বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৮

উইকিসংকলন থেকে

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ যশোর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮। যশোর-নড়াইল-গোপালগঞ্জের সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র …………………১৯৭১

যশোর-গোপালগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকার: মেজর আবদুল হালিম

২২-১১-১৯৭৩

 অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আমি আমার নিজ বাড়ী ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে ছুটি ভোগ করছিলাম। ২৫শে মার্চের পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সিন্ধান্ত নিই। প্রথমে গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ অফিসের নেতৃবৃন্দের সহিত মুক্তিযুদ্ধ কি ভাবে পরিচালনা করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। সাথে সাথে ছুটি ভোগকারী সৈনিক ও ইপিআরদিগকে গ্রাম-গঞ্জ ও শহর থেকে একত্রিত করি। সেই সময় গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ ফরিদ আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সর্ব প্রকারে সাহায্য করেন।

 ২৮শে মার্চ গোপালগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তৎকালীন কালিয়া থানার এম-পি-এ সাহেবের সহযোগিতায় যশোর জেলার নড়াইল মহকুমা শহরে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পৌঁছি। সেই সময় নড়াইলের এস-ডি-ও কামাল সিদ্দিকী ও যশোর জেলার এ্যাসিসট্যাণ্ট কমিশনার শাহাদৎ হোসেন সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।

 ২৯শে মার্চ নড়াইল গিয়ে জানতে পারলাম, যশোরে পাকবাহিনীর সহিত মুক্তিবাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ চলছে। তাই, নড়াইল থেকে যশোর অভিমুখে রওনা হই। পরে হামিদপুরে এক প্লাটুন পাকসেনা ডিফেন্স নিয়ে ছিল। আমার প্লাটুন ও সেই এলাকার ছাত্র, পুলিশ ও কিছু বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জোয়ানসহ ঐদিনই রাত্রি সারে তিনটায় তাদের ডিফেন্সের চারদিক থেকে আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে তারা ভয় পেয়ে পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

 ৩০শে মার্চ সকালে আমার প্লাটুন ও হামিদপুর এলাকার অসংখ্য ছাত্র-যুবকসহ যশোর রওনা হই। সকাল ৯টার দিকে যশোর শহরে পৌঁছি। সেই সময় যশোর শহর আমাদের বাহিনীর আয়ত্তে ছিল যশোর শহরে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন হাসমত ও ক্যাপ্টেন আওলাদের সাথে দেখা করি এবং আমি ও আমার প্লাটুনের জোয়ানদেরকে কি করতে হবে তা অবগত করি।

 সেই সময় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে জানতে পারলাম যশোর-কলিকাতা রোডের শঙ্করপুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সহিত ইপিআর বাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ চলছে। রাত্রে অয়ারলেসে যুদ্ধের অগ্রগতির সম্বন্ধে যোগাযোগ করি।

 ৩১শে মার্চ সকালে শঙ্করপুরে চলে যাই। সেখানে ইপিআর বাহিনীকে পুনরায় নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ডিফেন্স করে দিই। সেখানে ইপিআর বাহিনীর সুবেদার মালেক অসীম সাহসের সহিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এইদিকে ক্যাপ্টেন আওলাদ ও ক্যাপ্টেন হাসমতকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এবং স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাদেরকে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা গেল না।

 ৩১শে মার্চ থেকে এরা ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত যশোর সেনানিবাসের চতুর্দিক ঘিরে রাখা হয়। সকল গুরুত্বপূর্ণ পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় ও ডিফেন্স তৈয়ার করা হয়। সেই সময় ভারতের সহিত যোগাযোগ করা হয় আধূনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য, কিন্তু প্রথম দিকে সাহায্য পাওয়া যায় নাই। আমাদের হাতে তখন আধুনিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল খুব নগণ্য।

 ৩রা এপ্রিল বিকাল ৩ ঘটিকার সময় পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। যশোর কলিকাতা রোডের উপর শঙ্করপুর দিয়ে ও যশোর ঢাকা রোড দিয়েও তারা আক্রমণ করে। প্রথমে আর্টিলারি নিক্ষেপ করে ও মর্টার হতে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনারা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের সম্বল ছিল ২টি ৬ পাউণ্ডার। দুইটিকে দুই রণাঙ্গনে বসান হলো। ৬ পাউণ্ডার থেকে পাকবাহিনীর উপর গোলা নিক্ষেপ করে বেশ কিছুক্ষন তাদের অগ্রগতিকে রোখা গেল। এই দিকে শঙ্করপুরের ৬-পাউণ্ডারটি থেকে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপের পর জ্যাম লেগে যাওয়ায় আর গোলা নিক্ষেপ করা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকা-যশোর রোডের উপর বসান ৬-পাউণ্ডারটি নিয়ে আসার জন্য অয়ারলেসে বলা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিয়ে আসবার সময় পথে পাকবাহিনী ৬ পাউণ্ডার ও চালককে আটকে ফেলে। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের পক্ষে বাধা দেওয়ার আর কোন উপায় রইল না। এদিকে পাকবাহিনীর আর্টিলারীর শেলে কয়েকজন জখম হয় ও ছাত্র-যুবকরা হাতিয়ার ফেলে পিছনে চলে আসে। সন্ধ্যার দিকে পাক বাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলতে থাকি। ৩রা এপ্রিল সারারাত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। আমাদের পক্ষে দুই কোম্পানীর মত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদ-ছাত্র যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে বিশেষ অসুবিধা ছিল। আমি ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন নই, তাছাড়া সকল সৈনিকের ছিল সিভিল পোশাক। তাই সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু 'অসুবিধা হয়। এই যুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী লেঃ মতিউর রহমান এমপিএ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ১৫ জন মুক্তিসেনা বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করে শাহাদত্বরণ করেন। এদিকে পাকবাহিনী যশোর দখল করে নেয়। ৪ঠা এপ্রিল আমরা সকালে নড়াইলে পুনরায় একত্রিত হই। সেখানে নতুনভাবে মনোবল নিয়ে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা নামক স্থানে বিকালে ডিফেন্স নিই। সেই সময় আমাদের জোয়ানদের মোট সংখ্যা ছিল এক কোম্পানী। অপরদিকে সকল আনসার ও মুজাহিদ নিজ নিজ এলাকায় চলে যায়। দাইতলা আমাদের ডিফেন্স খুব শক্ত করে গঠন করি।

 ৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিকালের দিকে পুনরায় আক্রমণ করে, কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনা টিকে থাকতে পারলো না। পাকবাহিনীর পিছনে ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর আনুমানিক ৩০ জনের মত নিহত হয়। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমাদের ডিফেন্স নষ্ট করতে পারেনি। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

 ৮ই এপ্রিল সকালে পাক বাহিনী পুনরায় আমাদের উপর আক্রমণ করে। পাকবাহিনী সেইদিন আর্টিলারী ও মর্টার ব্যাবহার করে। আমরাও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করি। প্রায় ৫ ঘণ্টা উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। পরে আমাদের গোলাবারুদের অভাবে আর টিকে থাকা গেল না। আমরা পিছনের দিকে চলে আসতে বাধ্য হলাম। নড়াইলে আমার কোম্পানী নিয়ে রাত্রে অবস্থান করি।

 ৯ই এপ্রিল পাক বাহিনী নড়াইল মহকুমা শহরে বিমান হামলা চালায় ও সাথে সাথে দাইতলা থেকে পাক বাহিনী এসে নড়াইল শহর দখল করে নেয়। আমার কোম্পানী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিছু ইপিআর জোয়ান ভারতে চলে যায়।

 আমি পুনরায় গোপালগঞ্জে চলে আসি। সেই সময় গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত ছিল। গোপালগঞ্জে পুনরায় ছাত্র, যুবক, ইপিার ও সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের নিয়ে দুটি কোম্পনী গঠন করি। তাদের রীতিমত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। প্রথমে আমার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টার গোপালগঞ্জ শহরে গঠন করি। পরে আমার নিজ গ্রাম মানিকহার হাইস্কুলে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। মে মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদ জেনে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আমাদের নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে।

 ৮ই মে গোপালগঞ্জ থেকে ৫ মাইল দূরে তালা নামক স্থানে ৫টি বার্জ বোঝাই পাট খুলনার দিকে যাচ্ছিল। আমরা তা আক্রমণ করি ও অগ্নিসংযোগ করে বার্জগুলিকে ডুবিয়ে দিই। বার্জগুলিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া ‘বিরলা' নামক ছোট জাহাজটিকে আমাদের নদীতে পেট্রোলিং করার কাজে ব্যবহার করি।

