বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৯

উইকিসংকলন থেকে

সশস্ত্র প্রতিরোদ: রংপুর দিনাজপুর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। রংপুর দিনাজপুর জেলায় প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

সশস্ত্র প্রতিরোধে ৩য় বেঙ্গল[১]

সাক্ষাৎকার: মেজর মোঃ আনোয়ার হোসেন

......১৯৭২

 ১৯৭১ সাল ২৫শে মার্চ আমি সৈয়দপুর সেনানিবাস ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোয়াটার মাষ্টার হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দপুরে বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালীদের ভিতর প্রথমে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় ও পরে অবাঙ্গালীরা বাঙ্গালীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের জোয়ান ও অফিসারদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সব সময়ের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, যে কোন সময়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।

 সেই সময় আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজল করিম (পাঞ্জাবী), ২য় অধিনায়ক মেজর আকতার (পাঞ্জাবী) ও ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিক (পাঞ্জাবী) আমাদের ব্যাটালিয়ন ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্য বাঙ্গালী অফিসার দ্বারা বিভিন্ন কোম্পানীকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য পাঠায়: ১। মেজর নিজাম, লেঃ মোখলেস ও ২য় লেঃ রফিকসহ বি ও ডি কোম্পানীকে রংপুর জেলার ঘোড়াঘাটে পাঠানো হয়; ২। ক্যাপ্টেন আশরাফকে সৈয়দপুর ও দিনাজপুর রোড়ের মধ্যবর্তী মগুলপাড়া নামক স্থানে বৈদ্যুতিক সংযোগস্থল পাহারার জন্য ৪০ জন জোয়ান দিয়ে পাঠানো হয়; ৩। সুবেদার রহমতুল্লাহ ও আবঙ্গালী মেজর শাফায়াৎ হোসে কে সঙ্গে দিয়ে ১ প্লাটুন পার্বতীপুর পাঠানো হয়; ৪। মর্টার প্লাটুনের জোয়ানদিগকে মর্টার রেখে দিয়ে শুধু রাইফেল দিয়ে শহরের অনতিদূরে পাওয়ার হাউস পাহারার জন্য পাঠানো হয়। ১৭ মার্চ অয়ারলেস সেট ও ভারী হাতিয়ারগুলি ব্যাটালিয়ন হেডকোর্টার থেকে ব্রিগেড হেডকোর্টারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।

 আমি কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে থাকায় ব্যাটালিয়ন হেড কোয়াটারের কাছে নিয়োজিত ছিলাম। সেই সময় দেশের পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক ছিল। ২৪ শে মার্চ আমাকে এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর হারি কে ব্রিগেডিয়ারের অফিসে ডাকা হয়। ব্রিগেডিয়ার আমাকে ও সুবেদার মেজর সাহেবকে বাইরের গুজব না শুনে শৃঙ্খলার সাথে দয়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন, কিন্তু আমাদের ২য় অধিনায়ক মেজর আকতারের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বহু সময় আলাপ আলোচনা করেন। এতে আমাদের মনে আরো সন্দেহের ভাব উদয় হল।

 ২৮শে মার্চ মণ্ডলপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন আশরাফ অফিসে আসে এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানায়। তখন ২৩ ফিল্ড রেজিমেণ্টের ১ জন বাঙ্গালী অফিসার লেঃ সালামকেও ডাকা হয়। আমরা তিনজন রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভবিষ্যতে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। সৈয়দপুর সেনানিবাসে অপর যে দুইটি ব্যাটালিয়ন ছিল ঐ ব্যাটালিয়ন দুইটির ৩১শে মার্চ রাত্রে বগুড়ায়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা ঐ সময়ে সৈয়দপুর সেনানিবাস দখল করার সিদ্ধন্ত নিই। সেই অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আশরাফকে এক ট্রাক গোলা বারুদ মণ্ডলপাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়ে দিই।

 ৩১শে মার্চ রাত্রি আড়াই ঘটিকার সময় ২৬এফ-এফ ব্যাটালিয়ন ও ২৩ ফিল্ড রেজিমেণ্ট গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ব্যারাকের উপর অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালায় কিন্তু আমরা সতর্ক থাকায় সকাল ১০টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়, এবং তারা আমাদের ব্যারাকে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। পাক বাহিনী মাইক দ্বারা প্রচার করতে থাকে, তোমরা আত্মসমর্পণ কর, তোমাদিগকে কিছু করা হবে না। সেই সময় আমাদের অবস্থানের চারিপাশ তারা ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমরা তখন বাধ্য হয়ে সেনানিবাস ছেড়ে ফুলবাড়ী নামক স্থানে ডিফেন্স নিই। সাথে সাথে আম্মাদের বাইরে অবস্থানরত অন্য সকল কোম্পানিকে এই ঘটনা অবগত করি।

 ১লা এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ তার অবাঙ্গালীর মেজর সাফায়েৎ হোসেনকে হত্যা করে এবং সমস্ত জোয়ান নিয়ে ফুলবাড়ীতে চলে আসে।

 ৩রা এপ্রিল ঘোড়াঘাটে অবস্থানরত বি ও ডি কোম্পানী ফুলবাড়ী এসে পৌছে। সেই সময় আমাদের মোট শক্তি ছিল ৪৫০ জনের মত। ৪/৫ তারিখে ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করা হয় ও তিনটি কোম্পানীতে ভাগ করা হয়।

 ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় মেজর নিজাম সাহেবকে। ১টি কোম্পানীর দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন আশরাফকে। লেঃ মোখলেসকে দেওয়া হয় ১ টি কোম্পানীর দায়িত্ব। অপর কোম্পানীর দায়িতু ন্যস্ত হয় আমার উপর। ক্যাম্পে আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে দিনাজপুরে পথ দিয়ে সৈয়দপুর আসবে স্থির হয়। সৈয়দপুর থেকে তিন মাইল দূরে ৮ই এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে তার কোম্পানীর ভীষণ যুদ্ধ বাধে। এখানে পাকবাহিনীর তিনটি গাড়িসহ বহু পাকসেনা হতাহত হয়। লেঃ মোখলেস তার কোম্পানী নিয়ে নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুর আসবে ঠিক হয়। আমার কোম্পানী এবং হেডকোয়ার্টার কোম্পানী নিয়ে আমি ফুলবাড়ী থেকে খোলাহাটিতে শিবির স্থাপন করি।

 ৭ই এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ ১টি প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুর চলে যায়। আমি সেই দিনই আমার কোম্পানী নিয়ে বদরগঞ্জে ডিফেন্স করি।

 ৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী বদরগঞ্জে আমাদের ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ খান মালেক যুদ্ধ পরিচালনা করে। সকাল ৯ ঘটিকা থেকে বিকাল ৪ ঘটিকা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। শেষে পাক বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের জোয়নরা পিছন হটতে থাকে। এই সময় আমি এক ডিফেন্স থেকে অন্য ডিফেন্সে যাওয়ার সময় বদরগঞ্জ বাজারে পাক বাহিনীর ঘেরাওয়ে পড়ে যাই। তখন তারা আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে আমার গাড়ির ড্রাইভার মারা যায়। আমি তখন গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে অন্য দিকে বদরগঞ্জ বাজারের ভিতর ঢুকে পড়ি। সেখান থেকে বহু কষ্টে বের হয়ে বদরগঞ্জ রেল ষ্টেশন হয়ে আড়াই মাইল গ্রামের ভিতর চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমার জোয়ানদিগকে দেখতে পাই। তখন আমার শরীর রক্তাক্ত ছিল এবং পা গুলিবিদ্ধ ছিল। সেখান থেকে আমাকে ফুলবাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে আমার কোম্পানী খোলাহাটিতে চলে যায়।

 ১০ই এপ্রিল সকালে পাক বাহিনী খোলাহাটি আক্রমণ করে। সেখানে পাক বাহিনীর সাথে আমার কোম্পানী টিকতে না পেরে ফুলবাড়ীতে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেঃ মোখলেসের কোম্পানীও ফুলবাড়ীতে চলে আসে।

 ১১ই এপ্রিল পাকবাহিনী ফুলবাড়ী আক্রমণ করে। ফুলবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের ব্যাটালিয়নের ভীষণ যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের পুরা ব্যাটালিয়ন চরখাইয়ে চলে যায়। চরখাইয়ে ডিফেন্স করে কোম্পানীগুলিকে নিন্মলিখিত গুরুত্বপূর্ণ পথে ডিফেন্সে বসানো হয় যাতে পাকবাহিনী চরখাই আক্রমণ করতে না পারেঃ (১) ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানিকে ফুলবাড়ী-চরখাই রোডে বসানো হয়; (২) আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে ডিফেন্স নিই; (৩) লেঃ মোখলেসের কোম্পানীকে ডেপথ কোম্পানী হিসাবে রাখা হয়।


 ১৩ই এপ্রিল সংবাদ পাওয়া গেল পাকবাহিনী বগুড়া দখল করে নিয়েছে। তাই পাকবাহিনী বগুড়া জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি রোড হয়ে হিলি দখল করে নিতে পারে ভেবে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পাঁচবিবি-হিলি রোডে ডিফেন্স নিই। অপর ২ কোম্পানী চরখাইতেই ডিফেন্স নিয়ে থাকে।


 ১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী পাঁচবিবির দিক থেকে হিলি আক্রমণ করে। সেই দিন পাকবাহিনীর সাথে আমাদের চার ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয় ও আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে তারা পিছন হটতে বাধ্য হয়। সেই দিন চরখাই থেকে ২ কোম্পানীকে হিলি চলে আসার নির্দেশ দিই। সেই সময় ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেঃ মোখলেস তাদের জোয়ানদের ফেলে চলে যায়।


 ২০শে এপ্রিল সুবেদার হাফিজ, নায়েক সুবেদার করম আলী, নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ দুই কোম্পানীসহ হিলিতে আমার নিকট পৌঁছে। সেই দিন খুব ভোরে পাকবাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করে। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সাথে আমাদের তীব্র যুদ্ধ চলে। অবশেষে পাকবাহিনী পিছন হটতে বাধ্য হয়। এদিকে পাকবাহিনীর মর্টার ও শেলিং-এ ভারতীয় সীমান্তের কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়। ফলে, ভারতীয় বি-এস-এফ কর্নেল মুখার্জী, পশ্চিম দিনাজপুরের ডি-এম ও পুলিশ সুপারের অনুরোধে ২০ তারিখ গভীর রাতে আমাদের ডিফেন্স ভেঙ্গে দিয়ে হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামালপাড়া নামক স্থানে কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইনষ্টিটিউটে ২৫০ জনের মত জে, সি, ও, ও জোয়ান আশ্রয় নিই। এই যুদ্ধে ৬ জন জোয়ান শাহদাৎ বরণ করে। সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে চরখাই ও হিলি সরকারী গুদাম থেকে ৪শত বস্তা চাউল নিয়ে যাই। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী হিলি দখল করে নেয়।


