বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৭

উইকিসংকলন থেকে

সশস্ত্র প্রতিরোধ; কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ……… ১৯৭১

চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম, এ, ওসমান চৌধুরী[১]

৩১-১-১৯৭৪

 আমি ইপিআর, ৪র্থ উইং-এর ভার গ্রহণ করার পূর্ব থেকেই ওখানে (চুয়াডাঙ্গায়) ছিলেন দুইজন ক্যাপ্টেন-সহকারী উইং কমাণ্ডার হিসাবে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙ্গালী। নাম তার ক্যাপ্টেন এ, আর, আজম চৌধুরী (বর্তমানে মেজর), দ্বিতীয় জন ছিলেন অবাঙ্গালী, তার নাম ক্যাপ্টেন (মরহুম) সাদেক।

 এই উইং-এর অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানী। ১টি কোম্পানী চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে, অন্য চারটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। উইং-এর সীমান্ত এলাকা ছিল দক্ষিণে মাসলিয়া বিওপি থেকে উত্তরে মহেশকুণ্ডি বিওপি পর্যন্ত। প্রত্যেকটি কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিল একেকজন সুবেদার। মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০। তার মধ্যে আনুমানিক অবাঙ্গালী সেনার সংখ্যা ছিল ১৫০।

 ২০শে মার্চ ১৯৭১ সন। চট্টগ্রাম থেকে আমার ব্যক্তিগত গাড়ীটি সড়ক পথে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌঁছল। ২৪শে মার্চ সকাল ১০টায় ঐ গাড়ী করেই আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে মেহেরপুরের পথে কুষ্টিয়া রওনা হই। আমার পরণে ছিল ইপিআর পোশাক। সাথে চলল ইপিআর জীপে চজে ৪ জন সশস্ত্র ইপিআর সৈনিক। উদ্দেশ্য ছিল, আমার সরকারী বাড়ী মেরামত করার খরচ হিসাবে কুষ্টিয়ার ডিসি’র কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা। ইচ্ছা ছিল, ঐ দিনই কাজ সেরে কুষ্টিয়ায় রাত্রি যাপন করার পর ২৫শে মার্চের পূর্বাহ্নেই চুয়াডাঙ্গা ফেরত আসার। কিন্তু মেহেরপুরে গিয়েই গাড়ীটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই দোষ খুঁজে পেলাম না। জীপ ফেরত পাঠিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিকস আনালাম। গাড়ী ঠিক হতে হতে বিকেল ৩টা বেজে গেল। আবার রওনা হলাম কুষ্টিয়া অভিমুখে। আরো ১৫ মাইল যাবার পর গাড়ী খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশে-পাশের বাড়ী থেকে পাটের রশি সংগ্রহ করে জীপের পেছনে গাড়ীকে বেঁধে কুষ্টিয়া পৌঁছলাম। উঠলাম কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে।

 পরদিন ২৫শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ডেপুটি কমিশনার সাহেবের অফিসে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব শামসুল হক। তাঁর অফিস ও বাসস্থান ছিল একই প্রাঙ্গণে। তিনি আসলেন, কথাবার্তা হল, চায়ের পর্ব শেষ হল। তারপর পিয়নের মারফত ডাকলেন ল্যাণ্ড এ্যাকুইজিসন অফিসারকে। এল-এ-সাহেব আসলেন, সব শুনলেন, তারপর গেলেন অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চেকবুক আনবার জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সেরে আমাকে চেক ইস্যু করতে করতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। তখনকার ন্যশনাল ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেল, তাই টাকা আর উঠানো গেল না। চুয়াডাঙ্গায় এমন কোন জরুরী অবস্থা ছিল না তাই টাকা সাথে করে নিয়ে যাবো মনে করেই ২৫শে মার্চ রাতেও কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে রয়ে গেলাম।

 ২৬শে মার্চ ভোর ছটায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম অল্প দূরেই রাস্তার উপর মিলিটারী জীপে করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর লোক টহল দিচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ। কুষ্টিয়ার জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা বাংরাদেশেরজানারা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। ডি-সিকে টেলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম ব্যাপার কি? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে এটার কোন সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম লাইন কেটে দিয়েছে। পিছনে চেয়ে দেখলাম সামরিক বাহিনী সার্কিট হাউসের ঠিক পিছনেই তথা জিলা স্কুলে করেছে তাদের সদর দপ্তর। কি করব বুঝতেই পারলাম না। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। রেডিও লাগান ছিল, ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রোগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে ৮টা কি ৯টার দিকে হঠাৎ ঘোষণা করা হল নতুন নতুন ‘মার্শাল ল’ আইন। লুফে নিল আমাদের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। বুঝতে পারলাম, বোধ হয় এসেছে আমাদের সেই চরম ও পরম পরীক্ষার দিন। আর এক মুহূর্তও কুষ্টিয়ায় থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জীপের পেছনে আবার গাড়ীটাকে বেঁধে এবার উল্টাদিকে অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গাড়ী চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভাল কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। কাজেই কুষ্টিয়া শহরের সীমা অতিক্রম করতে আমাদের এক মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআর-এর পোশাক পরা অবস্থায় আমাদের দেখেও আমাদের কিছুই ওরা বলেনি। কেন বলেনি সেটা পরে যতবার ভেবেছি, ততবারই ওদের বোকামি ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি এটা বোধ হয় আল্লাহরই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌঁছে দেখি শহর লোকে লোকারণ্য। আমার জীপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেড়ে দিল।

 এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙ্গালী কমাণ্ডার। আমার বা আমার পরিবারের কারও গায়ের রং দেশে স্থানীয় লোক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙ্গালী। তাছাড়া এই স্বল্প সময়ে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করাও সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সাথে পরিচয় করার ওটাই একটা সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আমি গাড়ি থেকে নেমে বাংলা ভাষায় লোকজনকে ডাকলাম। লোকজন সবাই দৌড়ে আসল। পরিচয় পেয়ে উৎসাহিত হল। আমার আহ্বানে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিল। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকবার উপদেশ দিয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা দিলাম।

 আনুমানিক বেলা ১টায় চুয়াডাঙ্গা আমার সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পৌঁছলাম। আমার গাড়ী দাঁড়াবার সাথে সাথেই আমার বাঙ্গালী উইং হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। আরও জানাল যে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোনরকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টারের সমস্ত অবাঙ্গালী সেনাদের সে আটক করে রেখেছে এবং অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।

 হাবিলদার মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা দুরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হল যে ২৫শে মার্চ বিকেল বেলা হঠাৎ করে যশোর থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙ্গালী মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গা এসেছিল যশোরে একটা অত্যন্ত জরুরী মিটিং-এর অজুহাতে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত্রি যাপন করে ২৬শে মার্চ ভোর ৪টার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে যশোরে পালিয়ে যায়।

 যাই হোক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে প্রায় পৌঁছতে পারলাম। তবুও তাদেরকে সর্বতোভাবে তৈরী থাকতে নির্দেশ দিয়ে আমি আমার বাসভবনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি আমার অফিসার ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এম-পি ডাঃ আসহাবুল হক ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মচারী প্রমুখদের জরুরীভাবে তলব করে পাঠালাম। ডাঃ আসহাবুল বোধ হয় তৈরীই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। খবর পেয়ে ৫ মিনিটের মধে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাদেরকে নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়পার আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা গেল, এ অন্যায় আমরা সইবনা। শপথ নিলাম আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হোক নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও মাতুভূমিকে এই পশুশক্তির কালো হাত থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপের প্রধান বলে মেনে নিলেন। আমিও নির্দেশ জারী করলাম যে, সেই থেকে আমার নির্দেশ মতই সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যহার আমার উইং-এর কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। এটা যে একটা কত বড় জীবনের ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন কোন রকম সংযোগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাক্তিস্তান সেনাবাহিনীর মত একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজন মাত্রেই তা অনুধাবন করতে পারবেন।

 তারপর আমি আমার সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করানো এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দানে প্রায় অর্ধারাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে অয়ারলেস মারফত সীমান্তের আমার সৈন্যদেরকেও অবস্থা বর্ণনা করে সজাগ থাকতে নির্দেশ দিই। এই ভাবে অতিবাহিত হল ২৬শে মার্চ।

 ২৭শে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকায় মাসলিয়া বিওপি কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আব্দুল মজিদ মোল্লা অয়ারলেস মারফত জানালেন যে ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈনিকসহ যশোর থেকে সীমান্ত রাস্তা দিয়ে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। আমি তাকে ক্যাপ্টেন সাদেরকর উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিলাম। খবরটা পেয়ে আমি অনুমান করেছিলাম যে, হয়তবা ২৬শে মার্চ ভোর ৪টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে আসতে পারিনি লক্ষ্য করেই বোথ হয় ক্যাপ্টেন সাদেক ভেবেছিল যে, সীমান্তের সৈন্যদেরকে নিশ্চয় কোন রকম সজাগ থাকার আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার মাসলিয়া যাবার উদ্দেশ্য সৈন্যদেরকে চতুরতার সাথে নিরস্ত্র করা।

 যাই হোক, প্রায় ১০ মিনিট পর সুবেদার মজিদ মোল্লা জানান যে, ক্যাপ্টেন সাদেম আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙ্গালী সিপাই-এর উপর পিস্তলের গুলি করে যশোর অভিমুখে জীপে করে পালিয়ে যায়। অবশ্য, এরপর আমার নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী বিওপিতে খবর দিয়ে গুলির বিনিময়ে তাদের গতি রোধ করা হয়। গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মোল্লা অত্যন্ত ভীতস্বরে অয়ারলেসে আমাকে এ খবর জানায়। আমি তাকে অভয় দিয়ে মৃদদেহগুলি পুঁতে ফেলার আদেশ দিই। এইখানেই শুরু হল আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম- “I am in a point of no return. Either I have to kill the enemy or get killed.”

 কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনাঃ ডাঃ আসহাবুল হক সাহেবকে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরী ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েত হবার নির্দেশ দিলাম। ফিলিপনগর কোম্পানীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হবার পর পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মোজাফফর আহমেদ (বর্তমানে লেঃ ইপিআর)। দুই কমরেড মিলে ঐ এলাকার নামকরণ করলাম-”সাউথ ওয়েষ্টার্ন কমাণ্ড দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন।” কমাণ্ডার হলাম আমি মেজর মোহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)।

 এখানে কুষ্টিয়ার শত্রুর সৈন্যসংখ্যা ও তাদের শক্তির উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। যশোর ব্রিগেড থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেণ্ট তথা রিকনাইসেন্স ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানী-অর্থাৎ প্রায় ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫/২৬শে মার্চ রাত দেড়টায়। তাদের সাথে ছিল পর্যাপ্তসংখ্যক ১০৬ এমএম আর-আর (জীপে সংস্থাপিত) চীনা এইচ-এম-জি, এলএমজি, এসএমজি ও অটোমেটিক রাইফেলসমূহ। তার সাথে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ, গাড়ী ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানীর ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের বাংরাদেশেরপ্রয় সমপরিমাণ এই সত্য আমার ভাল করেই জানা ছিল। আমি জানতাম, যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে আমি অন্ততঃপক্ষে সমান ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে তিনগুণ সৈন্যের কম হলে ওদেরকে আক্রমণ করতে পারি না। কুষ্টিয়ার শত্রুদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শোয়েব। তার সাথে উপ-অধিনায়করা ছিল ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ।

 আমার মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর সৈনিক। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মর্চে পড়া ৪টা ৩.৫ রকেট লাঞ্চার। গোলাবারুদের সংখ্যা একবারেই ছিল অপর্যাপ্ত। তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকজন। অফিসার বলতে আমার সাথে ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সাথে ছিল সমস্ত জনসাধারণ।

 তবুও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কিছু সংখ্যক আনসার ও মুজাহিদকে একদিনের ট্রেনিং-এর পর আমার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় পুলিশ ও আনসারদের ৩০৩ রাইফেলগুলো দ্বারা এই বাহিনীকে সজ্জিত করি।