 ১১ই মে সকালে ঢাকা থেকে খুলনা অভিমুখে রকেট ষ্টীমার যাওয়ার পথে তালা জাহাজঘাটে জোরপূর্বক আটকিয়ে রাখি। প্রত্যেকটি যাত্রীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিই, কারণ অধিকাংশ যাত্রী পাক সরকারের পক্ষে চাকুরীতে যোগদানের জন্য খুলনা যাচ্ছিল। জাহাজটিকে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এবং জাহাজের যাত্রীদের সরকারী চাকুরীতে যেন যোগদান না করে এই শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

 ১১ই মে বিকালে পাকসেনারা স্থানীয় কিছু দালালের সহায়তায় প্রথমে গোপালগঞ্জ প্রবেশ করে। পরে 'আমাদের হেডকোয়ার্টার মানিকহার আক্রমণ করে। প্রথমে আমরা তাদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করি, কিন্তু পরে তাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকে থাকা গেল না। আমাদের পক্ষে একটি মাত্র এল-এম-পি ছিল। তার চালক নায়েক রব হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পাক বাহিনী মানিকহার গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

 গোপালগঞ্জ পতনের পর ভারত অভিমুখে রওনা হই। পথে বহু বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে ২২শে মে পশ্চিমবঙ্গের বয়রা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

যশোর সেনানিবাস ও অন্যান্য স্থানে

১ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তৎপরতা

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন আহমদ বীরবিক্রম

২৮-৯-১৯৭৩

 ২৫শে মার্চ ঢাকাসহ প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় কি ঘটেছিল তা আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। সেখানে কোন লোকজনের সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়নি। কেননা ঐ এলাকাটি ছিল জঙ্গলের মধ্যে। এমনকি ২৭শে মার্চ মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) জিয়াউর রহমান সাহেবের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথাও আমি জানতে পারিনি। আমার সৈন্যরা অনেকে কিছু জানতে পারলেও আমাকে কিছু জানায়নি।

 ২৯শে মার্চ ১২টার সময় অয়ারলেসে-এর মাধ্যমে পাকিস্তানী ১০৭ নং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানী আমাদেরকে যশোরে পৌঁছতে বলায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে জগদীশপুর থেকে যশোরের অভিমুখে রওনা দিই। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে রাত ১২টায় পৌঁছি। যদিও আমাদের ব্যাটালিয়নে মোট ৭৫০/৮০০ সৈন্য সাধারণত থাকে, কিন্তু অনেক সৈন্য ছুটিতে থাকায় আমাদের ব্যাটালিয়নে সৈন্যসংখ্যা তখন ছিল ৪০০ জন। (ব্যাটালিয়নে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল এবং সে জন্যই প্রায় অর্ধেক ছুটিতে ছিল।)

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে ব্রিগেডিয়ার দুররানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অফিসে যান এবং কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিলকে বলেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলো এবং আমাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার দুরবানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে চাবিগুলো নিজ হাতে নিয়ে নেন। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর আমাদের ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

[]  ব্রিগেডিয়ার দুরোনী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরাও তৎক্ষণাৎ ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দিতে দিতে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র যার যার হাতে নিয়ে নেয় এবং আমরা চতুর্দিকে আমাদের পজিশন নিই। আমাদের বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানী দুই ব্যাটালিয়ন (২৫-বেলুচ রেজিমেণ্ট এবং ২২তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স) সৈন্য আমাদেরকে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের জোয়ানরা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। এ সময় কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিল আমাদের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন এবং অফিসে বসে থাকেন। তখন আমি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব নিই এবং পাঞ্জাবীদের আক্রমণকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিই এবং সেভাবে সৈন্যদের পুনর্গঠিত করি। সেকেণ্ড লেফটেন্যণ্ট আনোয়ার হোসেনও আমার সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করে।

 এভাবে সকাল আটটা থেকে দুপুর দু'টা পর্যন্ত পাঞ্জাবীরা আমাদের উপর বার বার আক্রমণ করে, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমরা তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করি এবং তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হই। পাকিস্তানীরা পূর্ব থেকেই আমাদের উপর আক্রমণাত্মক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়েছিল, কেননা তারা মর্টার আক্রমণ করে এবং তা আমাদের ব্যাটালিয়নের উপরই করে। যেহেতু, পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ করে, সেহেতু তাদের সঙ্গে আমরা বেশীক্ষণ যুদ্ধ চালাতে পারব না মনে করে আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করেছিল। পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ না করলেও পশ্চিমের খোলা মাঠে মাঝে মাঝে অবিরাম বৃষ্টির মত গুলি করছিল। আমরা পশ্চিম দিক দিয়েই কভারিং ফাইটের সাহায্যে বের হবার সিন্ধান্ত নিলাম। পশ্চিম দিক দিয়ে কভারিং ফাইটের সাহায্যে বের হবার সময় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হই। (চৌগাছা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ১০ মাইল দক্ষিণ- পশ্চিমে) ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বের হবার সময় আমি আমার কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিলকে আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি মোটেই রাজী হননি।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে যুদ্ধের সময় সেকেণ্ড অফিসার লেফেটেন্যাণ্ট আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “বীর উত্তম” উপাধিতে ভূষিত করেন। সেকেণ্ড লেফেটেন্যাণ্ট আনোয়ারই প্রথম অফিসার যিনি যুদ্ধে শহীদ হন। তাছাড়া এ যুদ্ধে আমার ৪০ জন সৈন্য শহীদ হন। পাকিস্তানী সৈন্যও প্রায় ৪০ জন শহীদ হন।

 চৌগাছায় একত্রিত হবার পর আমরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি। এসময় আমি একমাত্র অফিসার ছিলাম। দশজন জুনিয়র কমিশন অফিসারও আমার সাথে প্রায় ২২৫ জন সৈন্য ছিল।

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১০৪ এইদিন রাত্রে জনসাধারণের মারফতই প্রথম জানতে পারলাম যে, মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং যুদ্ধের জন্য সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যদের আহবান করেছেন। কয়েকজন সাংবাদিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের নিকট জানতে পারলাম সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর বাহিনীর সৈন্য ও অফিসাররা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এ খবর পাবার পর আমার এবং আমার সৈন্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা দেয় এবং মনোবল অত্যন্ত দৃঢ় হয়।

 ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ঃ এই দিন আমার ব্যাটালিয়নে সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। তাদের উদ্দেশ্য করে সংক্ষিপ্ত ভাষণে জানালাম যে, বাংলাদেশর স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে। স্ব-ইচ্ছায় যে বা যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্ত্তত শুধু তারাই আমার ব্যাটালিয়নে থাকতে পারবে। এবং আরও বললাম, যদি কারো যুদ্ধ করার ইচ্ছা না থাকে তবে সে কেটে পড়তে পারে। আমার বক্তব্য শুনে প্রত্যেক জোয়ানের মুখে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দেয়। তারা সবাই দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং শপথ গ্রহণ করে।

 চৌগাছায় আমার ও আমার ব্যাটালিয়নের যুদ্ধ করার মত কোন গোলাবারুদ ছিল না। আমাদের সঙ্গে যে সমস্ত গোলাবারুদ ছিল তা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের যুদ্ধেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছারা সকলেরই একটা করে পোশাক ছিল। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা দেখা দেয়। মোটকথা, বিভিন্ন সমস্যর সম্মুখীন হই। কিন্তু ছাত্র ও জনসাধারণের সাক্রিয় সাহায্যে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা হয়।

 ২রা এপ্রিলঃ চৌগাছা থেকে সলুয়া নামক গ্রামে নায়েক সুবেদার এ বি সিদ্দিকের কমাণ্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠাই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। (সলুয়া গ্রাম যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৫ মাইল পশ্চিম দিকে)। চৌগাছা তখন আমার হেড কোয়ার্টার। এখান থেকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের পশ্চিম ও উত্তর দিকের গ্রামগুলোতে পেট্রোলিং শুরু করি। হাবিলদার আবুল কাশেম (টি-জে) এবং হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীমদের নেতৃত্বে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে প্রায় ১ মাইল পশ্চিমে খিতিবদিয়া নামক গ্রামে এ্যামবুশ পার্টি পাঠাই। হাবিলদার আবুল কাশেম এবং হাবিলদার ইব্রাহীম একটি পাকিস্তানী পেট্রোল পার্টিকে এ্যামবুশ করে। এতে ৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয় এবং ৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়।