 ভারতে অবস্থানকালে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে কামারপাড়া, সোবরা এবং আঙ্গিনাবাদে তিনটি অপারেশন ক্যাম্প স্থাপন করি। সুবেদার রহাফিজকে আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমাণ্ডার, সুবেদার আলী নেওয়াজকে কামারপাড়া ক্যাম্প ও জয়পুরহাট চিনি মিলের একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে সোবরার ক্যাম্প কমাণ্ডার হিসাবে নিযুক্ত করে আমি উক্ত তিনটি শিবির পরিচালনা করি।


 সেই সময় বাংলাদেশের কমাণ্ডার-ইন-চীপ কর্নেল এম, এ, জি. ওসমানী বালুরঘাট আসেন এবং আমাকে হিলি সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে নিযুক্ত করেন। ১৩ই মে পর্যন্ত আমি হিলি সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করি। আমি সেক্টর কমাণ্ডার থাকাকালে আরো তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করি- মালন ক্যাম্প, তরঙ্গপুর ক্যাম্প ও তপন ক্যাম্প। মেজর নাজমুল হক আমার নিকট থেকে দায়িত্বভার বুঝে নেন এবং তৎকালীন মেজর বর্তমান কর্নেল শাফায়েৎ জামিল ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। আমি আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমাণ্ডার হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করি।


 এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় ও পাকবাহিনীর চলাচলের পথে এ্যাম্বুশ করে পাকবাহিনীকে নাজেহাল ও তাদের ক্ষতি সাধন করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন করে পাকবাহিনীকে সেখান থেকে প্রতিহত করে ২ ট্রাক ঔষধ, ৬০ বস্তা চিনি ও কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়।

  ২৯শে মে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এক কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর-এর জোয়ান নিয়ে হরতকিডাঙ্গা নামক স্থানে পাকবাহিনীর গতিপথের উপর এ্যাম্বুশ করি। সেই সময় পাকবাহিনীর এক কনভয় উক্ত পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ আনুমানিক ৩০ জন নিহত হয় ও একখানা জীপ ধ্বংস হয়। আমাদের পক্ষে ইপিআর-এর জলিল শাহাদাৎ বরণ করে। সেখানে একটি পিআরসি-১০ আয়ারলেস সেট ও একটি এস-এম-জি উদ্ধার করি।  ২৮শে মে দিনাজপুর-ফুলবাড়ী রোডে মোহনপুর ব্রীজ এক্সপ্লোসিভ দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানেই এ্যাম্বুশ বসান হয়। ২৯শে মে ১০-১০ মিনিটে পাকবাহিনীর এক কোম্পানী ঐ পথে অগ্রসর হওয়ার সময় আমরা অতর্কিত আক্রমণ করি। সেখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের চার ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এখানে পাকবাহিনীর ১১ জন নিহত হয় ও ২০ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে ২ জন শহীদ হয় ও একজন আহত হয়। তাছাড়া জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রামগতি, ফুলবাড়ী, চরখাই, রামনগর, জলপাইতলী, বাজাই, আমবাড়ী, গৌরীপুর, মন্মথপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে রেইড, কমাণ্ডো ও এ্যাম্বুশ করে পাকবাহিনীর বহু ক্ষতি সাধন করি।

সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর
সাক্ষাৎকার ; লেঃ মোঃ আবদুস সালাম
৭-৬-১৯৭৩

 ২৬শে মার্চ সকাল বেলা রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’ জারী করার কথা শুনতে পাই। এই সময় হাজার হাজার ক্রদ্ধ জনতা শ্লোগান দিতে দিতে টোগরাই হাট রেল ষ্টেশনে আসে এবং ৩ মাইল পর্যন্ত রেল লাইন তুলে ফেলে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

 ২৭শে মার্চ রংপুর থেকে একজন আর্মি ক্যাপ্টেন (নওয়াজেশ) আমাদের এখানে পালিয়ে এসে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোক্তার আহম্মদ হোসেন সরকার সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে পারি যে, ঢাকা থেকে একটা টেলিফোন আসে, তাতে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে মেরে ফেলতে বলা হয়। ঘটনা চক্রে সেই সময় টেলিফোনের সামনে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ নিজেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি টেলিফোনে উত্তরে বলেন যে, এখনই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে হত্যা করছি।

 ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বিভিন্ন জায়গা থেকে পলায়নরত বাঙ্গালী পুলিশ, ইপি-আর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টসহ ছাত্র-জনতাকে নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেন এবং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সঙ্গে আমি থানাতে গিয়ে ও, সি, কে কিছু রাইফেল দেবার জন্য বলি। কিন্তু ও,সি, রাইফেল দিতে অসম্মত হলে পরে তাকে রাইফেল দিতে বাধ্য করা হয়। থানা থেকে আমরা ২৫০টি রাইফেল যোগাড় করি।

 ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে আমরা তিস্তা নদীর পারে ডিফেন্স নিই। নদীর অপর পারে অবস্থানরত খান সেনারা রাত্রিতে আমাদের উপর শেলিং আরম্ভ করে। বলা প্রয়োজন যে, ঐ দিন সকাল ১০ টার দিকে যখন আমরা চুপচাপ ডিফেন্স নিয়েছিলাম তখন খান সেনারা আমাদের অবস্থান জানতে না পেরে তিস্তা রেল ব্রিজের উপর দিয়ে কিছু খান সেনা এপার আসে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালাই। ঘটনাস্থলেই একজন মেজরসহ ৮ জনকে হত্যা করতে সক্ষম হই। এই মেজরটির নাম ছিল মেজর এজাজ। পরবর্তীকালে তিস্তা ব্রিজের নাম পালটিয়ে খান সেনারা মেজর এজাজের নাম অনুসারে “এজাজ ব্রিজ” রাখে।

 এখানে পাক বাহিনীর শেলিং-এর মুখে টিকতে না পেরে আমরা সেখান থেকে পিছু হটে কুড়িগ্রামে ডিফেন্স নিই। ৮ই এপ্রিল খান সেনারা কুড়িগ্রাম আক্রমণ করে। কুড়িগ্রামে ডিফেন্স নিই। ৮ই এপ্রিল খান সেনারা কুড়িগ্রাম আক্রমণ করে। কুড়িগ্রামের ৩ মাইল বাইরে আমরা টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। ৮ তারিখে খান সেনারা কুড়িগ্রাম দখল করে এবং ব্যাপক গণহত্যা করে এবং বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জুলিয়ে দেয়। তারা পরে সোনালী ব্যাঙ্কও লুট করে। ৯ তারিখে ছাত্র এবং গ্রামবাসী মিলে টোগরাইহাট থেকে তিস্তার প্রায় দশ মাইল রেল লাইন তুলে দিই যাতে করে খান সেনারা আমাদের এলাকায় তাড়াতাড়ি প্রবেশ করতে না পারে।

 টোগরাইহাটের যুদ্ধঃ আমরা পুনরায় প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই এবং ১৫ তারিখে আমরা টোগরইহাটে ডিফেন্স নিই। খান সেনারা কুড়িগ্রাম থেকে একটা ট্রেন নিয়ে লাইন সারতে সারতে তিস্তার দিকে যাচ্ছিল। ট্রেনটা যখন টোগরাইহাটের নিকট আসে তখন আমরা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে খুব দূরে থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়ি। এই গুলির আওয়াজে খান সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নেয়। পুনরায় আরও কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়লে খান সেনারা গুলির শব্দ যেদিক থেকে আসছিল সেই দিকে ধাওয়া করে। তারা যখন আমাদের নিকটবর্তী হয় তখন আমরা তাদের উপর আক্রমণ করি। উভয় পক্ষ থেকে সমান তালে যুদ্ধ চলতে থাকে। এই যুদ্ধ ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধে বহু খান সেনা নিহত হয় বলে আমরা খবর পাই, আর বাদ বাকী সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

 যুদ্ধ শেষে আমরা যখন তিস্তা ব্রিজের দিকে যাছিলাম তখন রাস্তায় খান সেনাদের তিনটা দালালকে ধরতে সক্ষম হই। এরা ঐ অঞ্চলে লুটতরাজ, ডাকাতি, নারী ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত ছিল। ঘটনাস্থলেই তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

সৈয়দপুর-রংপুর প্রতিরোধে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মোহাম্মাদ আবদুল খালেক
১১-১০-১৯৭৩

 ৩য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে দুটো কোম্পানী লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল ফজল করিমের নেতৃত্বে (যিনি ৩য় বেঙ্গলের কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন) বগুড়াতে চলে যায়। দুটো কোম্পানী মেজর নিজামউদ্দীনের নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে (দিনাজপুর) পাঠানো হয় অনির্ধারিত সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য। দু’জন জুনিয়র অফিসার এবং কয়েকজন জেসিও-ও সাথে ছিল। হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ইউনিট লাইনকে রক্ষা করার জন্য সৈয়দপুরে থেকে যায়।

 ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিনগুলোতে প্রতিবেশী ইউনিট ২৬ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট এবং ২৩ ফিল্ড গোলন্দাজ বাহিনীর কোন নির্ধারিত প্রশিক্ষণ সূচী ছিল না। ২৩ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের কমাণ্ডিং অফিসার লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল আরশাদ কোরেশীকে সৈয়দপুর গারিসন কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর সবাইকে নিজেদের কাজকর্ম ছাড়াও তার নির্দেশমত কাজ করতে হত। ২৬ ফ্রণ্টিয়ার কোর্স-এর কিছু লোক আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং আয়ারলেস সেটসহ পানির ট্যাঙ্ক পাহারা দেওয়ার ভান করে ইউনিটে থাকতে আরম্ভ করে। অপরপক্ষে ২৩ গোলন্দাজ বাহিনী তাদের কিছুসংখ্যক মেশিনগানকে আমাদের ইউনিটের অস্ত্রাগার, খাদ্য গুদাম, গ্যারেজ প্রভৃতি লক্ষ্য করে তাক করে রাখে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এগুলো লাগিয়েছি।