 আমার কাছে কোন রকম ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কম্যুনিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ডঃ আসহাবুল হক সাহেবের সাহায্যে ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র, ডাক্তার ও ঔষধের ব্যবস্থা করা হয়। সেনাবাহিনীর ন্যায় খাদ্য সরবরাহের কোন রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলাণ্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোকে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ দলের গণ্যমান্যদের সাহায্যে আমার সমস্ত সৈন্যবাহিনীর খাদ্যের পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমত যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।

 ২৮শে মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য আমি ঝিনাইদহে পাঠিয়ে দিই ও যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রাখি, যেন যশোর থেকে কোন রকম সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে। আর এক কোম্পানী সৈন্যকে ঐদিন বিকেল বেলা ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমি পোড়াদহ পাঠিয়ে দিই। ক্যাপ্টেন আজমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবার পরেই সে যেন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিপোর্ট দেয়। পরিকল্পনা ছিল সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে-অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও অয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবেসংযুক্তভাবে একই সময়ে তিন দিক থেকে।

 আক্রমণের সময় ও তারিখ ছিল ২৯শে মার্চ ভোর ৪টা। পরিকল্পনায় এটাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে, আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার বাহিনীর পশ্চাদভাগে যেন কমপক্ষে ৫ হাজার বেসামরিক লোক আক্রমণের সাথে সাথেই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আক্রমণকারী বাহিনীকে অনুসরণ করে। এ সময় বেসামরিক ব্যবস্থার ভার ছিল ডঃ আসহাবুল হকের উপর যিনি তাঁর দলীয় লোক, স্থানীয় ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্যে খুব সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।

 আক্রমণের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ী দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই। অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায়।

 প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় আমার মাসলিয়ায় অবস্থানরত কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লা অয়ারলেসে খবর পাঠালেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ান, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিত, তাদের সমস্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে বাঙ্গালী কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল রেজিউল জলিলের নেতৃত্বে চোগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটেলিয়ান নাকি ২৪শে মার্চ তারিখে বাৎসরিক ফিল্ড এক্সসারসাইজের জন্য চৌগাছায় এসেছিল যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে। খবর শুনে আমার মনে বিরাট একটা ভরসা আসল। আমি অয়ারলেসে সুবেদার মজিদ মোল্লাকে দিয়ে আমার তরফ থেকে লিখে পাঠালাম লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে। ঐ খবরে আমি লিখেছিলাম যে, ‘দেশের ও দেশের লোকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না। কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে। আপনি আসুন অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিত ভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হবে।” সুবেদার মজিদ মোল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানে গিয়ে এ সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও তাঁর কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমাকে এ খবর দেয়ার পর ২৮শে মার্চ আবার এই মর্মে চিঠি লিখে দানেশ নামক এক বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাকে তার মোটরসাইকেলে করেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে পাঠাই। চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছানো হয়, কিন্তু নিষ্ফল সব আশা। তিনি কোন রকম আশ্বাস দেয়া দূরের কথা, আমার কার্যকলাপকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে সেদিনই বিকেল বেলা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে তাঁর জীপে করে চলে যান এবং ২৯শে মার্চ পত্রবাহক মারফত ব্যাটেলিয়ানের কাছে সংবাদ পাঠান যে, যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে কোন রকম গোলমাল নেই এবং তার আশঙ্কাও নেই, তার পুরো ব্যাটেলিয়ান যেন যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে সেদিনই ফেরত আসে। তদনুযায়ী এই ব্যাটেলিয়ান ২৯শে মার্চ বিকেল পর্যন্ত যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে ফেরত গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে আপন আপন কাজে লিপ্ত হয়। শুনেছি, ব্রিগেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দুররানী নাকি রাত্রেই তাদের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে। পরদিন ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় এই ব্যাটেলিয়ানের অস্ত্রবিহীন সৈন্যদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ ও গোলাগুলি বর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানের অধিকাংশ সৈন্যই নিরীহভাবে মারা যায়। শুধু লেঃ হাফিজউদ্দিন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ও ১৪৮ জন জেসিও এবং অন্যান্য সাধারণ সৈন্য জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ঐ চৌগাছা এলাকায় সমবেত হয়। তাদের অস্ত্র নেই, খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই। তারা বহুকষ্টে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।

 এদিকে কুষ্টিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা হলো, ২৮শে মার্চ রাত থেকে ২৯শে মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে আমাদের সৈন্যদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট জায়াগায় পৌঁছতে সক্ষম হয় ২৯শে মার্চ ভোরবেলা। নিয়মিত যোগাযোগ করে তাদেরকে আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং যথারীতি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ঔষধপত্র ও বেসামরিক লোক সরবরাহ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে মার্চ সকাল ৪টায় তিন দিক থেকে অতর্কিত ভাবে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সাথে সাথে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস কেন্দ্রের ভিতর ঢুকে পড়ে শত্রুহনন করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক শত্রুসৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদেরই সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালাবার প্রাক্কালেও অনেকে নিহত হয়। পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতীত সমস্ত শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সৈন্যরা শত্রুদেরকে ৩০শে মার্চ সারারাত চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি জহকারে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা অয়ারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের অয়ারলেস আবেদন মনিটরিং করে যশোরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশোরের প্রত্যুত্তর ছিল- “Reinforcement not possible. Try to live on your own.”

 পরদিন ৩১শে মার্চ ভোরবেলা আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তুমুল গোলাগুলির সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করে। সারাদিনের যুদ্ধের পর আনুমানিক জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০/৪৫ জন। তার মধ্যে অফিসাররা সকলেই জীবিত ছিল। গত্যন্তর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা দুইটি জীপ ও একটি ডজ গাড়ীতে আরোহণ করে আমাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমার সৈন্যরা সাথে সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে। শত্রুদের ভাগ্য মন্দ। শৈলকুপার পুলের গোড়ায় আমরা গর্ত খনন করে তারপোলিন দিয়ে সেই গর্তকে ঢেকে রেখেছিলাম সেটা তারা জানত না। তাদের প্রথম ২টা জীপ উপর্যুপরি গর্তে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে। মেজর শোয়েব ও কয়েকজন শত্রুসেনারা সেখানে ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাকীরা আশে পাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, সেচ্ছাসেবক ও জনগণের হাত থেকে একটি শত্রুসৈন্যও বাঁচতে পারেনি। আমার নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে তারা এক একজনকে হত্যা করে তাদের হাতিয়ার এনে আমার সদর দপ্তরে জমা দেয়। এমনও হয়েছে একটি ছেলে একটা এখন শটগান দিয়ে একজন এলএমজিধারী শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে তার হাতের একটি আঙ্গুল ও এলএমজি আমার সদর দপ্তরে জমা করে। এই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮/২০ বছর। নাম তার সুলতান আলী জোয়ারদার। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও হৈ-হুল্লোড়ে এই ছেলেটির সাথে দেখা করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

 সেই রাত্রেই লেঃ আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। তাকে ঝিনাইদহে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ২রা এপ্রিল বিকেলের দিকে আমর সদর দপ্তরে আনা হয়।

 ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে আমাদের হাতে মুক্ত হয়। এরপর সামান্যসংখ্যক সৈন্য কুষ্টিয়ায় রেখে বাকী সৈন্যদের আমি ঝিনাইদহের দিকে পাঠিয়ে দেই। কিছু সংখ্যক সৈন্য মাগুরা, কিছুসংখ্যক ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছুসংখ্যক সৈন্য কোটচাঁদপুরে অবস্থান করে। উদ্দেশ্য-যশোর থেকে উত্তর দিকে শত্রুদের অগ্রসর হবার সব পথ অবরোধ করে রাখা।

 এদিকে ২৮শে মার্চ তারিখেই কলিকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। আমার মনে আছে টেলিফোনে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক পালাক্রমে কলিকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাছে যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতাম।

 এক রাত্রের কথা আমি ভুলব না। সেদিন বোধ হয় ২৮ কি ২৯ তারিখ রাত্রের ঘটনা। ঢাকা থেকে খবর পেলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট উপাধিধারী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিজ নিজ ঘরে পাক সেনাবাহিনী অত্যান্ত ঘৃণ্যতমভাবে হত্যা করেছে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকাকে টেলিফোনে এ খবর দিতে দিতে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেদিন তাদেরকে এও বলেছিলাম যে, আমরাও এর প্রতিশোধ সমভাবেই গ্রহণ করব। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা জনাব ইউনুস ইলী এম-পি-এ, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফ উদ্দিন ও আরো অন্যান্যকে নানা বেসামরিক সংযোগ, অভ্যর্থনা, সাহায্য গ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ প্রত্যেকেই আপন আপন সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী এই যুদ্ধের আয়োজন ও সরঞ্জামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দিনাত সাহায্য করেছি।

 বিদ্রোহ করার অব্যবহিত পরে বর্তমান বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সাথে সংযোগ হওয়ার সাথে সাথেই আমার স্ত্রীকে সেখানকার কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বেশ পরে অনেক সুহৃদই এই প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী ও মেয়েরা আমরা সাথে যুদ্ধক্ষেত্রেই হাসিমুখে যেকোন পরিস্থিতেতেই থাকবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাই আর যাওয়া হল না। থাকল ওরা আমারই ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টারের একটি কামরায়। সেখানে থেকেই মিসেস ওসমান স্থানীয় সেনাদের খাবার ও পানীয় সরবরাহের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। এ কাজের ভার তাকে সঁপে দিতে হয়নি, নিজেই চিন্তা করে তা শুরু করেন। এমনকি সে রণাঙ্গনের যেসব সেনাদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সেখানে থাকত, তাদের খাবার ও পানীয়, টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্বও তিনি পরিচালনা করেন। তার উপর হেডকোয়ার্টারে আমাকে বা প্রয়োজনবশত ডাঃ আসহাবুল হক ও অন্যান্য অফিসারকে নানাভাবে সাহায্য করতে দ্বিধা করেননি। প্রয়োজনবশত মাটিতে পজিশন নেওয়া, পরিখাতে ঢুকে সতর্ক পাহারা দেওয়া, ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা, এমনকি অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদের ও সেনাসামন্তের মেইনটেন করা, এ জাতীয় বহু কাজেও আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে তিনি অত্যন্ত আনন্দ বোধ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেননি সত্য, কিন্তু যুদ্ধের যে সরঞ্জাম তিনি দিয়েছিলেন, তা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

 পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কুষ্টিয়ার সৈন্যদের তুলে নিয়ে ঝিনাইদহের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্বদক্ষিণের ভিন্ন ভিন্ন সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ করা হয়। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুপক্ষ যাতে কোনো দিক দিয়ে পালিয়ে আমাদের পিছনে বা মধ্যে আসতে না পারে তার জন্য জোর পেট্রলিং করা হচ্ছিল।

 এদিকে পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ায় অধিকৃত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গাড়ী ৩রা এপ্রিল অতি প্রত্যুষে হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব যখন আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনার খসড়া তৈরী করছি, এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ দল। তারা আমার কাছে বিশ্বময় টেলিভিশন পাবলিসিটির জন্য আমার সাক্ষাৎকার চাইলেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, সে পর্যন্ত একমাত্র বিবিসি ও আকাশবাণী ছাড়া আর কোথাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ প্রকাশ পায়নি। এমনকি বিবিসি থেকেও ২/৪টা খুচরো সংবাদ ছাড়া বিশেষ কিছু প্রকাশ পেত না। অথচ বিশ্ববাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বিষয়ে জানতে না পারলে তাদের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব। বিশ্বের সমর্থন ছাড়া যে কোন মুক্তিযুদ্ধ লোকালাইজড হতে হতে শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই এ সুযোগ আমি হেলায় ফেলতে পারলাম না। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হল। আমার ৬ বছরের ছোট মেয়ে, ডাকনাম তার কলি, তখন কাগজের উপর বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে সেটাকে ছোট একটা কঞ্চিতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এত কচি শিশুর এত উদ্দীপনা ও মনোবল তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই মুহূর্তেই তারা কলির সেই ভঙ্গিমার মুভি শট নিলেন, আরও নিলেন আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে চম্পা এবং অন্যান্য আরও দু’চার জনের সংক্ষিপ্ত কথা ও ছবি। আমাদের সৈনিকদের মনোবল দেখানো হলো নানাস্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থান। বেলা তখন প্রায় সকাল ১০টা। এসে গেল কুষ্টিয়া হতে প্রেরিত অধিকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনের কনভয়। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে আমাদের অভাবনীয় জয়ের সেগুলো ছিল জীবন্ত নিদর্শন। টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বেশ উৎসাহিত হলেন। সাথে সাথে সমস্ত ‘কনভয়’কে হেডকোয়ার্টারের সম্মুখে অবস্থিত রাস্তার উপর সার বাঁধিয়ে বড় বড় কামান ও মেশিনগানগুলি ভাল করে ডিসপ্লে করে রাখা হল। একের পর এক সুষ্ঠুভাবে তারা নিলেন এগুলোর জীবন্ত ছায়াছবি। আমাদের হাতে বন্দী লেঃ আতাউল্লাহ শাহকেও আনিয়ে মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় সেই লাইনের অধিকৃত একটা জীপের পাশে বসিয়ে দেয়া হল। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত ধরা পড়ল তার জীবন্ত সাক্ষাৎকার।