 ইতিমধ্যে ৭ই এপ্রিল খবর পেলাম যে, মেজর ওসমান চৌধুরী (বর্তমান লেঃ কর্নেল) চুয়াডাঙ্গায় তার ইপিআর বাহিনী নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করেছেন। ঐদিন আমি একটা জীপ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নিকট থেকে কিছু চাইনিজ এম্যুনিশন, এক্সপ্লোসিভ, কয়েকটি জীপ এবং কয়েকটি রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে চৌগাছায় ফিরে আসি।

 ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্যকে পাঠালাম ছোট হায়বতপুর গ্রামের ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য। ব্রীজটি যশোর-ঝিনাইদহ বড় রাস্তায় যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ভোর তিনটের সময় নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহ উক্ত ব্রীজ উড়িয়ে দেন। ব্রীজটি ভাঙ্গার ফলে এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের চতুর্দিকে আমার ব্যাটালিয়ন সৈন্যদের পেট্রোলিং-এর দরুণ পাকিস্তনী সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকা থেকে কিছুদিনের জন্য ভয়ে বের হতে পারেনি।

 ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ঃ সিপাই ড্রাইভার কালা মিয়াকে পাঠাই কোটচাঁদপুর থানায় কয়েকটি জীপ ও ট্রাক সংগ্রহ করে আনতে। কালা মিয়া কোটচাঁদপুর যাবার পথে খবর পায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কনভয় কালিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উক্ত খবর পাবার পর কালা মিয়া আশেপাশের গ্রাম থেকে কয়েকজন (দশজন) মুজাহিদকে নিয়ে কালিগঞ্জের দিকে এক মাইল দূরে এ্যামবুশ করে। উক্ত এ্যামবুশে ৩টা গাড়ি বিনষ্ট হয় এবং দশজন পাকিস্তানী সৈন্যও নিহত হয়। কালা মিয়া একটা হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিয়ে যখন একটা গাড়ির দিকে ছুড়তে যায় তখন তার বুকে পাঞ্জাবদদের বুলেট বিদ্ধ হয় এবং সে সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হয়।

 ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭১: ইতিমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বেনাপোলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ খবর পেয়ে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার ব্যাটালিয়ন চৌগাছা থেকে তুলে নিয়ে বেনাপোলের ৩ মাইল পূর্বে কাগজপুকুর গ্রামে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি এবং যশোর-বেনাপোল রাস্তার দুধারে প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিই। এই সময় ইপিআর বাহিনীর দু'টো কোম্পানী যোগদান করে। আমার সৈন্যসংখ্য প্রায় ৫৫০ জনে দাঁড়ায়। এ সময় শত্রুর শক্ত ঘাঁটি ছিল নাভারনে। (নাভারন বেনাপোল থেকে ১২/১৩ মাইল পূর্ব দিকে)। আমি শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য নাভারন এলাকায় পেট্রলিং শুরু করি।

 ২১শে এপ্রিল, ১৯৭১: ঐ দিন ভোর আড়াইটার সময় আমি নিজে ২০ জন সৈন্য নিয়ে নাভারন মূল ঘাঁটিতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর রেইড করি। আমার রেইডে ১০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং ১৫ জন আহত হয়। উক্ত রেইডে আমরা মর্টার ব্যবহার করি। আমার ৪ জন সৈন্য আহত হয়। উক্ত রেইডে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হয় আমাদেরকে, কেননা কাঁদামাটি এবং খালবিল পেরিয়ে আমাদের রেইড করতে হয়েছিল।

 ২৩শে এপ্রিল, ১৯৭১ (কাগজপুকুরের যুদ্ধ): ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য কাগজপুকুর গ্রামে আমাদের মূল ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। তারা আর্টিলারীর সাহায্য নেয়। এখানে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ চলে। আমি আমার সৈন্যদেরকে নিয়ে পরে বেনাপোল কাস্টম কলোনী ও চেকপোষ্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিতে বলি। কাগজপুকুরের এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিহত হয় ও অনেক আহত হয়। আমার ২৫ জন সৈন্য শহীদ হয়। অনেক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় বাংলাদেশ সরকার তাকে 'বীরবিক্রম' উপাধি প্রদান করেন।

 এর পরবর্তী পনের দিন ধরে শত্রুপক্ষ বেনাপোল কলোনী ও চেকপোস্ট এলাকা দখল করার জন্য বহুবার আক্রমণ করে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাদের আক্রমণের পাল্টা জবাব দিই এবং প্রতিহত করি। উক্ত পনের দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। এই আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেনাপোল তারা দখল করে সেখানে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করবে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবং বাংলাদেশের পতাকাই উড়তে থাকে। উপরন্তু এ এলাকা তারা কখনও দখল করতে পারেনি। বেনাপোলের যুদ্ধে আমার দশ জন সৈন্য শহীদ হন এ সংঘর্ষে হাবিলদার আবদুল হাই, হাবিলদার আবুল হাশেম (টি-জে), হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী, ল্যান্স নায়েক মুজিবুর রহমান, সিপাই আবদুল মান্নান অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। বড়আঁচড়া গ্রামে এ্যামবুশ করে হাবিলদার ফয়েজ আহমদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫ জন সৈন্যকে নিহত করে।

প্রতিরোধ যুদ্ধে যশোর ও অন্যান্য এলাকা

যশোর রণাঙ্গণে

 ২৩ মার্চ তারিখে ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা তাদের ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলল, আর সেই পতাকার সামনে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ‘গার্ড অব অনার' দিল। অবাঙ্গালীরা প্রতিবাদ তুলেছিল, কিন্তু তাদের সেই আপত্তি টিকল না। ২৫শে মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়ার জঙ্গী-বাহিনীর বর্বর আক্রমণের খবর যখন এসে পৌঁছল, যশোরের মানুষ তাতে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, ক্রোধে গর্জন করে উঠল-এর উপযুক্ত প্রতিশোধ চাই। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে কামান, মর্টার আর মেশিনগানে সজ্জিত হাজার হাজার পাক সৈন্য মোতায়েন হয়ে আছে, যে- কোন সময় তারা অগ্নিস্রাবী প্লাবন নিয়ে নেমে আসতে পারে, এ কথা চিন্তা করেও তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল। ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চ, এই তিন দিনে ইপি-আর-এর চারটি ক্যাম্পে জওয়ানরা প্রতিরোধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প নিল।

 প্রথমম সংঘর্ষ ঘটল ২৯শে মার্চ তারিখে শহরের উপর নয়, শহর থেকে বাইরে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে। সেদিন ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। দিনের অবস্থা বদলে গেছে, মুক্তি আন্দোলনের হাওয়া ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরেও এসে ঢুকেছে - নিরস্ত্র বাঙ্গালী সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এর পরিণাম কি হবে, তা তারা ভাল করেই জানত, তা সত্ত্বেও এই লাঞ্ছনাকে তারা নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নেয়নি।

 সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসেবে ওরা আগেই বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ম্যাগাজিনের চাবিটা কেড়ে নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা তাতেও দমল না, তারা ম্যাগাজিন ভেঙ্গে কিছু অস্ত্র বার করে নিয়ে এল। তার ক্যাণ্টনমেণ্টের

[] ভেতরেই দু'পক্ষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। একদিকে কামান, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অপর দিকে হালকা হাতিয়ার সম্বল করে এক ব্যাটালিয়ন বাঙ্গালী সৈন্য। এই যুদ্ধ কতক্ষণ চলতে পারে! স্বাভাবিকভাবেই এই সংঘর্ষে বহু বাঙ্গালী সৈন্য মারা গেল। বাকী সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে ক্যাণ্টনমেণ্টের বন্ধ দরওয়াজা ভেঙ্গে বাইরে পালিয়ে গেল।

 এই সংবাদ দেখতে দেখতে শুধু যশোর শহর নয়, সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল, এবার মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আর বসে থাকার সময় নেই। ইপি-আর বাহিনী আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী হয়েছিল। এবার শহরের পুলিশ বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করল। এই পুলিশ-বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা হচ্ছেন হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন আর পীযুষ। শহরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে হিমাংশু ব্যানার্জী পুলিশদের মধ্যে নয়, শহরের সাধারণ লোকের মধ্যেও জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয় খেলোয়ারটি এবার এক নতুন খেলায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন।