 এ ছাড়াও তারা স্থানীয় জনসাধারণের উপর নানা রকম নির্যাতন চালাচ্ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় জনসাধারণ সেনানিবাসে সৈনিকদের রসদপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামে গিয়ে জোর করে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে হাঁস, মুরগী, ডিম, তরকারী নিয়ে আসত। কিন্তু বাঙ্গালী সৈন্যরা গ্রামে গেলে জনগণ তাদেরকে সবকিছু দিয়ে সাহায্য করত।

 এই সময় বগুড়ার ছাত্ররা বগুড়াতে যেখানে আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার অবস্থান করছিলেন সেই ভবনের উপর বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তারা সি-ওকে ঘেরাও করে রেখেছিল। কমাণ্ডিং অফিসার বগুড়া থেকে ঘোড়াঘাটে চলে যান। সেখানে আরো দুটো কোম্পানী ছিল।

 ১৫ই মার্চ আটিলারী রেজিমেণ্ট আমাদের ইউনিটের চারিদিকে পরিখা খনন করতে শুরু করে। আমরা ঘোড়াঘাটে আমাদের সি-ওকে এ খবর জানালাম। কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল শফি (২৩ আর্টিলারী রেজিমেণ্ট) কে এগুলো বন্ধ করতে অনুরোধ জানালেন। তাঁর অনুরোধে এ সমস্ত কাজ বন্ধ করা হয়েছিল।  মেজর আখতার রিয়ারে ও-সি হিসাবে রিয়ারে রয়ে গিয়েছিলেন। সে তার বাসায় টেলিফোন বসিয়েছিল। এমনকি গোপন আয়ারলেস-এর সাহায্যে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী ইউনিট-এর খবরাখবর এবং যোগাযোগ রাখত। সে অনেক সময় কমাণ্ডিং অফিসারের নির্দেশ পালন করত না। আমরা এ সমস্ত খবরাখবর মেজর আখতারের উপস্থিতিতে আমাদের সি-ওকে জানালাম। এ সমস্ত কার্যকলাপের কথা শুনে সি-ও-আর ঘোড়াঘাটে গেলেন না। তিনি ইউনিটে রয়ে গেলেন। তিনি আমাদেরকে সব সময় সাতুনা দিতেন এবং আমাদের উপর কোন হামলা হবে না আশ্বাস দিতেন।

 রংপুরের ব্রিগেড কমাণ্ডার আমাদের সি-ওকে ঠাকুরগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর এবং পার্বতীপুরে যে সমস্ত সৈন্য আটকা পড়ে আছে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য বলেন।

 ৩১শে মার্চ বেলা সাড়ে বারটার দিকে রংপুর থেকে ব্রিগেড কমাণ্ডার সি-ওকে টেলিফোনে ডাকেন। তিনি ব্রিগেড কমাণ্ডারের সাথে কথা বলেন এবং দু’টার সময় অফিসে আসেন। সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে তিনি ডেকে পাঠান এবং তাঁরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা করেন। বের হয়ে সকলের উদ্দেশ্যে তিনি এক ভাষণ দেন, ‘হাজেরানে অফিসার, সরদার আওর জোয়ানো, আপ সবকে লিয়ে ম্যায় এক খোশখবর লে আয়া হু। ওয়হ ইয়ে হ্যায় কে কোর কমাণ্ডার, জিওসি আওর ব্রিগেড কমাণ্ডার কি তরফছে আপ সবকো মোবারকবাদ হয়। ইস লিয়ে কে ইস ওয়াকত তক কিছি পলিটিকাল পাটিও নে হিসসা নিহি লিয়ে, আওর ম্যায় দাওয়া কে সাথ কাহ সেকতা কে থার্ড ব্যাটালিয়ন হর তরফছে পাকিস্তান সরকারকে ওফাদার রহেগী। ম্যায় আপসে ওয়াদা করতে হুঁ আপ বরদাস্ত করে আওর মুঝ পর ভরোসা রাক্ষে- উছ ওয়াকত তক আপকো কুয়ি কুছ নেহি বোলেগা যব তক মুঝ পর কুইভি কুছ না বোলে। তারপর তিনি এ্যাডজুট্যাণ্ট লেফটেন্যাণ্ট সিরাজুল ইসলাম এবং তিনজন এনসিও ও ৩০ জন সিপাই সাথে নিয়ে রংপুর রওনা হয়ে যান, এবং সেখান থেকে তিনি বগুড়া যান ২৬ এফ এফ এবং ২৩ ফিল্ড রেজিমেণ্ট আটিলারী সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার জন্য-যারা বগুড়াতে ইপিআরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিল।

