পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মিলন-রাত্রি ά সমগ্র বাঙ্গালার নেতৃবৃন্দ সদলবলে প্রসাদপুরে সমাগত। কাল কনফারেন্স বসিবে, আজি ক্লাউডেন সাহেবের স্থলভুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেট প্রচারপত্র দ্বারা হুকুম দিলেন যে, মিছিলে বা সভায় কেহ “বন্দে মাতরম্ উচ্চারণ করিতে পরিবে না । ভারতীয় শাসননীতির বিরুদ্ধে কিছু দিন হইতে জনসজেঘর মনে যে অসন্তোষ-বহ্নি প্রচ্ছন্নভাবে ধূমায়িত হইতেছিল, বঙ্গ-বিভাগের দ্বারা তাহা প্রজ্জ্বলন্ত আকারে বহির্বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। দেশের আবহাওয়া এখন অশান্তি-চাঞ্চল্যপূর্ণ। পক্ষপাতময় শাসননীতি ভঙ্গ করিবার অভিপ্রায়ে ছেলের দল বিশেষভাবে বদ্ধপরিকর। তাহারা প্রাণের মায়াহীন ; সম্ভব অসম্ভব হিতাহিত জ্ঞানশূন্ত ; জননী জন্মভূমির শৃঙ্খলমোচনজঙ্গ নিজের শৃঙ্খল পরিতে বা প্রাণ দিতে কিছুমাত্র কাতর নহে । মায়ের নামে যাত্রা করিয়া, তরঙ্গসস্কুল বিপদসমুদ্রে দোঙ্গুল্যমান নৌকায় পা দিয়া তাহারা দাড়াইয়াছে, কিন্তু তরণী নাবিকহীন ; কর্ণধারের জন্য উদগ্রীব তাহারা যাহাকেই সম্মুখে দেখিতেছে, তাহাকেই গুরু বলিয়া ডাকিতেছে। ম্যাজিষ্ট্রেটের পুৰ্ব্বোক্ত অন্যায় আদেশে যুবকদিগের ক্রোধতপ্ত শোণিত তাপমান-যন্ত্রের উৰ্দ্ধসীমায় আসিয়া পৌছিল ; নেতৃবর্গের নিকট হইতে শীতল পানীয়ের ব্যবস্থা লাভ জন্ত র্তাহাদিগের মূপের দিকে তাহার। চাহিয়া রহিল । বলা বাহুল্য, নেতৃগণও যথেষ্ট উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন । কিন্তু র্তাহাবা বিবেচনাশক্তি হীরাইলেন না। পরামর্শ-সভায় স্থির হইল যে, গভর্ণমেণ্ট স্বয়ং যতক্ষণ আইন-প্রবর্তন দ্বারা নিযেধাজ্ঞা প্রদান না করেন,—তৎক্ষণ কোন ম্যাজিষ্ট্রেটের এমন ক্ষমতা নাই যে, তিনি জনসত্তেঘর কোন পবিত্র বন্দনবাক্য উচ্চারণ নিষিদ্ধ করিতে পারেন। অতএব সাত কোটি বাঙ্গালীর প্রতিনিধি-সভা কখনই এক জন যথেচ্ছাচারী জুলুমদারের লাঞ্ছনাঅপমান বৈধ আদেশরূপে শিরোধাৰ্য্য করিতে বাধ্য নহে। কিন্তু শাস্তিভঙ্গ না করিয়া আইন-বিধি রক্ষাপূর্বকই, বাহুবলের পরিবর্তে মনের বল অবলম্বনে এই বে-আইনী অনধিকার আদেশের প্রতিবাদ করা কৰ্ত্তব্য । এ জন্য যদি পুলিসের অত্যাচার সহিতে হয়, অকুতোভয়ে