 পুলিশ ম্যাগাজিনের চাবি ছিল অবাঙ্গালী জমাদারের হাতে। হিমাংশু, আকমল আর পীযূষ তাকে বন্দী করে তার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। সেখান থেকে তারা সাতাশ রাইফেল, ছয়'শ শটগান, কিছুসংখ্যক ব্রেনগান এবং যথেষ্ট পরিমাণে কার্তুজ উদ্ধার করলেন। তারপর এই অস্ত্রগুলিকে বিদ্রোহী পুলিশ আর বিদ্রোহী জনতার মধ্যে বিলি করে দেওয়া হল। স্থির হোল, এদের এখনই অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতে হবে। মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়বার জন্য ব্যাগ্র পুলিশ আর জনতা নিউ টাউনের নোয়াপাড়ার 'আমবাগানে ঘাঁটি করে বসেছিল। এখানে জনতার মধ্যে থেকে তিন'শ জনকে বাছাই করে নিয়ে ষাটজন পুলিশ তাদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দিল। মাত্র এক ঘণ্টার মত সময় পেয়েছিল তারা। এইটুকু সময়ের মধ্যেই তারা রাইফেল চালনার অ, আ, ক, খ- টুকু আয়ত্ত করে নিল।

 সেদিন সেই আমবাগানেই এই নবদীক্ষিত শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। জনসাধারণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আহার্য-দ্রব্য যোগাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই স্মরণীয় আমবাগানের মধ্যে তাঁদের এই মুক্তিসংগ্রামী ভাইদের জন্য রান্না করছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবিকা নারী বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন হিমাংশু ব্যানার্জীর স্ত্রী।

 সেই দিনই ইপি-আর বাহিনী, ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দুশ'র উপরে সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর গড়ে তোলা হোল।

 ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে চারটি সৈন্যবাহী জীপ সম্ভবত শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বেরিয়েছে। মুক্তিবাহিনী তাদের মধ্যে তিনটি জীপকে খতম করে দিল। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম শুরু। সেদিন রাত দ’টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাণ্টনমেণ্টের শালতলা এলাকায় পাক-সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়।

 সেই রাত্রিতেই যশোর জেলের কয়েদীরা বাইরের খবর শুনে চঞ্চল হয়ে উঠে। তারা জোর করে জেল থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং তাই নিয়ে জেল প্রহরীদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এবং গুলি চলে। শেষ পর্যন্ত তার পরদিন রাত্রিতে সেখানকার ১৩৭৫ জন বন্দী জেলের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সতেরো জন ছিলেন নিরাপত্তা বন্দী। এটা ৩০ তারিখ রাতের ঘটনা।

 ৩০শে মার্চ ভোরবেলা দু'দল পাক-সৈন্য ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে এসে জীপে করে দু'দিকে যাত্রা করল। একদল এখানকার চাঁচড়ার দিকে, আর একদল খুলনার দিকে। মুক্তিবাহিনীও দু'দলে ভাগ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাক-সৈন্যদের মধ্যে যে দলটি খুলনার দিকে যাত্রা করেছিল, পুরাতন কসবার পুলের কাছে তাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষে পুলিশদের নেতা হিমাংশু ব্যানার্জী নিহত হলেন। চাঁচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে আচ্ছামত ঘা খেয়ে পাক-সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুক্তিবাহিনী ক্যাণ্টনমেণ্ট অবরোধ করে রইল। ৩১শে মার্চ তারিখে শহর থেকে চার মাইল দূরে যশোর-মাগুরা রোডের ধারে হালিমপুর গ্রমে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেণ্টার খোলা হয়। ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানদের নেতৃত্বে এই ট্রেনিংদানের কাজ চলবে। শোনা যায়, জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা প্রায় পাঁচশ কয়েদী স্বেচ্ছায় এই ট্রেনিং সেণ্টারে যোগ দিয়েছিল।

 কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রামের সমরসজ্জা শুধু যশোর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না প্রায় একই সাথে মহকুমা শহরগুলিতেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল। নড়াইলের এসডিও এবং সেখানকার বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। যশোর শহরে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, এই খবর পেয়ে তারা শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য যশোর শহরের দিকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। নড়াইল মহকুমার হাজার হাজার লোক যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে এই যুদ্ধ মিছিলে যোগ দেয়। যশোর-নড়াইল রোডের দু'ধারের গ্রামগুলি তাদের ঘন ঘন জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগল।

 নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া অঞ্চলেও একটি শক্তিআলী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নৌ-বিভাগের প্রাক্তন অফিসার শামসুল আলমের উদ্যোগে এই শাক্তশালী মুক্তিবাহিনীটি গড়ে উঠেছিল। শামসুল আলম সামরিক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে আর দশজনের মতই সংসার জীবনযাপন করে চলছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আহবানে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি তার চাকরির মায়া ছেড়ে দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে তার নেতৃত্বে প্রায় পাঁচশত যোদ্ধার এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। এই মুক্তিবাহিনীর জন্য থানা থেকে ও বিভন্ন লোকের কাছে থেকে দু'শর উপরে রাইফেল ও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল।

 যশোর শহরের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহাগড়ার এই মুক্তিবাহিনীও যশোরের দিকে দ্রুত মার্চ করে চলল। শামসুল আলম নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরী করে তুলেছিলেন। এখানেও হাজার হাজার লোক তাদের যুদ্ধ-যাত্রার সাথী হয়েছিল। তারা তাদের ভীমগর্জনে পথঘাট মুখরিত করতে করতে যুদ্ধের উন্মাদনায় উন্মুক্ত হয়ে ছুটে চলেছিল।

 এই যুদ্ধ-মিছিল সম্পর্কে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগারজন মেয়ে নিয়ে গঠিত একটি নারীবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অংশ হিসেবে এই যুদ্ধ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এরা সবাই কলেজ ও স্কুলের ছাত্রী। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের জন্য রান্না করা এবং যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা শুশ্রূষা করা, এটাই ছিল তাদের কাজ। এই এগারটি বীরকন্যা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে যশোরে গিয়েছিল।

 মাগুরা ও ঝিনাইদহ মহকুমায় যাঁরা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটি লোকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তিনি হচ্ছেন মাগুরার তরুণ এসডিও ওয়ালীউল ইসলাম। এই ব্যাপক অঞ্চলের প্রতিরোধ সংগ্রাম কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

 ১লা এপ্রিল থেকে ৩রা এপ্রিল, এই তিনটা দিন হাজার হাজার পাকসৈন্য খাঁচার পাখির মত ক্যাণ্টনমেণ্টের মধ্যে অরুদ্ধ হয়ে রইল। ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বারকয়েক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ওরা একেবারে ঘর নিয়েছে, বেরোবার নামটি করে না।

 সৈন্যসংখ্যার দিক দিয়ে এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জার দিক দিয়ে শক্তি ওদের প্রচণ্ড। তাহলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মরিয়া আক্রমণে, আর তাদের চেয়েও বেশী হাজার হাজার ক্ষিপ্ত জনতার ভীমগর্জনে ওরা যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ওদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই তিনটি দিন শহরের মানুষ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ, কখনও দলে দলে, কখনও বা বিচ্ছিন্নভাবে যে যার হাতিয়ার উঁচিয়ে নিয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। আওয়ামী লীগ আর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তাদের সেই সংগ্রামী অহবান ব্যর্থ হয়নি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে ছুটে আসছে মানুষ। তারা এই বর্বর হামলাকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের এই সোনার দেশকে মুক্ত করবে, স্বাধীন করবে।

 ঘরের মেয়েরাও এগিয়ে আসতে চাইছে। এই মুক্তিসংগ্রামকে সফল করে তুলবার জন্য তারাও কিছু করতে চায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে ঘরে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। কেউ তাদের বলুক আর নাই বলুক, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে খাবার তৈরী করে চলেছে। যে যা পারছে সে তাই দিয়ে চলেছে। নিজেরা এগিয়ে গিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।

 পর পর তিন দিন ধরে অবরোধ চলছে। হাজার হাজার লোক ঘিরে আছে ক্যাণ্টনমেণ্টকে। দিন-রাত্রি অষ্টপ্রহর ধরে তারা পাহাড়া দিয়ে চলেছে। ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছন দিকে বিল অঞ্চল। সেখানেও পাহাড়া চলেছে, যাতে এরা কোন দিক দিয়ে বেরোবার পথ না পায়। রাইফেল বা বন্দুক ক'জনের হাতেই বা আছে। গ্রামের মানুষ হাতিয়ার বলতে যার যা সম্বল তাহা নিয়ে ছুটে এসেছে। বর্শা, বল্লম, রামদা, লেজা থেকে লাঠিসোঁটা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, পথের মোড়ে মোড়ে গাছের উপর অনেকে তীর-ধনুক নিয়ে বসে আছে। দুশমনরা একবার ওদের কোট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেই হয়। একটাকেও জ্যান্ত ফিরে যেতে হবে না।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট এক বিরাট ঘাঁটি। এখানে প্রায় সতের হাজার সৈন্য থাকার ব্যাবস্থা আছে। তাছাড়া এরা ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। কয়েকশ রাইফেল, কয়েকটা লাইট মেশিনগান আর কেবলমাত্র একটা পাঁচ পাউণ্ড গোলা কামান দিয়ে এদের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের ব্যাপারে সাহস অত্যন্ত প্রয়োজন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ যুগে শুধু সাহস দিয়েই যুদ্ধ জয় করা চলে না। এই প্রতিরোধ সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা হয়তো এ বিষয়ে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন না।

 তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর আরেকটা দুর্বলতা ছিল তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। বীর জনতা তিন দিন ধরে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে হাজার হাজার পাক-সৈন্যকে অবরোধ করে রাখল, অথচ সেই খবরটা সময় মত তাদের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে পৌঁছল না। আর যদি পৌঁছেও থাকে, তবে মূল নেতৃত্ব সাড়া দেয়নি। সে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট-মুহূর্তে তাদের শক্তি সম্পদ যশোরে এনে সমাবেশ করার প্রয়োজন ছিল। তাহলে যুদ্ধপরিচালনার ব্যাপারে অভিজ্ঞ যোদ্ধারা থাকতেন এবং আরও কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করা যেত। অবশ্য তাহলেই যে তারা যুদ্ধ জয় করতে পারতেন, এমন কথা বলছি না। তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তার ফলে সেইদিন যশোর শহর একটা প্রচণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারত এবং তারা বহু শত্রুসৈন্যকে খতম করতে পারত।

 অবরোধের তৃতীয় দিনে অবরোধকারীদের সংখ্যা কমতে কমতে অবরোধের বেষ্টনীটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিল। উপযুক্ত সময় বুঝে অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা কামানের গোলায় পথ করতে করতে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর দু'পক্ষে চলল যুদ্ধ। কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে রাইফেলের লড়াই, এ এক দুঃসাহসিক অথচ মর্মান্তিক দৃশ্য। এই যুদ্ধে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা অদ্ভুত বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এসবই অগ্নিস্রাবী কামান আর ভারী মেশিন গানের সামনে এই প্রতিরোধ কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে! যশোরের রাজপথ রক্তে লাল হয়ে গেল, কত দেশপ্রেমিক এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন তার হিসেব কেউ দিতে পারবে না। যুদ্ধ সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে পড়েছিল, শহরের পথগুলি অসংখ্য দেশভক্তের মৃতদেহে বিকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধত্মদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্গঠন করবার সঙ্কল্প নিয়ে শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেল। এইভাবে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।  এপ্রিলের মধ্যভাগ। ইতিমধ্যে পাকসৈন্যরা যশোরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে হামলাকারীদের উপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যশোর শহর থেকে দশ-বারো মাইল দূরে মুরাদপুর গ্রাম। বারো বাজারের পাশেই মুরাদগড়। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটি গোপন ঘাঁটি ছিল। খবর পাওয়া গেল যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে কিছু সৈন্য মুরাদগড়ের দিকে আসছে। সুখবর। এই শিকারটা যেন ফসকে না যায়। স্থির হলো এদের উপর অতর্কিত হানা দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে এদের হাতে একটি লাইট মেশিনগান ছিল। এমন সুযোগ কি সবসময় মেলে! কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় মাত্র তিনজন একজন ক্যাপ্টেন আর দু'জন তার সহকারী। খবর পাওয়া গেছে ওদের সঙ্গে আছে পাঁচখানা জীপ, আর একখানা ট্রাক। সৈন্যসংখ্যা সবসুদ্ধ শ'খানেক হবে। একশ জনের বিরুদ্ধে তিনজন। হোক তিনজন, এই নিয়েই তারা ওদের প্রতিরোধ দেবে।

 যথাসময়ে ওদের সেই 'কনভয়' মুরাদগড়ে এসে পৌঁছলে ওরা কালীগঞ্জের দিকে চলেছিল। মুরাদগড়ের পুলটা যেখানে তারই একপাশে ঘন ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে সেই তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পজিশন নিয়ে বসেছিল। পাক সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। তাদের বাধা দেবার দুঃসাহস যে কারও থাকতে পারে এটা তারা ভাবতে পারেনি। তাদের দুটো জীপ সবেমাত্র পুলটা পেরিয়ে ওপারে গেছে, এমন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানটি তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠল।

 এ অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়ে পাক-সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ওদের মেশিনগান অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করে চলেছে। ফলে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে ছুটল।

 একটু বাদেই এই ভগ্নদূতের দল হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যাণ্টনমেণ্টে গিয়ে এই সংবাদ পৌঁছল। দেখতে দেখতে এক বিপুল বাহিনী বেরিয়ে এলে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে। ট্রাক-বোঝাই সৈন্যদল বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গিয়ে মুরাদগড়কে কেন্দ্র করে একটা বিরাট অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলল। মুক্তিযোদ্ধারা ওদের সেই ঘেরাও-এর মধ্যে আটকে পড়ে গিয়েছিল। বেরিয়ে যাওয়ার কোন পথ ছিল না। সেই তিনজন বীরযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হবার ঠিক অল্প কিছু কাল আগেই কর্তৃপক্ষ আবদুর রউফকে পাকিস্তান থেকে তাঁর স্বদেশে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দলভুক্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল তরঙ্গ নিয়ে গর্জন করে উঠেছে। স্বাধীনতার এই দুর্বার কামনাকে দমন করবার জন্য সামরিক সরকার ২৫-এ মার্চ রাত্রিতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সারা প্রদেশময় তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা, দিতে দিকে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে লাগল।

 যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে তখন বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক ব্যাটালিয়ন বাঙ্গালী সৈন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রণ্টিয়ার ও বেলুচ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যের মধ্যে তারা একেবারেই সংখ্যালঘু। তাই ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও তারা প্রথম দিকে কোন অসন্তোষ বা বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেনি।

 কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি। ২৯-এ মার্চ পর্যন্ত মানুষের মনের অবস্থা যাই থাক না কেন যশোরে নাগরিক জীবন স্বাভাবিকভাবেই বয়ে চলেছিল। কিন্তু ৩০-এ মার্চ তারিখে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে অবাঙ্গালী ও বাঙ্গালী সৈন্যদের মধ্যে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটল। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অস্ত্রাগারের চাবি কেড়ে নিয়ে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ফেলল। তার মিনিট কয়েক পরেই বিক্ষুদ্ধ বাঙ্গালী সৈন্যরা মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং জোর করে তাদের নিজেদের অস্ত্রাগার দখল করে নিল।

 এবার দু'পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্যদের সংখ্যা বাঙ্গালীদের চেয়ে বহুগুণে বেশি। তাছাড়া কামান, মর্টার ইত্যাদি ভারী অস্ত্রশস্ত্র, সবকিছুই তাদের হাতে, ফলে এই যুদ্ধের পরিণতি যা ঘটা স্বাভাবিক তা'ই ঘটল। ঘণ্টাকয়েক ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। এই সংঘর্ষের ফলে ক্যাণ্টনমেণ্টের দু-তিন শ বাঙ্গালী সৈন্য মারা গেল। অবশিষ্ট বাঙ্গালী সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট ছেড়ে পালিয়ে গেল। যশোর জেলার মুক্তিসংগ্রামের এটাই হলো সূচনা।

 এই পালিয়ে আসা বাঙ্গালী সৈন্যদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিল না, যে যেদিকে পারল সে সেই দিকে পালাল। আবদুর রউফ আর তাঁর সাথী দুইজন সৈন্য তাদের সবার মধ্য থেকে বিচিছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই বিচিছন্ন অবস্থাতেও তাঁরা তাঁদের মনোবল হারাননি। তাঁর এই তিনজনে মিলে নিজেদের একটা ইউনিট গঠন করলেন এবং শপথ নিলেন যে, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবেন। এই সঙ্কল্প নিয়ে তাঁরা যশোর শহরে ফিরে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করলেন। তখন যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর অধিকারে এসে গেছে। মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের পর থেকে আবদুর রউফ ও তাঁর দুইজন সাথী একই সঙ্গে লড়াই করে এসেছেন এবং আবদুর রউফ আহত হয়ে রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা এক সঙ্গেই ছিলেন।