 সেদিনই বেলা সাড়ে চারটার সময় ২৬ এফ-এফ এবং ফিল্ড রেজিমেণ্ট (আর্টিলার) ৬৪টা কনভয় নিয়ে ঘোড়াঘাটের দিকে যায়। সেখানে ৩য় বেঙ্গলের দুটো কোম্পানী ছিল। তারা তাদের উপর অতর্কিতে ভীষণভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। অনন্যোপায় হয়ে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকেরা ছোট অস্ত্র দিয়ে প্রত্যুত্তর দেয়। ঘটনাস্থলে ওদের ১৩ জন নিহত হয়। গ্যারিসন কমাণ্ডার লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল কোরেশী এবং আরো কয়েকজন সাদা পতাকা উত্তোলন করে বরং অস্ত্র সমর্পণ করে এবং বলে যে তারা মনে করেছিল এখানে ইপিআর-এর লোকজন আছে। তারা মেজর নিজামের সাথে আলাপ করল। মেজর নিজাম তাদেরকে চা পানে আপ্যায়িত করেন। লেফটেন্যাণ্ট রফিক তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে যায়। যখন লেঃ রফিক কোরেশীর সাথে করমর্দন করছিল তখন কোরেশী তাকে তাঁর জীপে উঠিয়ে নেয় এবং দ্রুত চলে যায়। সাথে সাথে এলএমজি থেকে কয়েক রাউণ্ড গোলা বষর্ণ করা হয় এবং আমাদের তিনজন খেলোয়াড় ঘটনাস্থলে মারা যায়।

 আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার যখন রংপুর থেকে ৩০ মাইল দূরে পলাশবাড়ীর নিকটে আসেন তখন তিনি কোরেশীর কনভয়গুলো দেখতে পান। তারা সি-ওর জীপ এবং অন্য দুটো ডজ গাড়ী থামায় এবং কমাণ্ডিং অফিসারসহ সমস্ত বাঙ্গালী সৈনিককে গাড়ী থেকে নামানো হয় এবং নিরস্ত্র করা হয়। বংগশার্দুলদের তিনটা গাড়ী তাদের কনভয়-এর মাঝখানে রেখে তারা রংপুরের দিকে চলে যান। এই সময় লেঃ রফিক লেঃ সিরাজুল ইসলামের সাথে আলাপ করতে সমর্থ হয়। লেঃ রফিক লেঃ সিরাজুল ইসলামকে কানে কানে ঘোড়াঘাটের ঘটনা বলে।

 কনভয়গুলো রংপুরে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে রাত ৮টার সময় পৌছে এবং কর্নেল কোরেশী ব্রিগেড কমাণ্ডারের সাথে আলাপ করে। কিছুক্ষণ পর আবার কনভয়গুলো সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হয়। সৈয়দপুরের দু’মাইল নিকট চেকপোষ্ট তৈরী করা হয়। সেখানে বংগশার্দুলদের (৩৩ জন ছিল) সবাইকে একটা অন্ধকার দালানে তালা বন্ধ করে রাখা হয়। লেঃ সিরাজুল ইসলাম এবং রফিককে অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।

 আমাদের কাছে কোন আয়ারলেস সেট না থাকাতে বাইরের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। ঢাকা থেকেও কোন খবর পাই নাই। কিন্তু সৈয়দপুরে আমরা মোট ১২০ জন ছিলাম। আমরা সব সময় সতর্ক ছিলাম। আমাদের অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে ছিল।

 ২০শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কোন চিঠিপত্র পাচ্ছিলাম না। ৩১শে মার্চ প্রচুর চিঠিপত্র আসল। আমি ওগুলো দেখতে পারলাম না, কেননা মেজর আখতার, ক্যাপ্টেন মালিক এবং আরো অনেকে আমার কোয়ার্টারে এসেছিল।

 তারা বেলা ১টার সময় আমার বাসা থেকে চলে যায়। তারপর আমি অফিসে গেলাম। মেইল দেখে বাসায় ফিরছিলাম। মেজর আখতারকে আমাদের কমাণ্ডিং অফিসারের গাড়ীতে করে ঘুরতে দেখলাম।

 আমি বাড়ীতে পৌঁছলাম এবং খেতে বসলাম। তখনও আমি জীপের আওয়াজ শুনছিলাম। আগে থেকেই মেজর আখতারের কার্যকালাপ সন্দেহজনক ছিল। তাই খাওয়া ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসলাম। সুবেদার আলী আহম্মদকে জীপটা সম্বদ্ধে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল যে, মেজর আখতার সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে ২৬এফএফ-এর কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে নিয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গেলাম এবং সুবেদার-মেজর এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে সেখানে দেখলাম। আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার ২২৬এফ, এফ রেজিমেণ্ট অফিস থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার-মেজর হারিস মিয়াকে উপস্থিতির জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। সে সংবাদ আমাকেও তারা জানান। ওখানে বসা অবস্থায় আবারও কমাণ্ডিং অফিসারের টেলিফোন আসে না। তিনি ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে ২৬এফ-এফ-এর অফিসে সুবেদার-মেজরসহ যাওয়ার জন্য পীড়াপীড় করছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাতে সায় দেন নাই। বরং তিনি সি-ওকে নিজেদের অফিসে আসার জন্য অনুরোধ করছিলেন। কমাণ্ডিং অফিসারের নির্দেশ অমান্য করার প্রধান কারণ হল মেজর আখতারের সন্দেহজনক কার্যকালাপ-যেহেতু তিনি নিজ অফিস সত্ত্বেও এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর জীপ অফিসের সামনে দাঁড় করান নাই। কমাণ্ডিং অফিসার আবার ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে বলেন “আনোয়ার, অনুগ্রহ করে তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস-ম্যায় তোমহারা ভালাই কালিয়ে বোলা রাহা হোঁ।” আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ারের টেলিফোন হ্যাণ্ড সেটের সংলগ্ন থাকায় কমাণ্ডিং অফিসারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে কণ্ঠস্বর কাঁপছিল বলে মনে হচ্ছিল। সুতরাং আমি তাদের যাবার জন্য সায় দিলাম না। তৎক্ষণাৎ সেখানে নায়েক সুবেদার (এ্যাডজুট্যাণ্ট) শহীদউল্লা ভূইঞা (শহীদ) উপস্থিত হন। আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছিলাম। আনুমানিক ১৫/২০মিনিটের মধ্যে সমস্ত পরিবারবর্গ আমার বাসায় সমবেত হয়।

