির মধ্যে বিজুলী বাতি জলিতেছিল । হাসি প্রণামান্তে উঠিয়া চকিত দৃষ্টিদানে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার স্তায় উজ্জ্বল সেই আলোকে রাজাকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়া লইল । “এ কি, রাজকুমার অনাদি-দা নাকি ?” সেই দিন হইতে হাসি ইহাকে এই নামেই স্মরণ করে। সে দিন দূর হইতে র্যাহার প্রতিবিম্ব মাত্র দেখিয়াছিল, আজ র্তাহার প্রকৃত রূপ দেখিয়া স্তম্ভিত হইল ! এ ত অল্পবয়স্ক যুবকের মূৰ্ত্তি নহে । ইনি যে মহামহিম জ্যোতিৰ্ম্ময় পুরুষ । কি সৌম্য মুন্দর ! হাসির কল্পনা প্রকৃতের নিকট পয়াজয় মানিল । বস্তুতঃই রাজা আদর্শ স্বপুরুষ ;-চিত্রাঙ্কন তুল্য এমন সৰ্ব্বাঙ্গ-ম্বন্দর মূৰ্ত্তি কদাচিৎ নয়নে পড়ে । র্তাহার বর্ণ ইরাণীর স্তায় স্বর্ণপ্রভ, ক্ষুরধারমুণ্ডিত শ্মশ্রহীন পরিষ্কার মুখশ্ৰী রমণীর স্তায় কমনীয়, দেহ স্বগঠিত,অঙ্গুলিগুলি পৰ্য্যন্ত চম্পককোরক তুল্য স্থঠাম —এমন কি কেশরাশিও রেশম-কোমল লালিত্যপূর্ণ। তাহার ললাট বুদ্ধিবৃহৎ, নয়ন ভাবজ্যোতিঃপূর্ণ এবং ওষ্ঠাধর কারুণ্যরেখা-গঠিত। এই ত্রিভাবের সম্মিলনে তাহার রাজজনোচিত গাম্ভীৰ্য্য ఏసిపి কবি-জনোচিত সরল মাধুর্য্যে এমন স্নিগ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল যে, বয়সে তিনি চল্লিশের কাছাকাছি হইলেও তাহাকে দেখিতে পয়ত্ৰিশের অধিক দেখাইত না । রাজাকে একবার দেখিলে নয়ন পুনঃ পুনঃ সেই দিকে আকৃষ্ট হইত " বলা বাহুল্য, দিদিমাও তাচার রূপে মুগ্ধ হইলেন। রাজা তাহাকে প্রণাম করিবার পর প্রসন্নচিত্তে তিনি কহিলেন, “মঙ্গল হোক ৷” তাহার পর শুiমাচরণের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কে হন ইনি শুমাচরণ ? পুৰ্ব্বে ত একে দেখি নি।” আত্ম-পরিচয়-দানে ইহাদের ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিতে রাজার ইচ্ছা ছিল না, তাই আগে হইতেই এ সম্বন্ধে শু্যামাচরণকে তিনি সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন। দিদিমার প্রশ্নের উত্তরে শু্যামাচরণ কহিলেন, “ইনি দূর সম্পর্কে আমার একরূপ ভাই হন,--নাম অতুল রায়, বিদেশেই বাস করেন, কার্য্যোপলক্ষে কলকাতায় এসে আমার ওখানেই উঠেছেন ৷” “অতুল রায় ?” দিদিমা একটু ভাবিয়া বলিলেন, "নিখিল রায়ের কেউ হন কি ইনি ? তিনি সম্পর্কে আমার ভাই-পো হন ।” রাজা একটু হাসিয়া কহিলেন, “রায়ে রায়ে একটা সম্পর্ক খুজে পাওয়া অসম্ভব নয়। আমাকেও না হয় ভ্রাতুপুত্ৰ ব’লেই মনে করবেন " কথাটি দিদিমার বড় মিষ্ট লাগিল। কৃষ্ণলাল মাতার কথার প্রতিবাদপূর্বক কহিলেন, "নিখিল রায় তোমার ভাই পো—না আমার ভাই পো ? তার ছেলে আমাকে ত দাদা দাদা করে ।” দিদিমা বলিয়া উঠিলেন, “হ্যা, তাই ত ঠিক । আর বাবা, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি—অত শত মনে রাখতে পারিনে " রাজা হাসিয়া কহিলেন, “ত হ’লে আপনারা সকলেই আমাকে স্নেহ-চক্ষে দেখবেন ।” তাহার মধুর সৌজন্তে মাতা-পুত্র উভয়েই আপ্যায়িত্ত হইলেন। ব্রাহ্মণ ভৃত্য প্রায় তখনি যবনিকান্তরাল হইতে জানাইয়া দিল যে— আহাৰ্য্য প্রস্তুত । দিদিমার অসুবৰ্ত্তিতায় সকলে ভোজন-গৃহে উপনীত হইলেন । দ্বাদশ পরিচ্ছেদ আজ-কাল বাঙ্গালী ধনী-গৃহে বিবাহভোজ অপেক্ষ আশীৰ্ব্বাদভোজে খাদ্যোপকরণের অধিক