 ৩রা এপ্রিল তারিখে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাক-সৈন্যরা যশোর শহর পুনর্দখল করে নিল। মুক্তিবাহিনী শহর ত্যগ করে নড়াইল গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করল। কিন্তু যশোর শহর ছেড়ে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ শহর থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে দুই তালা ফতেহপুরে পাক-সৈন্যদের প্রতিরোধ দেবার জন্য তৈরী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের সঙ্গে ছিল তিনটা মেশিনগান। এই তিনটা মেশিনগানের মধ্যে একটা ছিল আবদুর রউফ আর তাঁর দুইজন সাথীর হাতে। ই, পি, আর বাহিনির ৮/১০ জন যোদ্ধা বাকী দুইটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এদের সাহায্য করবার জন্য পঞ্চাশেক ছাত্রও সঙ্গে ছিল। এই প্রতিরোধের দলটি দুইতালার যেখানে ঘাঁটি করেছিল, সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

 আবদুর রউফ বলেছিলেন: ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কারও সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। ১২ই এপ্রিল তারিখে বেলা ১টার সময় আমরা যখন খেতে বসেছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম শহরের দিক থেকে একটা কাল রং এর জীপ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু দূরে থেকতেই জীপটা থেমে গেল। মনে হলো, জীপের আরোহীরা আমাদের দেখতে পেয়েছে, তাই ওখানে থেমে গিয়েছে। আমরা দেখা মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে আমাদের তিনটা মেশিনগান একই সঙ্গে গর্জন করে উঠল। কিন্তু ওরা আগে থেকেই হুঁশিয়ার হয়ে জীপটাকে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। তাই আমাদের গুলি ওদের স্পর্শ করতে পারল না। জীপটা ঐভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বোধ হয় আমাদের অবস্থানটা পর্যক্ষেণ করে নিচিছল। তারপর গাড়িটা যেদিকে থেকে এসেছিল, সেই দিকে দ্রুতবেগে ছুটে চলে গেল।

 জীপটা চলে যাবার মিনটি কয়েক বাদেই ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। গোলাগুলি আমাদের সামনে এসে পড়েছিল। আমরা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিলাম। ঘণ্টাখানেক ধরে এইভাবে গোলাবর্ষণ চলল। ওরা মনে করল, এই গোলাবর্ষণের পরে পথ নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে, তাদের প্রতিরোদ করবার মত কেউ নেই। তাই ওদের একটা পদাতিক দল নিশ্চিন্ত মনে যশোর নড়াইল সড়ক দিয়ে আসতে লাগল। আমরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, আসুক, ওরা আরও কাছে এগিয়ে আসুক, তারপর ওদের একবার দেখে নেওয়া যাবে। উপযুক্ত সময় আসতেই আমরা মুহুর্তের মধ্যেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে মেশিনগান চালাতে শুরু করলাম। ওরা এ জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তাই আমাদের তিনটা মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষনের ফলে ওদের মধ্যে প্রচুর লোক মারা গেল। বাকী সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল।

 ওরা পালিয়ে গেল বটে, কিন্ত আমাদের নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নেবার সময় দিল না। একটু বাদেই ওদের একটা বড় দল আমাদের উপর এসে হামলা করল। ওরা অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েই এসেছিল, সঙ্গে মেশিনগান ও ছিল, কিন্তু ওরা এবার বরাবর সোজা পথ ধরে আসেনি। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে হঠাৎ এক সময় উঠে দেখলাম, ওরা দুটো দলে ভাগ হয়ে দু'দিক থেকে সাঁড়াশীর মত আক্রমণ করেছে এবং আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে যেতে বসেছি।

 আমাদের উপর দুদিক থেকে গুলিবর্ষণ চলেছে আমরা যেন গুলির বেড়া জালের মধ্যে আটকে পড়তে যাচিছ। আমাদের সঙ্গে সাহায্য করার মত যারা ছিল তারা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে একে একে পাঁচজন যোদ্ধা শহীদ হলেন। কিন্ত তবু আমরা আমাদের মনোবল হারাইনি। আমাদের তিনটি মেশিন গান অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গুলি করতে করতে পিছিয়ে যাচিছল। শেষ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট কৌশলের পরিচয় দিয়ে সেই মৃত্যু-ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলাম।

 শত্রুপক্ষ বুঝল, লড়াইয়ের পথ এখনও তাদের জন্য কণ্টকমুক্ত নয়। তাই তারা আর বেশী দূরে না গিয়ে যশোর শহরে ফিরে এল। ইতিমধ্যে নড়াইল এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাক সৈনদের এক বিরাট বাহিনী নড়াইল আক্রমণ করতে রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। নড়াইল শহরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। আবার সেই রাত্রিতেই ওরা নড়াইল শহরের উপর মারাত্মক রকম বোমাবর্ষণ করল। বিস্ফোরণের আগুনে জ্বলতে লাগল নড়াইল শহর। অবস্থা গুরুতর মনে করে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নড়াইল শহর ছেড়ে লোহাগড়ার দিকে চলে গেল।

 পরদিন যশোর থেকে এক বিরাট মিলিটারি বাহিনি নড়াইল এসে হামলা করল। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের বিহারী ও বাঙ্গালী দালালরা। ওরা লুটের লোভে উন্মত্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ওদের বাধা দেওয়ার মত কেউ ছিল না। ওরা নিশ্চিন্ত মনে নড়াইল শহরের ঘরে ঘরে মনের সাধ মিটিয়ে লুটপাট করে শেষ ফিরে গেল যশোর শহরে। তখন নড়াইল শহরে বেসামরিক বা সামরিক কোন শাসনই রইল না। কুখ্যাত গুণ্ডা টগর সেই সুযোগে সারা শহরের উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে যা খুশি তাই করে চলল।

 মূল মুক্তিবাহিনী চলে গেছে লোহাগড়া। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারাও ছত্রভঙ্গ হয়ে কে কোথায় চলে গেছে। এবার আমরা তিনজন মুক্তিবাহিনী থেকে বিচিছন্ন হয়ে পড়লাম। আমরা স্থির করলাম আমদের নিজেদের এবার নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে, নিজেদের উদ্যোগেই মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শত্রুপক্ষ যতই প্রবল হোক না কেন এবং আমাদের অবস্তা যতই প্রতিকূল হোক না কেন আমরা কিছুতেই এই সংগ্রাম ছেড়ে পেছনে হটে যাব না। আমরা তিনজন আর আমাদের মেশিনগানটি, এই আমাদের শক্তি, এই আমাদের সম্বল। এই নিয়ে আমরা আমাদের নতুন পথে যাত্রা করলাম।

 আমাদের প্রথম কাজ হোল নড়াইল গিয়ে টগর গুপ্তাকে উচিত মত শিক্ষা দেওয়া। আমরা সোজাগিয়ে তার সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। টগর তার দলবল নিয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়ে যাচিছল। তাদের সঙ্গে বাক্য বিনিময়ের ইচ্ছা বা সুযোগ আমাদের ছিল না, দেখা হওয়া মাত্রই আমাদের গুলিবিনিময় চলল। কিন্তু আমাদের মেশিনগানের সামনে ওরা কি করে দাঁড়াবে! টগর প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পণ করল। আমরা দেশের শত্রু সেই শয়তান মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করলাম। তরপর পরপর তারই মত আরও কয়েকজন দেশদ্রোহীকে হত্যা করা হলো।  এবার আমরা নড়াইল শহর ছেড়ে লোহাগড়ার কাছে দীঘলিয়া গ্রামে চলে গেলাম। আমরা স্থির করেছিলাম, এবার আমরা নিজেদের উদ্যোগে একটি নতুন মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলব। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছাত্র ও যুবকদের অভাব ছিল ন। সামরিক ট্রেনিং পাওয়ার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছিল। আমার ডাকে দেখতে দেখতে অনেক ছাত্র ও যুবক এসে জুটল। আমি দীঘলিয়াতে ট্রেনিং সেণ্টার স্থাপন করে এই সমস্ত শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে চললাম। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত চল্লিশ-পঞ্চাশ জনে দাঁড়াল।