 ঠিক ১লা এপ্রিল রাত ২-৪৫ মিনিটের সময় গোলন্দাজ বাহিনীর শেল বা গোলা আমাদের মোটর ট্রান্সপোট গ্যারেজ ও পেট্রল ডাম্পে এসে পড়ে। সেখানে সমস্ত যানবাহন আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়। এত ভীষণভাবে গোলা বর্ষণ হচ্ছিল যার দরুন রাস্তার উপর বৈদ্যুতিক তারসমূহ ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কয়েকটা দালান, অস্ত্রাগার, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ গুদাম ধসে পড়ে যায়। তবুও অসমসাহসী ১২০ জন বংগশার্দুল সকাল ৮-৩০-মিনিট পর্যন্ত বীর বিক্রমে তাদের ওপর এই কাপুরুষোচিত আক্রমণকে প্রতিহত করে। জনশক্তি কম থাকায় এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ না থাকায় তারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। শত্রর সংখ্যা ১৬০০ ছিল এবং তারা আধুনিক ভারী এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল।  ১লা এপ্রিল ভোর ৫-৩০ টা নাগাদ আমি সমস্ত পরিবার-পরিজনকে (তারা প্রায় ৩০০ ছিল) নিকটবর্তী গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হই।

 এরপর আমি আমার বাসার নিকটবর্তী পরিখায় ১টা ষ্টেনগান, একটা এলএমজি এবং কিছু গোলাবারুদসহ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সকাল ৮-৩০টার সময় আমার সামনে একটা মটারের গোলা এসে পড়ে। সুতরাং আমি পরিখা ত্যাগ করে গ্রামের দিকে অন্যান্য সঙ্গীদের খোঁজে চলে যাই।

 আনুমানিক ১২-৩০টার সময় সেনানিবাস থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল দূরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন আমার যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ম অনুসারে আমার সুবেদার পদবী কাঁধ থেকে অপসারিত করেন এবং সান্ত্বনা দেন। আমরা আমাদের সৈন্যসংখ্যা গণনা করে মাত্র ৫০ জন দেখতে পেলাম। তারপর আমরা অন্যান্যদের খোঁজে বেরুলাম। কিছুসংখ্যক গুলীবিদ্ধ সৈন্যকে নিকটবর্তী বদরগঞ্জ বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাঁচজন বংগশার্দুল শহীদ হয়। বাকি সবাইকে দূরদূরান্ত থেকে একত্রিত করা হয়।


 পূর্বে রাত্রে প্রায় ৪-৪৫টার সময় আমি সুবেদার রহমতউল্লার কাছে একটি চিরকুট পার্বতীপুর পাঠাই। সেখানে মেজর শাফায়াত হোসেনের (পশ্চিম পাকিস্তানী) অধীনে প্রায় ৫০ জন বংগশার্দুল ছিলেন। উক্ত চিরকুট তার কাছে বেলা ৮ ঘটিকায় পৌঁছে এবং তার মর্মানুসারে তিনি মেজর শাফায়াতকে হত্যা করে আমাদের সাহায্যের জন্য গ্রামের পথে অগ্রসর হন। সৌভাগ্যবশতঃ তার সাথে পথিমধ্যে আমাদের দেখা হয়। অনুরুপ সংবাদ ঘোড়াঘাটে মেজর নিজামউদ্দিন আহম্মদের কাছেও পাঠানো হয়। কিন্তু মেজর নিজামুদ্দীন উক্ত সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও কমাণ্ডিং অফিসারের বিনা অনুমতিতে সেখান থেকে আসতে অস্বীকার করেন।


 ঘোড়াঘাটের সংঘর্ষে যে তিনজন বংগশার্দুল শাহাদৎবরণ করেন তাদের দাফনের জন্য সুবেদার আওয়াল খান (পাঠান)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সাথে ১২ জন প্রহরী দেয়া হয়েছিল। সে তখন মৃতদেহ নিয়ে কারমাইকেল কলেজের (রংপুর) সামনে আসে ও রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে তখন পথিমধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে পাক সেনারা গুলী ছুড়তে শুরু করে। গুলীতে ১১ জন বংগশার্দুল নিহত হয়। আওয়াল খান গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। তাকে ছাত্ররা ধরে পিটিয়ে হত্যা করে।