 আল্লাহর কি ইচ্ছা, শুটিং শেষ করে কর্পোরেশনের সদস্যরা তাদের টেপরেকর্ডার ও মুভি ক্যামেরা গুটাতে যাবে, ঠিক এমনি সময় আসল চুয়াডাঙ্গার উপরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান হামলা। চলল বিমানে-জমিনে লড়াই। কর্ণবিদারী আওয়াজে মুখরিত হয় চুয়াডাঙ্গা। এই সুযোগের অপচয় করেননি ফরাসি টেলিভিশন কর্পোরেশনের নির্ভীক সদস্যরা। অসম সাহসের সাধে তারা নিতে লাগলেন বিমানের উড্ডয়ন, বোমা ও রকেট নিক্ষেপ, জমিনমুখী গুলি ও এ্যাণ্টি-এয়ারক্রাফট ফায়ার-এর ছবি ও আওয়াজ। ধরা পড়ল তাতে সৈন্যদের ব্যস্তসমস্ত এ্যাকশন ও রিএ্যাকশনের জীবন্ত ছবি। বাংলার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হল প্রথম নাপাম বোমা চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইং-এর প্রাক্তন হেডকোয়ার্টার ভবনে। ধরে গেল আগুন। কর্পোরেশনের সদস্যরা ভাগ্যবশত ঠিক সেখানটায় উপস্থিত ছিলেন। নাপাম বোমার নিক্ষেপ থেকে শুরু করে টারগেট হিট, আগুন ধরা সবকিছুর জীবন্ত ছবি উঠে গেলো তাদের ক্যামেরায়। ওরা এত নির্ভীক যে ত্রস্ত গতিতে গাছের উপর উঠেও তারা এই আকাশ ও জমিনের যুদ্ধের ছবি তোলা পরিচালনা করেন।

 এই যুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি, শুধু একজন স্বেচ্ছাসেবক গায়ে বোমার সামান্য একটা টুকরা লেগে সামান্য আহত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরের ঠিক দক্ষিণ ভাগে একটা বাড়ীর কুঁড়েঘরে নাপাম বোমা নিক্ষিপ্ত হলে সে ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এত সুষ্ঠুভাবে এত সাহসের সহিত টিভির সদস্যরা এই জীবন্ত ছবি তোলার কাজ সমাপন করেন যে তাদেরকে আমি সালাম না জানিয়ে পারিনি।

 আমার মনে আছে, এই মুভি রীলের মধ্যে আমি জোর দিয়ে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আমরা পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর শুধু নৈতিক সমর্থন চাই, বস্তুগত সমর্থনের দরকার আমাদের নেই, কারণ আমার হাতের চীনা এসএমজিটা দেখিয়ে ওদেরকে শত্রুর অস্ত্র দিয়েই আমরা শত্রুকে হনন করবো।

 পরিশেষে এই টিভি সদস্যদল আমাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করে কলিকাতা যান। বলে গেলেন যে, তারা প্যারিসে সেদিনই চলে যাবেন এই এ্যাকশন ফিল্মের পাবলিসিটি দেবার জন্য।

 পরবর্তীকালে এই সদস্যদলের দ্বিতীয়বার আগমনে জানতে পারলাম, তাঁরা নাকি এই ফিল্মের কপি আরও ৫১টি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। আরো জানতে ও শুনতে পেলাম নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকের মাস্টার পিস ফিল্ম প্রোডাকশনের মত এই যুদ্ধের ফিল্মটিও সারা বিশ্বে সুপারহিট করেছিল, কারণ এটাই সে পর্যন্ত বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সাফল্যজনকভাবে বিশ্বের স্বাধীনচেতা লোকদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে পেরেছিল। লণ্ডন, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য জায়গা থেকে সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররাও এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

 ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর কাছ থেকে কিছু কিছু ৩০৩ রাইফেল, ২/১টা এলএমজি, কিছু স্টেনগান ও সামান্য পরিমাণ গোলাবারুদ পেয়েছিলাম। অনেকে ভারত থেকে আমার কাছে এসেছিলেন দেখা করতে সামান্য কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির খ্যাতনামা সেক্রেটারী শ্রী এম, কে, ভিমানী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এসে আমার কাছ থেকে আমার কি কি প্রয়োজন তার একটা ফর্দ করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ঐ ফর্দের কোন জিনিসই কোনকালে পেলাম না, তাদেরও আর সাক্ষাৎ পেলাম না। অবশ্য শ্রী ভিমানী আমার সৈন্যদের যে পরিমানে রিলিফ সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে বুট, কাপড়, ঔষধপত্র থেকে আরম্ভ করে ওদের কোন কিছুরই অভাব হয়নি।

ভারতের সাথে যোগাযোগ

 ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন, সময় সকাল ১০টা। সীমান্তবর্তী জীবননগর থানা থেকে খবর আসল আমার সদর দপ্তরে যে, মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতীয় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার সাথে দেখা করার জন্য জীবননগর সীমান্তে অবস্থান করছেন। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে আমার সেখানে যাওয়া উচিত। একটি জীপে চড়ে ২জন সৈনিক সাথে করে রওনা হলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতেই লেঃ কর্নেল এইচ, আর, চক্রবর্তী (সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৭৬ নং ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার, কৃষ্ণনগর) আমাকে জোর আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন ও আমার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখানে দেখা হয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আই-জি সাহেবের সাথে। মনোযোগ সহকারে তাঁরা শুনলেন আমার রণাঙ্গনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুনতে চাইলেন আমার যশোর আক্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরও শুনতে চাইলেন ঐ পরিকল্পনাকে সার্থক করতে হলে আমার কি কি প্রয়োজন। বললাম সবকিছু। তাজউদ্দীন সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, যথাশীঘ্রই আমরা সব পাব। লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তখনই তিনি সাথে করে আনা একটা চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি দিতে চাইলেন। এটার ব্যবহারকৌশল আমাদের জানা ছিল না বলে তিনি আমাকে দুপুরের খাবারের পর নিয়ে গেলেন ওটার কৌশল শিখাবার জন্য। এমন সময় আমার সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে টেলিফোনে খবর আসল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চলাকালীন যশোর থেকে পাক সেনাবাহিনীর একটা দল অগ্রসর হতে গিয়ে কালীগঞ্জ এলাকায় আমাদের ফাইটিং পেট্রোলের এ্যামবুশে পড়ে কিছুসংখ্যক প্রাণ হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাই হোক, খবর পেয়ে আমি আমার একজন সৈনিককে ঐ চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি’র কৌশল শিখিয়ে ওটা নিয়ে আসবার জন্য ওখানে রেখে আমি সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে চলে আসি। সদর দপ্তরে তখন ছিলেন ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব ও আমার স্ত্রী। এই খবরে স্বাভাবিকভাবেই ওরা একটু মুষড়ে পড়েছিল। যাই হোক, আমি যাবার পর প্রয়োজনীয় খবরাখবর ও সৈন্য মোতায়েন করার পর অবস্থা আয়ত্তে আসে। পাকিস্তানীরা আর অগ্রসর হয়নি। বুঝতে পারলাম এটা ছিল তাদের নকল আক্রমণের প্রহসন।

 জীবননগর থেকে চলে আসার পূর্বে লেঃ কর্নেল এইচ, আর, চক্রবর্তী আমাকে সবরকম আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, অচিরেই আমরা আমাদের ভারী অস্ত্রাদি পাব, যার জন্য তিনি আমাকে আইজি-এর অফিসে মেজর বি, এন, ভট্টাচার্যের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখার উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের টেলিফোন নাম্বারও দিলেন। সেই থেকে প্রতিক্ষণ ইণ্ডিয়ান বিএসএফ-এর আইজি সাহেবের অফিসে মেজর ভট্টাচার্যের কাছে টেলিফোনে সর্বশেষ সিচুয়েশন রিপোর্ট দিতাম এবং জীবন নগরে প্রস্তাবিত আমার জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহের সর্বশেষ অবস্থা কি জানতে চাইতাম। তিনি আমাকে প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে আমার ডিমাণ্ড দিল্লীর অফিসে বিবেচনাধীন আছে, শীঘ্রই এসে যাবে।

 এদিকে পাকিস্তান সেনাবহিনী যশোর থেকে ৬ই এপ্রিল ভোরবেলা আমার বিশাখালী সৈন্যাবস্থান আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিণতি কে এড়াবে! আমার বাহিনী সর্বতোভাবে প্রস্তুত ছিল, সতর্ক ছিল। এদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের বহু প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল সামান্য কিছু লোক যশোর সেনানিবাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে আমাদের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিজয়, যার জন্য আমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের মনের বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বি অবস্থা গ্রহণ করে। আমিও এই সুযোগে আমার বাহিনীর অবস্থান সীমা পরিবর্তন করে কালীগঞ্জের দক্ষিণে যশোর সেনানিবাস থেকে ৫ মাইল দূরে অর্ধবৃত্তাকারে স্থাপন করি। ব্যাপকভাবে পেট্রলিংও কায়েম রাখি যার জন্য যশোরে পাক-বাহিনী বের হতে আর সাহস করেনি।

 অন্যদিকে জীবননগরের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশ্বস্ত হয়ে আমি দর্শনা-গেদের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী উঠিয়ে ফেলা রেললাইন জোড়া দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করি এবং ৭ই এপ্রিল অপরাহ্নে একটা লম্বা খালি মালবাহী ট্রেন গেদে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখি আমাদের ইপ্সিত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও পোলাবারুদ বহন করে নিয়ে আসার দুরাশায়। এটা যে সত্যি দুরাশা ছিল তখন ভেবে দেখার ফুরসত পাইনি, সন্দেহও হয়নি। এদিকে ৬ই এপ্রিলের পর থেকে তীব্র গতিতে চলতে লাগল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রি-ইনফোর্সমেণ্ট প্রোগ্রাম-জল ও আকাশপথে। আকাশপথে বাধা দিবার আমার কোন শক্তি ছিল না। জলপথেও বাধা দিতে পারিনি, কেননা যশোর সেনানিবাস থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণ দিকে খুলনা-মঙ্গলা বন্দর পর্যন্ত তখনও আমার আয়ত্তাধীন ছিল না।

 ইপিআর-এর ৫নং উইং-এ অবস্থান ছিল খুলনায়। তার কমাণ্ডার ছিল অবাঙ্গালী। তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ইপিআর সেনাবাহিনীকে প্রায় পুরোপুরিভাবে নিরস্ত্র করে রেখেছিল। লড়াই লাগার সাথে সাথে অনেকে প্রাণ দিল, অনেকে আত্মগোপন করে রইল। যারা আত্মগোপন করে রইল তাদের সামান্য সংখ্যকের কাছে রাইফেল ও স্টেনগান ছিল।