 এদিকে পাক সৈন্যদের জয়লাভের ফলে স্থানীয় দালালরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল চোর, ডাকাত, লুটেরা আর গুণ্ডা বদমাসের দল। ওরা এই সুযোগে নিজেদের ফায়দা উসুল করে নিচ্ছিল। ওদের পেছনে সামরিক সরকার সমর্থন রয়েছে, তাই তারা নিশ্চিন্ত ছিল যে, তারা যা-ই করুক না কেন, কেউ তাদের বাধা দিতে সাহস করবে না। দীঘলিয়ার কুখ্যাত চেয়ারম্যান নওশের আলী ছিল এমনি একজন নামকরা দালাল। আমাদের মুক্তিবাহিনীর খবর শুনে তার টনক নড়ল। সে টাকা পয়সা ছড়িয়ে চারদিক থেকে হাজার দুই গুণ্ডা জাতীয় লোক এনে জড় করে আমাকে ধরতে এল। আমাকে ধরাটা সহজ নয়, এটা সে, আগেই বুঝতে পেরেছিল। তার জন্যই তার এত তোড়জোড়া। আমি খবরটা পেয়েই দীঘলিয়া বাজার ‘কারফিউ জারী করে দিয়েছিলাম। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ছোট একটা গ্রুপ নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। কিন্তু যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না, আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শুনে দালাল নওশের আলীর ভাড়াটে গুণ্ডাগুলি দেখতে দেখতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল।

 কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, জায়গাটা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আমাদের অন্যত্র সরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্ত যাবার আগে দালাল নওশের আলীর লীলাখেলা শেষ করে দিয়ে যাব। এই সঙ্কল্প নিয়ে আমি তখনকার মত আমাদের এই মুক্তিবাহিনীকে ভেঙ্গে দিলাম। তারপর সে অঞ্চলে পনের-ষোল দিন আত্মগোপন করে ছিলাম। একদিন উপযুক্ত সুযোগে শয়তান নওশের আলীকে হত্যা করা হয়। তারপর আমি আর আমার দুই সাথী সেই অঞ্চল ছেড়ে এলাম ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে।

 আমরা গোপালগঞ্জ মহকুমার চন্দ্রদীঘলিয়া গ্রামে এসে আশ্রয় নিলাম। দেখতে দেখতে এখানেও এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। আমাদের দৃষ্টি রইল গোপালগঞ্জ শহরের দিকে। সেখানে তখন মুসলিম-লীগ পন্থী, জামাত পন্থী প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল দেশদ্রোহীদের অপ্রতিহত রাজত্ব চলছে। পুরানো এসডিওকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় একজন অবাঙ্গালীকে নিয়োগ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ শহর তখন শত্রুপক্ষের দূর্ভেদ্য দুর্গস্বরূপ। পরিকল্পনা নিলাম, ওদের সেই দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়ে ওদের উপর হামলা চালাব। এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তবে সমস্ত মহকুমা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর প্রভাব ও মর্যাদা বহু গুনে বেড়ে যাবে।

 কিন্ত আমরা তিনজনই শুধুই সেখানে যাব, যা করবার আমরা তিনজনেই করব, মুক্তিবাহিনীর আর কউকে সঙ্গে নেব না। এ কাজ করতে হবে অত্যন্ত কৌশলে। ওরা যদি আগে থেকে টের পেয়ে যায়, তাহলে একজনকেও সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। আমার প্যরাট্রুপারের ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতাটাকে এবার ভাল করে কাজে লাগাতে হবে। খুবই দুঃসাহসের কাজ। আমরা তিনজন সেই বিপজ্জনক পথে পা বাড়ালাম।

 গভীর রাত্রিতে অতি সন্তর্পণে আমরা তিনজন গোপালগঞ্জ শহরে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। শান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে, কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। আমাদের ভাগ্য ভাল, আমরা কোথাও কোন পাহারাদারের নজরে পড়ে যাইনি। কি করে অত্যন্ত দ্রুত ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়, সেই শিক্ষা আমার ভাল করে জানা ছিল। এবার তা কাজে লেগেগেল। আমরা যন্ত্রের মত কাজ করে চলেছিলাম। দেখতে দেখতে ওদের বেতার প্রেরণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিলাম। কেটে ফেললাম টেলিগ্রাম আর টেলিফোনের তার। গোপালগঞ্জ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু এমন সতর্কতার সঙ্গে এই কাজগুলি করেছিলাম যে, একটি জন-প্রাণীও তা টের পায়নি। এইভাবে আমাদের প্রাথমিক কাজ সমাপ্ত করে নিয়ে আমরা তিনটি নিশাচর প্রাণী দিবালোকের প্রতিক্ষায় রইলাম।

 অবশেষে রাত্রির অন্ধকার কেটে দিনের আলো দেখা দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল বেলা। আমরা আমাদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে প্রকাশ্যভাবে বেরিয়ে এলাম পথে। পথের মানুষ আমাদের দেখে চমকে উঠল। ভয় পেয়ে দু'ধারে সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমরা আমাদের মিলিটারি বুটের খট খট শব্দে রাজপথ ধ্বনিত করে সোজা পুলিশ ব্যারাকে গিয়ে উঠলাম। ব্যারাকে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমি। আমরা সংবাদ পেয়েছিলাম, ব্যারাকে মাত্র জনকয়েক পুলিশ আছে। কিন্তু আমরা এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের ভয় করলে চলবে না। এখন যা হবার তা হোক।

 আমাদের দেখে ওরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ওরা আমাকে পাঞ্জাবী অফিসার বলে মনে করেছিল। এমন ভুল অনেকেই করে থাকে। এরই উপর ভরসা করে আমি এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে গোপালগঞ্জ শহরে এসেছি। বলতে গেলে জেনেশুনেই বাঘের মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি মিলিটারি অফিসারের গাম্ভীর্য নিয়ে পরিষ্কার উর্দু ভাষায় বললাম, আমি সামরিক হেডকোয়াটার থেকে এসেছি। তোমাদের উপর নির্দেশ, তোমরা এখনই তোমদের অস্ত্র আমার সামনে এনে জমা করবে।

 ওরা আমার নির্দেশ শুনে অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তারা এই অর্ডারেরমানে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারা তো বাঙ্গালী পুলিশ নয়, তবে তাদের এভাবে নিরস্ত্র করা হচ্ছে কেন? আমি তাদের আর বেশী ভাববার সময় না দিয়ে বজ্রগর্জনে সেই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করলাম। এবার ওরা ঘাবড়ে গিয়ে একে একে সবাই সুড়সুড় করে আমার নির্দেশ পালন করল। পাশেই ছোট একটা ঘর। সেখানে রাইফেলগুলি স্তূপীকৃত হয়ে উঠল। এবার আমরা ওদের একটা হলঘরেরমধ্যে ঢুকিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে গট গট করে চলে এলাম বাইরে। এইখানে প্রথম দৃশ্যের শেষ।

 এবার দ্বিতীয় দৃশ্য। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে ট্রেজারি আর ব্যাঙ্ক লুট করার কথাও ছিল। কিন্ত এখন বুঝলাম অবস্থা গুরুতর। আপাতত আমাদের পরিকল্পনা থেকে সে দুটো ছাঁটাই করেই দিতে হবে। এবার পুলিশ ব্যারাক পেছনে ফেলে নবনিযুক্ত এসডিওর কুঠিতে গিয়ে উঠলাম। খবর পাঠাবার একটু বাদেই সেই অবাঙ্গালী এসডিও হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের সামনে চলে এল। আমার দিকে চোখ পড়তেই সে সসম্মানে আমাকে স্যালুট দিল। আমি তাকে উর্দু ভাষায় বললাম আমি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরী নির্দেশ নিয়ে এসেছি। এক্ষুণি মুসলিম লীগের আফসার উদ্দিন মোল্লা ও সিদ্দিক সিকদারকে ডেকে পাঠান। একটা বিষয় নিয়ে ওদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। এসডিও অতি সমাদরে আমাদেরকে একটা ঘরে নিয়ে বসালেন। একটু বাদেই যাদের ডাকানো হয়েছিল তারা এসে উপস্থিত হলো। ওরা ঘরে এসে ঢুকবার সাথে সাথেই আমরা তিনজন উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলাম। একই সঙ্গে তিনটি রাইফেল গর্জে উঠল। ওদের কথা বলবার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না। তিনটি দেহ একই সঙ্গে ভূমিশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে পর পর তিন বার গুলি ছুড়লাম, তারপর কাজ শেষ করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