তাহ সহ করিয়া “বনে মাতরমূ” ধ্বনি করিতে করিতে সকলে অগ্রসর হইবেন । সভার এই পরামর্শানুসারে রাজা তাহার প্রহরী এবং লাঠিয়ালদিগকে মিছিলে যোগ দিতে নিষেধ করিলেন । রাজভবনের কম্পাউণ্ড হইতে বেল ৮টার সমর মিছিল বাছির হইবে। প্রাতঃকাল হইতে উদ্যোগপৰ্ব্ব আরম্ভ হইয়াছে। সভামণ্ডপ এ স্থল হইতে দূরে নহে, সভাপতিকে মোটরে বসাইয়া আর সকলে পদব্রজে মওপে গমন করিবেন, এইরূপ স্থির করিয়া, প্রয়োজন হইলে অদ্যাক্সের বিরুদ্ধে অনাড়ম্বর প্রাণপাতের জন্ত তাহারা প্রস্তুত হইলেন । মনে ধৰ্ম্মবল এবং হস্তে "বন্দে মাতরমূ” নিশান ধরিয়া সকলে ক্ষমতাশালী রাজপক্ষের অদ্যায় বাধার মধ্য দিয়া শোভা-যাত্রা করিলেন। রাজা অতুলেশ্বর গায়কদলের অগ্রণীরূপে মোটর-যানের অগ্রবত্তী এবং প্রতিনিধি প্রভৃতি অন্যান্ত লোক পার্শ্ববৰ্ত্তা এবং অমুবৰ্ত্তী হইরা দাড়াইয়াছিলেন। রাজা প্রথমে নিশান উঠাইয়। “বন্দে মাতরম্ ধ্বনি তুলিবামাত্র শত শত হস্তের নিশান পতপত শব্দে উদ্ধে উঠিল— শত শত কণ্ঠে মেঘমন্দ্রনাদে “বনে মাতরম্ ধ্বনি উচ্চারিত হইল। সে ধ্বনি শূন্তে বিলীন হইতে না হইতে দিষ্মণ্ডল স্বরের আগুনে জালাইয়া গায়কদল মহোৎসাহে গান ধরিল ;--- “বন্দে মাতরম্ ব’লে,— আয় রে ভাই দলে দলে! হই রে আগুয়ান, যায় যা’বে যা’ক প্রাণ,- “ মায়ের কাজে আত্মদান, কর্ব সবাই কুতূহলে।” রাস্তার পরপারে অশ্বারোহী পুলিসকৰ্ত্ত তাহার পদাতিক দলবলের সহিত অপেক্ষা করিতেছিলেন । মিছিল রাজকম্পাউণ্ড অতিক্রম করিবণমাত্র তিনি র্তাহার সহকারী সুবেদার, জমাদার প্রভূতি তিন শত লোকসঙ্গ মিছিলের গতিরোধ করিয়া গান বন্ধ করিতে আজ্ঞা দিলেন । কিন্তু জনসঙ্ঘের একটি ক্ষুদ্র বালকও এ আজ্ঞায় ভীত হইয়া নিশান নামাইল না ; আকাশভেদী স্বরে আবার “বন্দে মাতরম্ " ধ্বনি উঠিল। গায়কদল গানের দ্বিতীয় কলি ধরিল -- “বল ভাই ‘বন্দে মাতরম্ সাত সমুদ্রের ঢেউ-তুফানে খেলুক গানের রং । অস্ত্র নাইক হাতে, মোদের ভাবনা কি রে তা’তে, ভক্তি মহাশক্তি, ও ভাই অজেয় ভূতলে আয় রে ভাই “বন্দে মাতরম্ ব'লে।” পুলিসকৰ্ত্তার ক্ৰোধ-বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এই নিরস্ত্র, বৰ্ব্বর, ভীরু জনসভবকে দমনের জন্ত তিন শত পুলিস-বলই তিনি যথেষ্ট মনে করিয়াছিলেন। কিন্তু ঠাহীর সনাতন অভিজ্ঞতা ও ধারণা, মিথ্যা