 তৎকালীন ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল যশোরে। বেশীর ভাগই বাঙ্গালী। ক্যাপ্টেন হাশমত (পদাতিক বাহিনী) ও ক্যাপ্টেন আওলাদ হোসেন (সিগন্যালস) এই দু'জন ছিলেন বাঙ্গালী অফিসার। ২৬শে মার্চ আমি ক্যাপ্টেন হাশমতের কাছে আমাদের বিদ্রোহ করার খবর জানিয়ে তাদেরকেও জরুরী অবস্থা গ্রহণ করতে অয়ারলেসে খবর পাঠাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার সেখানকার বাঙ্গালী সুবেদার ও জওয়ানদের দৃঢ় মনোবল সত্ত্বেও এই দুজন অফিসার আত্মগোপন করে। পরবর্তী এক সপ্তাহকাল পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র সৈন্যদল নায়েব সুবেদার আবদুল মালেকের নেতৃত্বে সীমিত কিন্তু প্রচণ্ডভাবে লড়াই শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা বেনাপোলের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নাভারন থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়। তৎকালীন লেঃ হাফিজের মুখে শুনেছি, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তাঁর এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে লেঃ হাফিজ ও ইপিআর বাহিনীর সাহায্যার্থে বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পরেন এবং নাভারনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লেঃ কর্নেল মেঘ সিং-এর ২/৩ জন সৈন্য পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, যার পরিণামে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে ভারত তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে বাংলার মাটিতে ঢুকে যুদ্ধে লিপ্ত হবার কাহিনী অস্বীকার করে। লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তার সৈন্যদের নিয়ে নিজের মাটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

 অপরিহার্য কারণবশত বেনাপোল-যশোর রোডসহ দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে আমার নিয়ন্ত্রণে আসেনি এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত।

 এদিকে মেহেরপুরের তদানীন্তন এসডিও জনাব তৌফিক এলাহি চৌধুরী ও ঝিনাইদহের তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমদ আমার সাথে যোগদান করেন। মাহবুব উদ্দিন সাহেব পুলিশ অফিসার হওয়া বিধায় আমি তখনই তাঁকে ঝিনাইদহ রক্ষণাবেক্ষণের ভার ও ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুল সাহেব সুনিপুণভাবেই ঝিনাইদহে তাঁর কর্তব্য পালন করেন। এপ্রিল মাসের ২/৩ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রফেসর সফিকউল্লাহ সাহেবও আমার সাথে যোগদান করেন। এদের আমি অশেষ দেশপ্রেম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কঠিন সংকল্প দেখতে পেলাম। আগেই বলেঠি আমার কাছে ক্যাপ্টেন আজম ছাড়া দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না। তাই ৭ই এপ্রিল সেক্টর অর্ডার-এর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার জন্য আমি তাদেরকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্কে কমিশন দিয়ে তাদেরকে র‍্যাঙ্ক পরিয়ে দিই। সেক্টর অর্ডারে আমি লিখেছিলাম- “On behalf of the Bangladesh High Command I hereby award Commission to the following persons directly in the rank of Captain to meet operational requirements:—

 (a) Mr. Toufiq Elahi Chowdhury.

 (b) Mr. Mahbubuddin Ahmed.

 (c) Mr. Md. Safiqullah.

 এই তিনজন অফিসারই পরবর্তীকালে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সেক্টরে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেছেন। তাদের বীরত্ব ছিল সত্যিই অতুলনীয়।

 কুষ্টিয়া যুদ্ধের পর ২রা এপ্রিল প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের দুঃখময় পরিণামের খবর আমার গোচর করা হয়। আরও বলা হয় যে তাদের কিছুসংখ্যক লোক পালিয়ে চৌগাছায় একত্রিত হয়েছে এবং লেঃ হাফিজ নামে একজন বাঙ্গালী অফিসারও সেখানে আছে। ঐদিনই আমি আমার কাছে উপস্থিত হবার জন্য লেঃ হাফিজকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলাম, কিন্তু হাফিজ আসেনি। ৪ঠা এপ্রিল তাই ঝিনাইদহের কমাণ্ডার মিঃ মাহবুবকে লেঃ হাফিজের খোঁজে পাঠাই। লেঃ হাফিজ তার ২/৩ জন লোক সাথে করে মাহবুবের গাড়ী করে আমার কাছে উপস্থিত হয়। তার কাছে প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের করুণ কাহিনী বিস্তারিত জানতে পারলাম এবং আমার খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে দেখা না করার একটা কারণ খুঁজে পেলাম। যাই হোক, আমার পরিষ্কার মনে আছে যে আমার অধীনস্থ উপিআর বাহিনীর জামা-কাপড়, ইউনিফর্ম, বুট, ইকুইপমেণ্ট এবং কুষ্টিয়া থেকে অধিকৃত ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গাড়ী দিয়ে ওদেরকে সজ্জিত করে চৌগাছা এলাকায় সন্নিবেশিত করলাম।

 পূর্বেই বলেছি যে বিশাখালী (ঝিনাইদহ থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে) যুদ্ধের পর আমার সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনকে অগ্রগামী করে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে রেখেছি। তার করণ ছিল এই যে, ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আমার অবস্থান তাদের দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা। দ্বিতীয়ত আমার কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিশ্রুত ভারী অস্ত্রাদির অপেক্ষায় থাকা ও একইসঙ্গে ক্যাণ্টনমেণ্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখা। পরিকল্পনা ছিল, ভারত থেকে কিছু পরিমাণ ভারী অস্ত্রাদি পেলেই আমরা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করব। এদিকে ঐ অস্ত্র আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুকূলে চলে যাচ্ছে, কারণ জল ও আকাশ পথে তাদের রি-ইনফোর্সমেণ্ট পুরোদমেই চলছিল। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে প্রতি পলে পলে সিচুয়েশন রিপোর্ট দিয়েও শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অবশ্য এটা যে শুধু আশ্বাসই ছিল তখন তা বুঝতে পারিনি। এভাবে কেটে গেল ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন।

॥ গোয়ালন্দে প্রতিরোধ ॥

 ১২ এপ্রিল খবর আসল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে পারলাম এদেরকে যদি গোয়ালন্দে নামতে দেয়া হয়, তাহলে আমার যশোর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী থেকে কোনরকমে এক প্লাটুন সেন্য ২টি এলএমজি, ১টা এমজি ও একটা ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ছোট কামান সহকারে পাঠিয়ে দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে গোয়ালন্দে। তাদের উপরে আমার নির্দেশ ছিল যে, পাকসেনারা যেন কোনমতেই পদ্মার এপারে অবতরণ করতে না পারে। ১৩ই এপ্রিল এই অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পারে আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে খবর পেলাম যে পাকবাহিনী একই সময়ে নগরবাড়ীতে অবতরণ করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলাম নগরবাড়ীতে যদি পাকবাহিনী বিনা বাধায় নামতে পারে, তাহলে তারা পাবনা-ঈশ্বরদী হয়ে আমার পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। তাতে আমার পজিশন অত্যন্ত সংকটময় হয়ে যাবে। তাই রাজশাহীতে যুদ্ধরত মেজর মরহুম নজমুল হককে টেলিফোন করে নগরবাড়ীতে এক কোম্পানী সৈন্য জরুরী ভিত্তিতে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি যদিও এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তারা সময়মত পৌঁছতে পারেনি।

 এদিকে শুনতে পেলাম তদানীন্তন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন খোন্দকার নজমুল হকের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী পরিমাণ মুজাহিদ ছিল নগরবাড়ী রক্ষণাবেক্ষণে লিপ্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২/৪টা গোলা নগরবাড়ীতে পড়বার সাথে সাথেই তারা সব পালিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল পুরাপুরিভাবে নগরবাড়ীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। অবতরণের পর পরই পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকবাহিনী ভেড়ামারায় অবতরণ করে। ভেড়ামারার কমাণ্ডে তখন ছিল সুবেদার মেজর মুজাফ্ফর। উপায়ান্তর না দেখে সে তার সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটে যায়।  ওদিকে যুগপৎভাবে পাক সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী যশোর থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মত সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিল না। কাজেই, আমার সম্মুখভাগ (ফ্রণ্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দুই দিক থেকেই সৈন্য দের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃপ্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পোড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়।

 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উদ্বোধনঃ অপর পক্ষে ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপর চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থির করলেন যে চুয়াডাঙ্গার কোন মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হল আমারই পূর্বতন ইপিআর কোম্পনী হেডকোয়ার্টার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। সময় সকাল ১০ ঘটিকা। আমি যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্ণেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হল। ওদিকে প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপিতে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি'র দুরত্ব ছিল প্রায় ৬০০ গজ। বিওপিতে থাকবার মত কোন ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাক্রমে প্লেস করিয়ে গাড়ীতে করে আমার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে এই প্রথমবারের মত ভারতে পদার্পণ করি।

 সে রাতে সামান্য একটা ঘটনার কথা কোনদিন ভুলতে পারব না। ঘটনাটা হল এই যে, ভারতীয় মাটিতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী নিজেকে অত্যন্ত অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতে কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হল আবার সেই ইছাখালীতে। বিওপি'র ভাঙ্গা ঘরে ছিল না কোন বিছানাপত্র, ছিল না কোন শোবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিল।

 পরদিন ১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে লোকারণ্য। অথচ তখনও আমি মেহেরপুরে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত সরকারকে সালাম দেবার কথা আমারই কিন্তু এদিকে নিশ্চিত না করে রওনা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিক সমভিব্যহারে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছে যান অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যেরা। ভাগ্যবশত তৌফিক এলাহি ও মাহবুবকে আমি ভোর ৭টায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওখানে। ত্রস্ত গতিতে মাহবুব উপস্থিত কিছুসংখ্যক যুদ্ধক্লান্ত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদের মিলিত সৈন্যদের একত্রিত করে সদ্য আগত প্রেসিডেণ্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম প্রদান করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন হাফিজ, আমার স্ত্রী-কন্যা এবং সামান্য সৈন্য সমভিব্যহারে সেখানে উপস্থিত হই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা ও সনদপত্র পাঠের পর এই নবগঠিত সরকারকে আমি সামরিক অভিবাদন দিই। তারপর আনুষঙ্গিক আলাপ-আলোচনা, পরিচয়, ভাষণ ও সবশেষে মধ্যাহ্ন ভোজের পর এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

 গৌরবের বিষয় যে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হবার পর আবার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার উন্মেষ অনুষ্ঠানের মত এতবড় একটা ঐতিহাসিক পর্বে স্বাধীণতা যুদ্ধে লিপ্ত কমাণ্ডারদের মধ্যে একমাত্র আমিই এবং বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধি হিসাবে আমার স্ত্রী সেখোনে উপস্থিত ছিলেন।

 ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আড়ম্বরহীন সদর দপ্তর ইছাখালী বিওপিতে।  এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না, সাথে নিয়ে নেয়ার জন্যে। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরও কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের প্রচেষ্ঠায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধ মণ সোনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউর ও আটা ছিল সবগুলো আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেই।

 ১৮ই এপ্রিল সকাল বেলা ঐ সীমান্তে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বাধীনে এক কোম্পানী সৈন্য রেখে বাকী ও সদর দপ্তর নিয়ে আমি চলে যাই বেনাপোলে এবং সেখানে স্থাপন করি আমার সদর দপ্তর। ঐ দিনই আমি বেনাপোল ও যশোর রোড এবং তার দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্বভার প্রত্যক্ষভাবে নিজের অধীনে নিয়ে বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ গঠন করি। ২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি. ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) বেনাপোল আমার সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। বেনাপোলে তাকে যথাযথভাবে সামরিক সালাম দেওয়া হয়। আমি সেনাপতিকে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিই এবং আমার সামরিক সরঞ্জামাদি অভাব সম্বন্ধে তাকে অবগত করাই।

 বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ স্থাপন করি বটে কিন্তু প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজ-সরঞ্জামাদি যে আমার ছিল না, তা পূর্বেই বলেছি। এই প্রতিরক্ষাব্যূহের সবচেয়ে মারাত্মক দূর্বলতা ছিল যে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের সাপোর্টিং অস্ত্রশস্ত্র ছিল না এবং ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন এবং ডিগিং যন্ত্রপাতির মারাত্মক অভাব। এতসত্ত্বেও ২টি কোম্পানী ইপিআর সৈন্যনিয়ে আমি এই প্রতিরক্ষাব্যূহ যতাযথ সম্ভব পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমার কছে মাত্র ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও কিছুসংখ্যক গোলা ছিল, সেগুলো আমি রিজার্ভে রেখেছিলাম স্থান ও কালভেদে প্রয়োজনমত ব্যবহার করার আশায়। এই প্রতিরক্ষাব্যূহে আমার সাথে ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমান মেজর) ও ডাঃ আসহাবুল হক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (বর্তমান মেজর) ১০ই এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমার সাথে যোগদান করেন। প্রথম বঙ্গশার্দূল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০জন সৈন্য নিয়ে হাফিজকেও বেনাপোল কাস্টম কলোনীর দক্ষিণ ভাগে রিজার্ভ বাহিনী হিসাবে পজিশন নেবার জন্য নির্দেশ দিই।