 পেছনে লোকজনের কোলাহল আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাবার সময় নেই আমাদের। আমরা যেন ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছি। এতক্ষণে মনে পড়েছে, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে; সেটিকে শেষ করে যেতে হবে। আমরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে মুসলিম লীগের নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সামরিক সরকারের বড় দালাল ওয়াহিদুজ্জামান। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হলো। খবর নিয়ে জানলাম ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে গোপালগঞ্জে নেই। না-ই বা থাকল ওয়াহিদুজ্জামান, তার ভাই ফায়েকুজ্জামান তো আছে। সেও তো এই অপকর্মে তার ভাইয়ের সাথী। আপাতত তাকে দিয়ে আমাদের কাজ চলবে। কিন্তু কি আশ্চর্য এই ফায়েকুজ্জামান বন্ধ দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। কিন্তু আমাদের মুখের দিকে তাকাতেই, কে জানে কি করে আমার আসল রুপ আর আসল উদ্দেশ্যটা ধরে ফেলল। এতগুলি লোককে ঘোল খাইয়ে এলাম, কিন্তু তার সাবধানী চোখ দু'টিকে ফাঁকি দিতে পারিনি। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়ল সে, তারপর দরজার পাট দুটো আমাদের মুখের সামনে দড়াম করে বন্ধ করে দিল।

 ইতিমধ্যে ঘরের ভিতর থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কেমন জিদ চেপে গেছে, আমরা বাইরে থেকে পাল্টা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একটু বাদেই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারলাম। ইতিমধ্যে সারা শহর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পথের মোড়ে মোড়ে ভীড় জমে যাচ্ছে। এর পর আর শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপায় থাকবে না। অবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পেরে কাজটা অসামপ্ত রেখেই আমর ছুটে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা ছুটছি, আর ফাঁকা আওয়াজ করে চলেছি, সঙ্গে রাস্তা সাফ যাচ্ছে।

 নিরাপদে, সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে শহরের বাহিরে বেরিয়ে এলাম মৃত্যুর গহবর থেকে।

 প্রকাশ্য দিবালোকে গোপালগঞ্জ শহরের বুকের উপর এই সমস্ত ঘটনা ঘটে যাবার পর অবস্থা গরম হয়ে উঠল। সামরিক বাহিনী আর তাদের দালালরা মুক্তিবাহিন কে নির্মূল করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। আমরা যে অঞ্চলে ছিলাম সেখানকার জনসাধারণের উপর নানারকম জুলুম আর অত্যাচার চলল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজন ঐ অঞ্চল ছেড়ে মাণিকহার গ্রামে চলে এলাম। আমরা যেখানেই যাই সেখানেই স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে। তাছাড়া দীর্ঘলিয়া আর চন্দ্রদীঘলিয়ার মুক্তিযোদ্ধারাও সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল।

 মাণিকহারে এসে একটা মস্ত বড় খবর পেয়ে গেলাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে আটটা ফ্ল্যাট প্রায় দেড় লক্ষ মণ পাট বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছে। আমাদের শত্রুরা আমাদের এই পাট বিদেশে রফদানি করে মুনাফা লুটবে, আর হয়তো বা সেই টাকা দিয়ে আমাদের মারবার জন্য অস্ত্র আমদানী করবে। ফ্ল্যাটগুলি এই মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষেই চলে যাবে।

 এই খবর পেয়ে আমরা একদল মুক্তিযোদ্ধা এই ফ্ল্যাটগুলিকে অভ্যর্থনা করবার জন্য মাণিকদা গ্রামে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। অবশেষে যথাসময়ে ফ্ল্যাটগুলি মানিকদার কাছে তালাঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা আগে থেকেই ফ্ল্যাটগুলির উপর হামলা করবার জন্য তেরী হয়ে ছিলাম। ওরা পালিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারল না। আমরা ওদের সব পাট পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম।

 ১০ই মে তারিখ নারায়ণগঞ্জ থেকে রকেট স্টীমারটি সৈন্যদের রসদে বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। তাছাড়া এই স্টীমারে একজন মেজর নেতৃত্বে ৫০জনের মত সৈন্যও যাচ্ছিল। এই সৈন্যদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ছিল না এবং তারা সাদা পোশাকেই চলেছিল। রকেট স্টীমারটি ভালাঘাটে এসে ভিড়ল। আমরা তখনও মাণিকদাতেই ছিলাম। এই খবরটা আমাদের কাছে এসে গিয়েছিল। স্টীমারটা ঘাটে ভিড়বার সাথে সাথেই আমাদের মুক্তিবাহিনী তাকে ঘেরাও করে ফেলল। ওদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আরোহীদের নদীর তীরে নামিয়ে দিয়ে আমরা স্টীমারটিকে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর মেজরসহ সৈন্যদের খতম করে দেওয়া হলো।

 সেই দিনই রাত্রিতে খুলনা থেকে একটা রসদ-বোঝাই লঞ্চ এবং বরিশাল থেকে একটা সৈন্যবাহী লঞ্চ গোপালগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমরা খাদ্যবাহী লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিলাম। আমাদের প্রবল গুলিবর্ষণের ফলে রাত্রির অন্ধকারে সৈন্যবাহী লঞ্চটিও ডুবে যায়। এই অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর উৎপাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। গোপালগঞ্জের এসডিও হত্যা, দেড় লক্ষমন পাট পুড়িয়ে দেওয়া, সৈন্যবাহী লঞ্চ ডোবান-পর পর এই সমস্ত ঘটনা মুক্তিবাহিনীর প্রভাব বাড়িয়ে চলেছিল; অপরপক্ষে সামরিক কর্তৃপক্ষের মর্যাদার হানি ঘটছিল। তাই আমাদের নির্মূল করে দেবার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগল।  সেই দিনটা ছিল ১১ই মে। এই তারিখটা আমার পক্ষে ভূলে যাওয়া সম্ভব নয়। ওদের গুপ্তচরের মুখে ওরা আমাদের অবস্থানটা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে ওরা লঞ্চ বোঝাই সৈন্য নামাল। ব্যাপারটা আমরা একেবারেই টের পাইনি। যখন টের পেলাম, তখন আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে এসেছি। সেই ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসা সহজ কথা নয়। আমার কথা বলি, আমি ওদের একদল সৈন্যর একবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভাল, ওরা আমাকে ওদের একজন বলে ভুল করে বসেছিল। তাই আমার কাছ থেকে ওরা আক্রমণ আশঙ্কা করেনি। আর আমিও ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় মেশিনগান দিয়ে এক পশলা গুলিবর্ষনের সুযোগ পেয়ে গেলাম। ফলে ওদের মধ্যে অনেক সৈন্য হতাহত হলো। সেদিন আমরা গুলি চালাতে চালাতে বহু কষ্টে ওদের সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি নিজে একবারে অক্ষত অবস্থায় চলে আসতে পারিনি। এতদিন এত সমস্ত সংঘর্ষের মধ্যেও আমার গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। কতবার কত গুলি আমার কানের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে, কতবার কত গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে অক্ষত দেহে বেরিয়ে এসেছি। ফলে আমার মনে মনে কেমন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, ওদের গুলি আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু আজ শত্রুরা আমার দেহে ওদের দাঁত বসিয়ে দিয়েছি। বইরে বেরিয়ে এসে দেখি আমার এই হাত থেকে অবিরাম ধারার রক্ত ঝরে চলেছে। আমার হাতে একই সঙ্গে তিনটি গুলি এসে বিদ্ধ হয়েছে।

 বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ তাঁর ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বাঁ হাতখানি আমার সামনে তুলে ধরলেন।

 কি করেলেন তারপর? জখম হাতটার কি ব্যবস্থা করলেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

 আমি যে জখম হয়েছি, ওরা এই খবরটা জানতে পেরেছিল এবং আমি কে সেটাও ওদের অজানা ছিল না। ইতিমধ্যে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসাবে আমার নামটা এখানকার সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করেছিল, আমি নিশ্চয়ই আমার এই জখমটার চিকিৎসার জন্য কাছাকাছি কোন ডাক্টারখানায় বা কোনও ডাক্টারের কাছে যাব। তাই ওরা আমাকে ধরবার জন্য সেই সব জায়গায় হামলা করেছে। কাজেই আমার পক্ষে সেইসব জায়গায় যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আট-দশ দিন বিনা চিকিৎসাতেই কাটল। ফলে সেপটিক হয়ে আমার হাতটা পেকে উঠল। ঐ অবস্থায় আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত মারা যেতাম। তখন বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন জখম চিকিৎসার জন্য বর্ডারের ওপারে চলে যেতে হবে। আমার অবস্থা যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তাতে এ ছাড়া আমার বাঁচার আর কোন উপায় ছিল না।


  1. সাক্ষাৎকারদাতা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৩০ মাইল দূরে কোটচাঁদপুর ও জগদীশপুর এলাকায় কালেকটিভ ট্রেনিংয়ে ছিলেন।
  2. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ" গ্রন্থ থেকে সংকলিত।