 ২৩শে এপ্রিল সকাল ১০টায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দিন আমার সদর দপ্তর বেনাপোলে এসে উপস্থিত হন বাংলার মাটিতে বৃটিশ এম-পি মিঃ ডগলাস ম্যানকে স্বাগত জানানোর জন্য। দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বৃটিশ অতিথি আমার সদর দপ্তরে এসে মাননীয় তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ১ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন। সুখের বিষয় এই যে, বৃটিশ এম-পি ভারত থেকে এসে বাংলায় পদার্পন করার সাথে সাথেই আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকা দেখতে পান ও তার পতপত আওয়াজ শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হন আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনায়। মাননীয় অতিথি বিদায় নেবার ১ ঘণ্টা পরে জনাব তাজউদ্দিন মুজিবনগরে চলে যান। তিনি বিদায় নেবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩ টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের উপর আঘাত হেনে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ কাগজপুকুর থেকে বেনাপোলের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। যাই হোক রাতারাতি আবার আমরা নতুন করে প্রতিরক্ষা পজিশন সংগঠিতকরে নিই।

 ২৪ শে এপ্রিল ভোর ৪টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সহকারে আমাদের পজিশন আক্রমণ করে। আমার বাম দিকের কোম্পানী পজিশনে প্রথম আক্রমণ করা হয়। ২ কোম্পানীন মধ্যে যোগাযোগের জন্য রানার ব্যতিরেকে আমার আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অন্ধকারে এই কোম্পানীর সাথে তুমুল যুদ্ধ চলে। ভোর ৬ টায় একটা ১ টন ডজ গাড়ীতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলো পাঠিয়ে দিই তাদের সাহায্যার্থে। তার কিছুটা অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এমন সময় শত্রুর আক্রমণের চাপে আমার ভাইটাল পজিশন থেকে এমজিওয়ালা তার এমজি সহকারে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ঠিক সে সময় পূর্বতন হাবিলদার মেজর তখনকার নায়েক সুবেদার মুজিবল হক সেখানে উপস্থিত হয় এবং তার কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ঐ ভাইটাল পজিশন তেকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর সুইপিং ফায়ার চালাতে থাকে। সুবিধা ছিল এই যে শত্রুর অবস্থান ছিল তখন খোলা এবং নিচু জায়গায়। মুজিবুল হকের এই তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষের অধিকাংশ সৈন্য ধরাশায়ী হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রায় ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়।

 ওদিকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন আমার ডানদিকের কোম্পানীন উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৬ টায়। তারা এসেছিল ইপিআর পোশাক পরে। কাজেই, প্রথমতঃ আমার ইপিআর বাহিনী ধোঁকা খেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষনেই তারা এই চালাকি বুঝতে পেরে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা চালায়। ওদিকে মুজিবল হকের একক অথচ তীব্র এমজি'র সুইপিং ফায়ারে যখন শত্রুসৈন্য বিধ্বস্ত প্রায়, তখনই ডানদিক থেকে ইপিআর পোশাকের বেশে ১ প্লাটুন শত্রুসৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়। মুজিবল হক তাদেরকে দেখতে পেয়েও ইপিআর বাহিনী ভ্রমে তাদের উপর ফায়ার করেনি। এটাই হল তার ও আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। প্রকৃত এম-জি ম্যান ল্যান্স-নায়েক বার বার মুজিবল হককে হুঁশিয়ার করা সত্ত্বেও সে ইপিআর বাহিনী বলে শত্রুর উপর ফায়ার করতে অস্বীকার করে কিন্তু মিনিট পরেই এই ইপিআর-বেশী শত্রুপ্লাটুন তার উপর হামলা চালায়। শত্রুর এল-এম-জি'র বুলেট মুজিবল হকের বক্ষ ভেদ করে তক্ষণই তার জীবন শেষ করে দেয় (ইন্না....রাজেউন)। এল-এম-জি ম্যান হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নায়েক সুবেদার মুজিবল হকের অপরিসীম সাহস, কৃতিত্ব ও আত্মত্যাগের ঋণ বাংলার জনসাধারণ কোনকালেই শোধ করতে পারবে না। প্রতক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, মুজিবল হকের এম-জি সহকারে তীব্র যুদ্ধে আনুমানিক ১৫০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়, যার জন্য সাময়িকভাবে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত হয়। ইত্যবসরে, আমার বামদিকের কোম্পানী মুজিবল হকের ফায়ারের আড়ালে থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। ওদিকে ডানদিকের কোম্পানীও সাপোর্ট ফায়ারের অভাবে ক্ষণিক যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী এলাকায় অপসারণ হয়। দুঃখের বিষয়, মুজিবল হকের পতনের সাথে সাথেই আমার মর্টার বাহিনী মর্টার গুটিয়ে গাড়ীতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু অল্প দূরে শত্রুসৈন্যের অবস্থান লক্ষ্য করে ড্রাইভার গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাস্তার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমাণ্ডার মোমিনুল হককেও একই পদ্ধতিতে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। গাড়ী ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।

 এদিকে সীমান্ত এলাকাকে আমার বাহিণী প্রাণপণে শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকে। সমস্ত দিন গোলাগুলির পরেও শত্রুসেনারা আমার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারেনি। এবং আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকার পতপত ধ্বনিকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কোন দিন স্তব্ধ করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পতাকা উড্ডয়নরত থাকে।

চুয়াডাঙ্গা-কুষ্ঠিয়া প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এ, আর, আজম চৌধুরী

২৬-৩-৭৩

 আমি তখন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ৪ নং উইং-এ একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করছি। ২৩শে মার্চ আমাদের সীমান্ত পরিদর্শনে যাই। ফিরি ২৫ শে মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। মেজর ওসমান চৌধুরী ২৫ শে মার্চ কুষ্ঠিয়া গিয়েছিলেন, ২৬ শে মার্চ বেলা ১২ টার দিকে চুয়াডাঙ্গাতে আসেন।  যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ইপিআর মেজর চুয়াডাঙ্গাতে যান আমাদের সকল অফিসারকে 'আনবার জন্য কনফারেন্সের নাম করে ২৫ তারিখ সকাল ১০টার দিকে।

 রাতে ফিরে শুনলাম যশোরের মেজর চুয়াডাঙ্গায় অবাঙ্গালী ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেকের বাসায় আছেন। ২৬ শে মার্চ সকাল সাড়ে ছ'টার দিকে মেজনসহ ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবার আমার বাড়িতে আসে। আমি বাথরুমে ছিলাম। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেজর বললো “এতনা জলদী আগিয়া”? আমি বললাম, হ্যাঁ, কাজ শেষ হয়ে গেছে।' আমি মেজরকে দুপুরের খানা খেয়ে যেতে বললাম। অবাঙালী মেজর রাজী হল না।

 ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর হতে আমাদের কাছে চিঠি আসে কত পাঠান এবং পাঞ্জাবী পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে আছে তার একটা তালিকা পাঠাতে। আমরা পৃথক পৃথক ভাবে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সে তালিকা পাঠিয়ে দেই। ২৬ শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন সাদেকের স্ত্রী আমার আম্মার সাথে কান্নাকাটি করলেন। কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলেন না। তিনি শেষবারের মত বললেন, ঢাকাতে যদি থাকি তো আবার দেখা হবে। ক্যাপ্টেন সাদেকের ফ্যামিলিকেই একেবারেই শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়।

 আমি সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে যাই এবং ইপিআর সুবেদার আমাকে বললো যে, পাঞ্জাবী মেজর এখানে সকল পাঞ্জাবী এবং পাঠানদের ডেকে পাঞ্জাবীতে কি বলে গেছে। আমার তাতে সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো।

 ২৬ শে মার্চ সকালে আমাদের অফিসে অয়ারলেসের মাধ্যমে জানলাম ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে পাক আর্মি ট্যাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে চলেছে-খবর আসল ৮/৯ টার দিকে।

 সকাল ৯টার দিকে হাবিলদার মুজিবর রহমান আমাকে এসে বলে যে, আমরা বিদ্রোহ করবো। আমি মুজিবরকে নিষেধ করি এবং বলি যে কোভের চাবি তুমি রেখে দাও, (কোতের চাবি আমি যখন সীমান্তে যাই তখন ওর কাছে দিয়ে গিয়েছিলাম) কোয়ার্টার গার্ডে যে পাঞ্জাবী আছে তাদের ছুটি দিয়ে দাও এবং সকল পাঠানদের উপর নজর রাখ। শহীদ মুজিবর আমাকে আরও খবর দেয় অবাঙালীদের কার কার কাছে গুলি এবং অস্ত্র আছে। আমি বললাম আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার মেজর ওসমান যখন বাঙালী তখন তাঁর আসা পর্যন্দ আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।

 আমি ভারাক্রন্ত মন নিয়ে বাড়ি যাই। ১১/১২ টার দিকে মেজর ওসমান আসার সাথে সাথে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলি এবং রাজকীয় মর্জাদা দিই। অবাঙ্গালী যত ছিল তাদের অস্ত্রহীন করে এক ঘরে বন্দী করে রাখি।

 ২৬শে মার্চ বেলা ১১ টার দিকে যশোর হেডকোয়ার্টার থেকে লেঃ কঃ মোঃ আসলাম (অবাঙ্গালী) যাত্রা করে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে কিছু সৈন্য, দুটো গাড়ী এবং অয়ারলেসসহ। এই খবর আমরা যশোর ইপিআর ক্যাম্প থেকে পেলাম অয়ারলেসে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর ওসমান আমাকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পজিশন নিতে বলেন। যশোর হেডকোয়ার্টার হয়তো খবর পেয়েছে যে, আমরা বিদ্রোহ করেছি। লেঃ কঃ আসলাম বারবাজার পর্যন্ত এসে এই সংবাদ শুনে ফিরে যায়।

 ইতিমধ্যে আমরা ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ করি। ৭৬ বিএসএফ কমাণ্ডার লেঃ কঃ চক্রবর্তী এবং আইজি, ডিজি সবাই গেদেতে রয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। আমাকে মেজর ওসমান বেলা চারটার দিকে গেদেতে যাবার জন্য বলেন। আমি রওনা হয়ে গেলাম। আমরা ‘সাউফ-ওয়েষ্ট-কমাণ্ড' হিসেবে পরিচয় দিয়ে কাজ করতে থাকি। বেলা পাঁচটার দিকে গেদে পৌঁছালাম। ভারতীয় অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমার পুরা ইউনিফরম ও আর্মসহ তিনজন গার্ড ছিল। আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ভারতীয় বিএএফ ক্যাপ্টেন মহাপাত্র। ক্যামেরাম্যানরা আমার ছবি তুলবে বলে আমি গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে বর্ডার পার হই। আমি মেজর ওসমানের পত্র দিই। সেখানে একটি আর্টিলারী ব্যাটারী, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক, এক ইনফ্যাইণ্ট্রি ব্যাটালিয়ন সৈন্য যশোর আক্রমণের জন্য চাইলাম। ভারতীয় প্রধান বললেন, আমরা সরাসরি সাহায্য করতে পারছি না, তবে গোপনে আপনাদের সাহায্য করবো এবং আপনাদের এই চাহিদা দিল্লী নিয়ে যাচ্ছি আলোচনার জন্য। আমি আবার দেখা হবে বলে চলে আসি।

 ২৮ শে মার্চ থেকে ট্রেন চালু হয়ে যায় ভারত সীমান্ত থেকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় নাগরিকরা সাবান, পেট্রোল, খাবার, ঔষুধপত্র ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস নিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করতে থাকে।

 ২৬ শে মার্চ রাতে মেহেরপুরে এসডিও তৌফিক এলাহি সাহেব এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবুউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় কুষ্ঠিয়া সম্পর্কে। কুষ্টিয়াতে ইতিমধ্যে পাক সৈন্য চলে এসেছিল। কিভাবে আক্রমণ করা হবে এ বিষয়ে আমরা মত বিনিময় করি।

 কুষ্টিয়াতে কত পাকিস্তানি সৈন্য আছে তা জানবার জন্যে ইপিআর ক্লার্ক বারি এবং আরো দু'একজনকে পাঠাই। কুষ্টিয়াতে কত সৈন্য ছিল তার সঠিক সংখ্যা পেলাম না। মেজর ওসমান আমাকে ২৯ তারিখে কুষ্টিয়া আক্রমণ করতে বললেন।

 তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণ করার প্ল্যান হয়। একটি দল যায় ভেরামার তারাগঞ্জ হয়ে এবং দ্বিতীয় দল নিয়ে আমি নিজে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ হয়ে যাই। তৃতীয় দল যায় ঝিনাইদহ এবং কুষ্টিয়ার মাঝে তারাগঞ্জ দিয়ে। সার্বিক ভাবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম আমি। আমরা প্রাথমিক অবস্থায় ২০০ জনের মত ছিলাম। পরাগপুর-ভেরামারার নেতৃত্ব দিচ্ছিল সুবেদার মজাফফর আহমদ।

 ২৯ তারিখে আক্রমণের কথা ছিল, কিন্তু নানা কারণে ওই তারিখে সম্ভব না হওয়ায় ৩০শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় আমরা এক সময়ে তিন ভাগ থেকে আক্রমণ চালাই। সারাদিন আক্রমণ চালাই।

 ৩১ শে মার্চ কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। ২৫০ জন পাক সৈন্য মারা যায়, কিছু ধরা পড়ে লেঃ আতাউল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ২জন মারা যায়, কিছু আহত হয়।

 ৩১ শে মার্চ সকাল ১০ টার দিকে পাক বাহিনীর বিমান এসে বোমাবর্ষণ করে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে, কেউ মারা যায়নি। ঐ দিনই আমি টেলিফোন মারফত মেসেজ পেলাম আমাকে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমি ১ লা এপ্রিল যশোরের দিকে রওনা হই।

 ৩১ শে মার্চ সকাল ৯ টার দিকে বিশখালীতে যে দল আমাদের ছিল তাদের সাথে যশোর থেকে আগত পাক বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। যশোর বাহিনী কুষ্টিয়ার দিকে যাচ্ছিল সাহায্যের জন্য। কিন্তু ব্রিজের ওখানে ব্যারিকেড থাকায় তারা যেতে পারেনি। ওখানে মুক্তি বাহিনীর ২ জন মারা যায় এবং ৩/৪ জনকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। যশোর সেনানিবাস থেকে ৭ মাইল দূরে আমরা পজিশন নিই। মেজর ওসমানের নির্দেশক্রমে আমরা দূরে ঘাঁটি গাড়ি। কেননা ভারত থেকে ভারী অস্ত্রের অপেক্ষা করছিলাম। আমার হেডকোয়ার্টার ছিল ঝিনাইদহ। আমার একটি পেট্রোল ছিল মাগুরার এসডিও'র সহযোগিতায় লেবুতলায়। সুবেদার আব্দুল মুকিদ ছিল কমাণ্ডিং অফিসার। ৫/৬ ই এপ্রিল পাক বাহিনীর একটি সার্চিং পার্টি লেবুতলার দিকে নিয়ে আসে রেকি করতে। আমাদের দল তৈরী ছিল, কারণ আগে থেকেই আমরা জানতাম যেহেতু যশোর-কুষ্টিয়া রোডে আমরা আছি তাই অন্য দিকে নিশ্চয় গ্যাপ খুঁজতে আসবে। এ্যামবুশে পাক বাহিনীর ১৫/১৬ জন মারা যায়, একজন লেফটেন্যাণ্টসহ। আমরা বহু ম্যাপ, নোটবুক উদ্ধার করি। মর্টার ফায়ার করে পাক বাহিনী তাদের মৃত দেহ নিয়ে যায়।

 ইতিপূর্বে ২৭/২৮ তারিখের দিকে লেঃ কঃ জলিলের (১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) কাছে আমরা দু'বার মেসেজ পাঠাই আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তখন কর্নেল জলিল সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাসলিয়াতে ছিলেন।  ৫নং খুলনা উইং-এ আমরা ২৭/২৮ তারিখেই খবর পাঠিয়েছিলাম বেনাপোলে জমায়েত হবার জন্য। নির্দেশ দিল, ইতিমধ্যে যদি কোন অবাঙ্গালী অফিসার তোমাদেরকে নিরস্ত্র করতে চায় তা হলে তাকে বন্দী অথবা হত্যা করবে।

 ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেক ২৭ শে মার্চ খুলনা বিওপিতে যায় নিরস্ত্র করবার জন্য। কিন্তু রক্ষী তাকে চ্যালেঞ্জ করলে ক্যাপ্টেন পিস্তল দিয়ে রক্ষীকে হত্যা করে। পরে বিওপির ভিতর থেকে গুলি করে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেনের সঙ্গীরাও প্রাণ হারায়। সমগ্র যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকা আমাকে দেখতে হতো, ফলে কোথাও ২/৪ ঘণ্টার বেশী অবস্থান করতে পারতাম না।

 ১০ই এপ্রিল ঝিকরগাছা যাই ৫নং উইং দেখবার জন্য। কিন্তু পাকবাহিনী তখন অগ্রসর হয়ে পথ বন্ধ করে ফেলে এবং সংঘর্ষ হয়। আমি ভারত সীমান্ত ঘুরে ১১ ই এপ্রিল বেনাপোল আসি।

 ১১ তারিখে ৭২ নং বিএসএফ -এর কর্নেল কে, বি, সিংহ বিএসএফ আইজি, ৫নং গার্ডস-এদের সাথে আলাপ-আলোচনা করি এবং গত কালের যুদ্ধের ঘটনা বলি। আমি দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা আসি এবং মেজর ওসমানকে যুদ্ধের কথা বলি। ঝিকর গাছা থেকে ওই দিনই ঝিনাইগহে রাত ১০ টায় পৌঁছে যাই।

 ১২ই এপ্রিল বারবার থেকে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর মেসেজ পেলাম যে ওখানে ভীষণ আর্টিলারী এবং ভারী অস্ত্রের আক্রমণ চালাচ্ছে পাক বাহিনী। সে আমার কাছে মতামত চাইল। আমি তাকে কালিগঞ্জ চলে আসতে বলি এবং আমাদের বাহিনীকে কালিগঞ্জ এবং বারবাজারের মধ্যখানে থাকতে বলি। ওখানেও আমাদের বাহিনী বেশ কিছু অস্ত্র এবং সেনা হারিয়ে ফিরে আসে।

 ১৩ই এপ্রিল পাক বাহিনী কালিগঞ্জ দখল করে নেয়। ১৪ই এপ্রিল আমি চুয়াডাঙ্গা আসি। ১৪ই এপ্রিল পাক বাহিনী ঝিনাইদহ চলে আসে। ১৫ ই এপ্রিল আমরা মেহেরপুরে ঘাঁটি সরিয়ে নেই।

 ১৬ ই এপ্রিল মেহেরপুর থাকলাম। ঐদিন রাতে ইছাখালী বিওপিতে থাকি। ১৭ই এপ্রিল খুব ভোরে মুজিবনগরে বৈদ্যনাথতলা যাই মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য। ইপিআর-এর একটি কোম্পানি নিয়ে গিয়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন ইপিআর বাহিনী সব বেতাইয়ে একত্র হয়। সমস্ত এপ্রিল মাসটা সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। মে মাস থেকে কোম্পানী ভাগ করে দেওয়া হয়।

কুষ্টিয়া-যশোরের সস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মোহাম্মদ তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী

১৪-১০-৭৩

 ২১/২২/২৩ শে মার্চ আমরা নিম্নলিখিত কয়েকজন অফিসার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমেদের বাসায় (ঝিনাইদহে) একত্রিত হইঃ ১। তৌফিক এলাহি, এসডিও, মেহেরপুর, ২। কামালউদ্দিন সিদ্দীকী, এসডিও, নড়াইল,৩। ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও, মাগুরা, ৪। শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, এসডিও, গোয়ালন্দ।

 আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে একটা সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত। এই বৈঠকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি আমার এলাকায় সমস্ত থানার পুলিশদের প্রস্তুত রাখি।

 ২৫ শে মার্চ রাতে নূরুল হক এম-পি আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাক সেনা বাহিনী শহরে বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের উপরআক্রমণ চালিয়েছে।  আমি তাকে আমার বাসায় অবিলম্বে আসতে অনুরোধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছেন এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যোগাযোগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, ‘যা বলার বলেছি ত, আর বিরক্ত করবেন না।' আবার অনুরোধ করার পর আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না।

 ২৫ শে মার্চ রাত বারটায় মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহূথে থেকে আমি আর পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না। এবং জনগনের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম।

 ২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকাসড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরী করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মেহেরপুর কুষ্টিয়া রাস্তায় খলশাকুণ্ডী কাঠের পুল ভেঙ্গেচুরে দেয়া হল। এক দল যুবক এই পুলটা ভেংগে দিয়েছিল।

 মেহেরপুরে আনসার কমাণ্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্রিত করার জন্য।

 ২৬শে মার্চ ভোর বেলা। আমার ধারণা হয়েছিল মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার মধ্যে নবরূপান্তরিত সত্তার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লোক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধূরা পর্যন্ত এই স্বঃস্ফূহর্ত গণজাগরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে একাত্মতা অনুভব করেছিল। সেই মুহূর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে পেলাম।

 সমগ্র পরিস্থিতির আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিরোধের পটভূমিকায় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যূত্থান ভারতের সমর্থন পাবেই। তাই ২৬ শে মার্চ সকালে আমি দু'রকম চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠানো হয়েছিল নদীয়া জেলা প্রশাসকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল চক্রবর্তী (সিও ৭৬ বিএসএফ, বা মেহেরপুর সীমান্তের ভারতে মোতায়েন ছিল) এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি ভারতবর্ষের জনগণকে উদ্দেশ্য পাঠাই। দুটো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারি সিলমোহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা ‘অমৃত বাজার' এবং 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ- এর সংখ্যাগুলোতে। 'ডেস্টিনেশন মুজিবনগর' বইটিতে একটা চিঠির ফটোস্টেট কপি মুদ্রিত হয়েছে।

 প্রথম চিঠিটা নদীয়ার জেলা প্রশাসক মিঃ মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে এই চিঠিটা দিল্লীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯ শে মার্চ বেতাই (ভারতে) বিওপিতে আমাকে দেখা করার খবর পাঠানো হয়।

 ২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যাই নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছোট দল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। আমি এবং কর্নের চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয়া জেলা প্রশাসক আমাকে আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন।  আমাদের বৈঠক এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। আপ্যায়নের মাধ্যমে মিঃ মূখার্জী আমাকে জানান যে, আমার চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাকে শীঘ্রই জানানো হবে এবং তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাদের সংগ্রামে ভারতের জনগণের ও সরকারের সমর্থন জানান এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পোস্টের অদূরে ভারতীয় বিওপিতে কোন একজন সামরিক অফিসারকে সাথে নিয়ে দেখা করি আমাদের সামরিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় তদানীনতন ইপিআর এর উইং কমাণ্ডার মেজর ওসমানের সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

 ৩০শে মার্চ সকালে মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইল দূরে চুয়ায়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে যাই। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তিনি পরামর্শ দেন যে আমি মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ (তদানীন্তন ঝিনাইদহের এসডিপিও)-কে সাথে নিয়ে যাই। আমি মাহবুবকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প সময় পরে হঠাৎ সে মেজর ওসমানের চুয়াডাঙ্গা অফিসে আবির্ভূত হয়। মাহবুবকে আমি ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাকে বলি ঐ দিন সন্ধ্যায় ভারতের চেংখালী চেকপোস্ট বিপওপিতে কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিতে আমার সাথে আসতে এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে বিশদ আলোচনা করতে। আমি তখন অত্যাধিক উত্তেজিত ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম মাহবুবও কম উত্তেজিত ছিল না। কারণ একটু পরে বুঝতে পারলাম মাহবুব আমাকে অদূরবর্তী একটি জীপের কাছে নিয়ে চলল এবং খুব গোপনে বলল (মেজর ওসমান ও এ ঘটনা সম্বন্ধে তখন অবহিত ছিলেন না) যে, ঐ জীপের বিতরে ২ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বসে আছেন এবং তারা হচ্ছেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (বর্তমান খাদ্য প্রতিমন্ত্রী)। আমরা দু'জনে জীপের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত এবং পুঁটুলি হাতে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত এই দুই ব্যক্তিই অবশ্য পরে বাংলাদেশের স্বধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

 আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারলাম তাঁরা বিভিন্ন জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসেছেন এবং সেখান থেকে মাহবুব তাদেরকে মেহেরপুরে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং আক্রমণকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বন্দু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। সত্যি বলতে কি, তাঁদের এই বৃহত্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য আমি তখনো উপলব্ধি করতে পারিনি। সিদ্দঅন্ত হল যে, ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈঠকে মিলিত হব। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সীমান্তের অপর দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। শর্ত হল একটা, আমরা যাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাদের কাছে এই দুই জনের পরিচয় গোপন রাখব। তারা জানতে চাইলে আমরা বলব, এই দুই ব্যক্তি আমাদের পরিচিত।

 বিকালে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটো জীপ রওয়ানা দেয়। পথে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু'পাশে জনতা মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ী যেন তাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমরা কোন গোপন মহৎ সামরিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘোরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বতঃস্ফূর্ত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল, অস্ত্র বলতে হয়ত একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস, এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষে জনশক্তি এবং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে।

 সন্ধ্যার পরে পরে আমরা চেংখালী চেকপোস্ট পৌঁছালাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু'পাশ থেকে রাস্তার উপরে একটা ছাতার মত আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লোকালয় জনপদ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, চারদিক পরিবেশ ধু-ধু খাঁ খাঁ করছিল। শুক্লপক্ষের ম্লান চাঁদের আলো পরিবেশকে আরো গভীরতর করে তুলেছিল। পিছনে গাড়ী দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে এবং সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্তাজের উপর ভর করে এগুচ্ছিলাম। বারবার আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ সেই ভুতুরে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম-‘হলট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝোপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে আসল। এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরো আধা মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌঁছালাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন বিএসএফ-এর উচ্চপদস্থ কর্মচালী জনাব গোলাম মজুমদার এবং লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল চক্রবর্তী। আনুষংগিক আলোচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হলঃ ১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে এবং ২। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লাগের রাজনীতিবিদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ করার। তখনো তারা জানতেন না যে আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন।

 আমি এবং মাহবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দিন রয়েছেন তা গোলক মজুমদারকে জানাব এবং গোলাম মজুমদারকে জানালাম। গোলক মজুমদার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাড়াতাড়ি কাজউদ্দিন সাহেবকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দি কে তার কাছে নিয়ে আসলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গোলক মজুমদার আমাদেরকে বলেছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে একটি সামরিক জেট বিমান অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবিদ আসে তাকে যেন তক্ষুণি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন।

 রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গোলক মজুমদার, তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান। এবং চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি।

 এই রাতে সাক্ষাৎকারের পর থেকে ভারত থেকে আমরা কমবেশী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং জ্বালানি পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিয়ে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপোস্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতাম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানো ট্রলী। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিও-র সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করতাম।

 মধ্যরাত্রের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌঁছাতাম এবং চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভোর হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিন বিছানায় গা লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্নেল চক্রবর্তী থাকতেন এবং সব সময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেররুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল) থেকে সংগ্রহ করতাম।

 ২৫ মে মার্চ রাতে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্ঠিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাংগার খবরাখবর আমরা নিতে থাকি। আমরা খবর পাই যে চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, চুয়াডাঙ্গার সাধারণ ইপিআর এর জোয়ানরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। চুয়াডাঙ্গার এই সিদ্ধান্তে ইপিআর-এর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ভুমিকা এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের এই সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর এর ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর ভূমিকা এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেজর ওসমান কুষ্টিয়া থেকে ২৭/২৮ শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। দুইজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে থাকি পোশাক পরিহিত এবং সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা জেলার বহুলাংশ, যশোহরের কিয়দংশ এমনকি ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বাংলার সাধারণ জনগণের চোখে স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক হিসেবে প্রতীয়মান ছিল। আজো শহীদ হাবিলদার মেজর মুজিবর রহমান, সুবেদার মুজাফফর, সুবেদার মুকিত এবং আরো অনেক চেনা মুখের কথা বার বার মনে পড়ছে। সেই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এরা আমার জন্যও আশার প্রতীক হিসেবে প্রোজ্জ্বল ছিলেন।

 দু'একদিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাথে মেহেরপুরের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং আমি মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গায় সাক্ষাৎ করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু তাকে অবহিত করি। মেজর ওসমান আমাকে প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্রসম্ভার সম্বন্ধে ধারণা দেন।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গোয়ালন্দের তৎকালীন এস, ডি, ও জনাব মোহাম্মদ ফরিদ সস্ত্রীক মেহেরপুরে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে যান। তাকে মার্চে ২৭/২৮ তারিখে গোয়ালন্দে ফেরত যাবার বন্দোবস্ত করি। জনাব ফরিদ তার স্বীয় মহকুমায় এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য অত্যধিক উৎসাহ দেখান এবং এই দুর্যোগের সময় গোয়ালন্দে ফেরত যান। তিনি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং অমানুষিক ভাবে নির্যাতিত হন। তিনি ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।

 চুয়াডাঙ্গাতে ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচী নেয়া হয়েছিলঃ ১। ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা এবং তার অধীনস্ত সমস্ত বিওপিতে অবাঙালী ইপিআরকে নিরস্ত্র করা, ২। কুষ্টিয়া জেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন সম্বন্ধে বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করা, ৩। কুষ্টিয়ার উপর একটা আক্রমন পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা। এই মিশনে এর জনশক্তি যোগাবে একদিকে ইপিআর, অন্যদিকে আনসার মুজাহিদ এবং সাধারণ ছাত্র জনতা। আক্রমণ এবং অবরোধ মোটামুটি ত্রিমূখী হবে। একদিকে জনাব মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া রাস্তা অবরোধ করবেন এবং ইপিআর আনসার মুজাহিদদের একটি দল কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। অন্য দিকে মেহেরপুর থেকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসারের একটি দল অভিমুখে যাবে। অপরদিকে প্রাগপুর-ভেরামারা-কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।

 প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে এই আক্রমণ ২৯ শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় শুরু করা হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়।

 পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের অনধিক দুই কোম্পানী সৈন্য কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো পাহারা দিচ্ছিল। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে ২২ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের একটা অংশ ছিল। এদের ফায়ার, পাওয়ার, মোবিলিটি এবং কমিউনিকেশন পাকিস্তানের অন্যান্য সাধারণ পদাতিক ব্যাটালিয়নের চেয়ে অনেক বেশি। শহরের উপকণ্ঠে, অনেকটা অবরোধের মত, প্রথমে মুক্তি বাহিনীকে যার মধ্যে ইপিআর রা ছিলেন মূলশক্তি- মোতায়েন করা হয়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরানো ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরনো এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০ রাউণ্ডের মতো গুলি ছিল।

 ৩০শে মার্চ সকালে অবরোধের স্থানগুলো থেকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটি অবস্থানের পিছনে সমবেত হাজার হাজার লোক গগন বিদারী আওয়াজে “জয় বাংলা” ধ্বনি তোলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশফাটা চিৎকারে এবং রাইফেল ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙ্গালী ইপিআর-এর জোয়ারা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে সুসজ্জিত বিক্ষিপ্ত দলগুলো এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপসরণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিজনক। কারণ, তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর এই আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপসরণই তাদের জন্য কাল হল। কারণ প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনোবল ভেংগে যাচ্ছিল এবং আমাদের মনোবল উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলাস্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে। এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমরাও তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরোধের তিন দিক থেকে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দী লেফটেন্যাণ্ট আতাউল্লাহর কাছ থেকে জানতে পারি যে, মেজর শোয়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা রিইনফোর্সমেণ্ট-এর জন্য বার বার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন যশোহর সদর দফতরকে। কিন্তু যশোহর সদর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছিল না। এতে তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফএফ একেবারে ইঁদুরের মত হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুরু করে।

 মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকি দুই কোম্পানির অনধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটা বিরাট খাদ খনন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শোয়েব এবং ২২ এফএফ-এর কিছু অফিসার এবং সৈনিক গাড়ীতে করে যশোহরের দিকে পশ্চাদপসরন করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ায়। এই সংঘর্ষে যদিও অনেক সাধারণ বাংগালী নিহত হয় তবুও ২২ এফএফ-কেউ যশোহর ফিরে যেতে পারেনি। কড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময়বা গাছ থেকে অতর্কিতে সাধারণ জনগণ এদের মোকাবিলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাক সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।

 আজো একটি কিশোরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শর্টগান নিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অনুসরণ করে, যাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজের বুদ্ধিবলে শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ২২ এফএফ পশ্চাদপসরন করে মনোবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে পারত। ২২ এফএফ-এর এই পরাজয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পশ্চিমাঞ্চলকে আমরা পুরোপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেই পারিনি যে এক সুসজ্জিত সেনবাহিনী কিভাবে আবার মরণ কামর হানতে পারে।

 আমার যতদূর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ী, ৬টি আর-আর গান সহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং গোলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সুসজ্জিত করতে থাকি। এই দখলকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ী আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

 এই সময় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফরাসি-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাঙ্গা আক্রমন করে এবং আধঘণ্টা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করে এবং কয়েক জায়গায় বোমা বর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অত্যন্ত সাহসিতার সাথে এই ঘটনার পুরোপুরি আলোকচিত্র গ্রহণ করে, যা সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল এই ছবিগুলো নিশ্চয়ই বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

 এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহন করি। আমরা যশোহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি। মাহবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দুই কোম্পানিরও কম সৈন্য ছিল। উত্তর-পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করি। হার্ডিঞ্জ ব্রীজে আমাদের দুই প্লাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময়কার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 উপরোল্লিখিত কয়েকটি জায়গার সাথে আমরা সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে ছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাক সেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ মোহাম্মদ ফরিদের অনুরোধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গোয়ালন্দে শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমনকি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ি ঘাটে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশোহরে পাকসেনাকে কোণঠাসা করা এবং ঢাকা হতে কোন রকম রিইনফোর্সমেণ্ট বা আক্রমণকে প্রতিরোধ করা।

 সামরিক প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তির কাছে এটা প্রতীয়মান যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীর পক্ষে এই সামরিক ভূমিকা পালন করা অসম্ভব ছিল। এবং কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতি নিতে কোন দিনই সাহস পেত না। তবুও দেশপ্রেমের উন্মাদনা আমাদেরকে পেয়েছিল, তাই যা করা সম্ভব নয় তা করার সাহস এবং প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম।

 এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া যশোর, (শুধু সেনানিবাসকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর,পাবনা রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চর হিসেবে ঘোষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সীলমোহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দেই ৫০০ টাকার উপরে কাউকে কোন পেমেণ্ট না করতে। এমনকি ভারতের সাথে আমাদের এই বোঝাপড়া হয় যে আমার সরকারী সীলমোহর এবং দস্তখত করা সার্টিফিকেট মোটামুটি পাসপোর্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল- অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি এই সময় মেহেরপুরের প্রশাসন ভার মেহেরপুরের সেকেণ্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা গ্রহণ করি।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবারই একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়?

 আমরা উত্তরে জানাই যে, অতিশীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমরা ভারতের টুংগী বিওপি'তে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত্ত করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির পর্যালোচনা করি। তাঁরা আশ্বাস দেন যে অতি শীঘ্রই সরকার ঘোষণা করা হবে।

 এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ও শেষদিক থেকে যুদ্ধ একটি নতুন মোর নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশোর সেনা নিবাসে নতুন ভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমার অভিমত যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি যে বাঙ্গালীরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনোবল ভেংগে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রিইনফোর্সমেণ্ট ঢাকা থেকে যশোর আনা শুরু হয়। আমরাও ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা একসময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশোর সেনানিবাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশোর সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে হয়ত যশোর আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লোকের প্রাণের বিনিময়ে। এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

 এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় বিশাখালীতে। এইখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মোকাবিলা করে। হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘণ্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষা বুহ্য পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। এই প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোবলের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমরা উপলদ্ধি করি যে শত্রুর দূরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেবার মত অস্ত্র আমাদের ছিল না। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারী কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমনের সাথে আমাদের মনোবলও ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমরা ভবিষ্যৎ বিজয়ের কোন সামরিক সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না এবং কোন রণাঙ্গণে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনোবলের উপর যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারবে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। তদুপরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থানগুলোতে খাদ্যদ্রব্য এবং গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলোতে এই বিরুপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যহত থাকে। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসারও কোন সুব্যবস্থা ছিল না। ঔষধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহযেই অনুধাবনযোগ্য যে গোয়ালন্দের মত জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাবৃহৎ কি রকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাক ছত্রীসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ঐ ঘাঁটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নগরবাড়ী ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শত্রুর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ্যাসিক্স-এর অপারেশন চালান।  চতুর্দিকে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভংগ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রুর আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযোগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনোবলও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। চুয়াডাংগা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই।

 প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টঃ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট যশোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল জলিল প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন। ২৫শে মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠানো হয়। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আমি, মাহাবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার 'আহবান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোন চিঠিরই জবাব পাইনি। এ পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট যশোর সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে একজন তরুণ বাঙ্গালী লেফটেন্যাণ্ট আনোয়ার শাহাদাত বরণ করেন। প্রচুর বাঙ্গালী সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙ্গালী সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেকে অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

 ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাঙায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন লোকদের নিয়ে চৌগাছায় একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চুয়াডাঙ্গায় আসে। তার কাছে আমি জানতে পারি যে তারা তখন ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চেষ্টা করছিল। আমরা তখন যৌথভাবে সামরিক পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

 প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনঃ এই সময় আমরা জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। এবং আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমাদের মুক্তাঞ্চল ঘুরেফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকূল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এ রকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। এই সামরিক বিজয় জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প তাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল।

 মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চূড়ান্ত সিন্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশোরের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাবূহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্য আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের সূচনা মাত্র।

 ১২ই এপ্রিল- দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তখন আমাদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যর্থতা আমাদের যোদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমরা খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ই কিংবা ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারনের কাজ শুরু হয়েছে - শহর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা।

 ১৬ই এপ্রিল মাহাবুব (ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একজন অফিসার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ও আমি চুড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটময় সময়। তখন আমরা আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত। পাকিস্তান বাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষাবৃহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনো জানতাম না আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারবো। আমরা দুপুর নাগাদ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। একটা সাধারণ মঞ্চ তৈরী হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ঘেরা। এলাকাটি সীমান্ত ঘেঁষা বলে আমরা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৬তম ব্যাটালিয়নের লেঃ কর্নেল চক্রবর্তীর সাথে এই উপলক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম।

 ১৭ই এপ্রিল আমি আর মাহাবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলি পূর্নাঙ্গ নয়। কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খোয়া গিয়েছে। মণ্ডপ পাহারা দেবার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মত কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মোতায়েন করি। মাহাবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করলো। আমি তখন কর্নেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লোক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তার মধ্যে অন্ততঃ শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান।

 নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্যদৃষ্টির ভাষা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখেছে- বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।

 বেলা ১১টা নাগাদ বহুপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অনান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহাবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা ছোট দল জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গাইলো। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয় না চোখের সম্মুখে একটি জাতি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘোষণা করা হল, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নীচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলো বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো। আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলব্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্ব সভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথ পাড়ি দেবার জন্য আরও রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা হলো, সদ্যোজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মত দেখার জন্য বেঁচে থাকবো?

 সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সৈন্য শার্শা-নাবারন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সথে যুদ্ধে যোগ দেন। এই সময় আরো দুজন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা, যিনি পাবনা থেকে পিছু হটে আমাদের সাথে যোগ দেন। আর অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন ওহাব। যিনি যশোহর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষাবূহ্যকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি। এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাবৄহাতে মোতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন।

 এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এই সময়েই ক্যাপ্টেন হাফিজ নাভারনে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটির উপর একটা সাফল্যজনক দঃসাহসিক রেইড চালান। এই রেইডে প্রথম বেঙ্গলের লোকজন ছিল। এতে করে যদিও শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় তবুও তারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। এবং তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট আকারে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত্রুবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল, যার প্রত্যুত্তরে আমাদের কিছুই ছিল না। তাই আক্রমণকারী বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে আমরা পিছু হটতে থাকি। এই সময় হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। অনেকেই হতাহত হন। আমরা পরে জেনেছিলাম শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি হতাহত মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছিল। সেই এলাকায় এক মৃত মেজরের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক ছোট মেমোরিয়াল তৈরী করেছিল।

 আমাদের পশ্চাদপসরণ বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছিল। পশ্চাদপসণের সময় কিছু মূল্যবান হাতিয়ার খোয়া যায়। বেনাপোল চেক পোষ্টে আমাদের দফতর স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃটিশ এমপি টমাসম্যানসহ চেকপোষ্টে আসেন এবং ঐখানে তার বিবৃতি দেন। ঐদিন পরে শত্রুবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপরে গুলীবর্ষণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য আমরা মোটেও তৈরী ছিলাম না-শত্রুর আক্রমণে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলাদেশের মাটিতে শেষ ঘাঁটিটুকু ছেড়ে দিয়ে ভারতে পশ্চাদপসরণ করি।

কুষ্টিয়ার যুদ্ধ

 কুষ্টিয়াতে ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ উঠাতেই জনসাধারণ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩০শে মার্চ সকালে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা অসামরিক লোকজনদের সহায়তায় কুষ্টিয়া শহরে অবস্থানরত ২৭তম বালুচ রেজিমেণ্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অবস্থানটি দখল করে নেয়।

[২]  চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ ইপিআর উইংয়ের উইং কমাণ্ডার মেজর ওসমান সরকারী কাজে কুষ্টিয়া গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। পাকিস্তনীদের হামলার সময় তিনি কোন প্রকারে কুষ্টিয়া থেকে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২৬মে মার্চ বেলা ১টার দিকে তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে ইপিআর সেনাদের সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। ৪র্থ উইংয়ের সদর দফতর থেকে ওয়ারলেসে ঐ এলাকার সীমান্তবর্তী সকল ফাঁড়ির ইপিআর সদস্যদের জনগণের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৭শে মার্চ সকালে মেজর ওসমান ১ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বাঙ্গালী কমাণ্ডিং অফিসার লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাকিস্তানীরা কায়দা করে ২৪শে মার্চ এই রেজিমেণ্টকে চৌগাছা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। মেজর ওসমান সংক্ষেপে সর্বশেষ পরিস্থিতিবর্ণনা করে ইপিআর সুবেদার মজিদ মোল্লার মারফত লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি লেঃ কর্নেল জলিলকে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই অঞ্চলের সার্বিক কমাণ্ড গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু চিঠির কোন জবাব পাওয়া গেল না। ২৮শে মার্চ মেজর ওসমান দানেশ নামে জনৈক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে তার কাছে পুনরায় বার্তা পাঠান। শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধা দানেশ পুনরায় অনুরোধপত্র নিয়ে লেঃ কর্নেল জলিলের সামনে উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে চিঠিটি পড়েন এবং তার পক্ষে বিদ্রোহে যোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে দানেশকে জানিয়ে দেন। এভাবে তাঁর সাথে দেখা না করার জন্যও তিনি দানেশকে সতর্ক করে দেন। এর পরিণতি হয়েছিল করুণ। এই দিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে ব্যাটালিয়ন নিয়ে তাকে যশোর ফিরে যাওয়ার এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ আসে।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে ১ম ফিল্ড এম্বুলেন্স দলের বাঙ্গালী সৈন্যরা আসন্ন বিপদ অনুভব করতে পেরেছিলো। ২৯শে মার্চ রাতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেনারা চৌগাছা থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে এলে ফিল্ড এম্বুলেন্সের লোকেরা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকদের অস্ত্র জমা না দেয়ার আহবান জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর আগেই অস্ত্র জমা দেওয়া শেষ করে সৈনিকরা ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ২৯শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তনীরা হঠাৎ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ঘুমন্ত সৈন্যদের ওপর হামলা করে। বিশ্বাসঘাতকদের এই আক্রমণে অনেক বাঙ্গালী সেনা প্রাণ হারায়। প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলো এমন কয়েকজন পরে চুয়াডাঙ্গা গিয়ে মেজর ওসমানের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়।

 ১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ওপর হামলার সময় পাকিস্তানীরা শুধু সেনাদেরই হত্যা করেনি, তাদের পরিবার-পরিজন, নারী-শিশুদেরও হত্যা করে। পাকিস্তান দের হত্যা এবং অত্যাচারের হাত থেকে দুগ্ধপোষ্য নবজাতকেরাও রেহাই পায়নি। ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙ্গালী কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল এস এ হাই এবং তার বাঙ্গালী সহকর্মী ক্যাপ্টেন কালামকে ওরা দুঃসহ নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিস্তিতিতে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান এবং তার সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আজম ইপিআর সৈন্যদের নিয়ে কুষ্টিয়া মুক্ত করার সিধান্ত নেন। কুষ্টিয়ার ২৭তম বালুচ রেজিমেণ্টের দুইশত সৈন্য থানা, পুলিশ লাইন এবং জেলা স্কুলে অবস্থান গ্রহণ করছিলো। মেজর ওসমান তিনটি ঘাঁটিতেই পর্যায়ক্রমে আঘাত হানার সিধান্ত নেন। ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায় প্রথম আঘাত শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধের পর ৫টায় পুলিশ লাইন মুক্ত হয়।

 এখানে অনেক পাকিস্তানী নিহত হয়, কয়েকজন আবার পালিয়ে গিয়ে জেলা স্কুলের প্রধান ঘাঁটিতে যোগ দেয়। ৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পাকিস্তানী অবস্থান গুলোর ওপর আবার নতুন আক্রমণ শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক পুলিশ-ইপিআর-এর সহায়তায় এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিলো বাঁশের লাঠি, বন্দুক এবং কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল। জনতার ভীড় বেড়ে চলে। দুপুরের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনসাধারণের বিরাট দল পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় ঘাঁটি দখল করে নেয়।

 শত্রুরা তখন পিছু হটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। ২৭-বালুচ রেজিমেণ্টের কোম্পানীর অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে কোনভাবে প্রাণে রক্ষা পাওয়া কিছু পাকিস্তান সেনা দুটি জীপ এবং দুটি ডজ গাড়িতে করে রাতের অন্ধকারে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। খবর পেয়ে জনসাধারণও পথের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। একদল মুক্তিযোদ্ধা শৈলকুপা সেতুর (যশোর জেলার ঝিনাইদহে) নিকট অবস্থান গ্রহণ করে।

 সেতুর নিকট পৌঁছাতেই পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশের ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। কয়েকজন পালাবার চেষ্টা করলে জনসাধারণ তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে তারাও জনতার হাতে প্রাণ হারায়। তবে এই সময়ের মধ্যে ২৭-বালুচ রেজিমেণ্টের ডেল্টা কোম্পানীর হাতে দুই শতাধিক বেসামরিক বাঙ্গালী প্রাণ হারিয়েছে, আহত আরো বেশী।

 ২রা এপ্রিল ভোরের দিকে বালুচ কোম্পানীর অবশিষ্ট সৈন্য কুষ্টিয়া থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তার ব্যারিকেডের জন্য যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় তারা গ্রামের পথ ধরে পালাবার চেষ্টা করে। পথে কাউকে দেখতে পেলেই তারা গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু শিগগীরই তারা হতাশা ও ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গোলাগুলীও ফুরিয়ে যায়। জনসাধারণ সহজেই তাদেরকে বন্দী করে। তারপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে ২৭-বালুচ রেজিমেণ্টের ডেল্টা কোম্পানীর নাম চিরতরে মুছে যায়।


  1. ১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন।
  2. “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।