 খান সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞঃ যাদেরকে (৩৩ জন) সৈয়দপুরের দু’মাইল দূরবর্তী অন্ধকার দালানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছিল তাদের সবাইকে রাত দুটা ৪৫ মিনিটে গুলী করে হত্যা করা হয়। সেখানে আব্দুল কাদের নামক একজন সিপাহী মৃতদেহের স্তুপের মধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের ব্যাটালিয়নের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ সৈন্য বদরগঞ্জের নিকটবর্তী খোলাহাটী নামক জায়গায় একত্রিত হয়।

 আমরা ২/৩ রা এপ্রিল পার্বতীপুর আক্রমণ করি এবং পাক বাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। কিন্তু পার্বতীপুর শহর দখল করতে ব্যর্থ হই।

 ১২ এপ্রিল বদরগঞ্জে পাক বাহিনীর সাথে (১৫ টি ট্রাক বোঝাই) আমাদের সংঘর্ষ হয়। পাক বাহিনীকে পর্যদস্ত করা হয়। আমি এবং সুবেদার শহীদুল্লাহ এই যুদ্ধের কমাণ্ড করেছিলাম।

 ১৩ই এপ্রিল পাক বাহিনী ট্যাংক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। বদরগঞ্জ সংঘর্ষ শুরু হওয়ার প্রায় দু’ঘণ্টা আগে রংপুর থেকে রংপুরের তৎকালীন এস-পি বদরগঞ্জ থানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ২৯ ক্যাভলরির একজন মেজরকে পাঠান ড্রাইভারের বেশে বদরগঞ্জে নিয়ে আসে। এস-পির সাথে কথোপকথনের পর উক্ত ড্রাইভারের পরিচয় জানতে চাওয়ায় তাকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ড্রাইভারের পরিচয় দেয়া হয়। কিন্তু উক্ত মেজর (ড্রাইভার) আমার আগের পরিচিত ছিল। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করায় সে স্বীকার করে। পরে তাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠানো হয় ও হত্যা করা হয়। এস-পিকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।  তারপর আমরা ফুলবাড়িতে এসে ক্যাম্প করলাম। কিন্তু মুসলিম লীগাররা আমাদের অবস্থান পাক বাহিনীর গোচরীভূত করে। সেখানেও তারা ট্যাংক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারপর আমরা চরকাই (হিলির সীমান্তের কাছাকাছি) তে স্থানান্তরিত করি এবং আমাদের কণ্ট্রোল রুমসহ হেডকোয়ার্টার তৎকালীন পাকিস্তানের হিলিতে স্থাপন করি।


 ২২শে এপ্রিল ১৯৭১ পাক বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বর্ডার বেল্টের ভেতরে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকি।


 ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ তারা ভারতের হিলির উপরও আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। ঐ দিন অত্যন্ত ঝড় বৃষ্টি ছিল এবং আমাদের সৈন্যরা তাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে এদিক সেদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।


 ২৫শে এপ্রিল ৩য় বেঙ্গলের শার্দুলগণ পশ্চিম-দিনাজপুরের কামাপাড়া স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরা ৪র্থ এবং ৫ম সেক্টর স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।


সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর
সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার জয়নাল আবেদীন
৫-১১-১৯৭৪

 ২৫শে মার্চ আমি ১০ নং শাখার রংপুর ডবল সুতি বিত্তপিতে হাবিলদার পদে বহাল ছিলাম। ৭ই মার্চের পর পাঞ্জাবী অফিসাররা কদিন পরপর গোপনে মিটিং করত, সেখানে বাঙ্গালীদের ডাকতো না। এইসব দেখে আমাদের ধারণা হয়েছিল একটা কিছু হতে পারে।


 ১০ নং শাখার কমাণ্ডার ছিল একজন ইউপি সহকারী ক্যাপ্টেন ২জন ছিল। (১) ক্যাপ্টেন ভুট্টো খান ছিল (পাঞ্জাবী) এবং অপরজন বাঙ্গালী নওয়াজেশউদিনের ৫টি কোম্পানী ছিল এই শাখাতে। একটি সাপোর্ট প্লাটুনও ছিল। কোম্পানগুলো ছিলঃ চিলমারী, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আবদুল মান্নান, অপরটি বাগভাণ্ডারে যার কমাণ্ডার ছিল বিহারী। মোগলহাটে অপর আরেকেটি কোম্পানী ছিল যার কমাণ্ডার ছিল সুবেদার আরব আলী। পাটগ্রামে একটি কোম্পানী ছিল, কমাণ্ডার ছিল সুবেদার বোরহান উদ্দিন। উইং হেডকোয়ার্টারে কোম্পানী কমাণ্ডার ছিল এতয়ার খান। সাপোর্ট প্লাটুন কমাণ্ডার ছিল নায়েক সুবেদার নূর মোহাম্মদ।


 ২৬শে মার্চ বিকালে ঢাকার পিলখানার হত্যাযজ্ঞের খবর পেলাম। ঠাকুরগাঁওয়ে ৯নং শাখা ছিল। তারা ২৬ শে মার্চ বিদ্রোহ করে। এ খবর আমরা পেলাম।


 ২৭শে মার্চ সেক্টর কমাণ্ডার তারিখ রসুল ১০নং শাখাতে টেলিফোন করেন। সেই টেলিফোন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ধরেন। সেক্টর কমাণ্ডার জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে? নওয়াজেশ বল্লেন ‘আমি ভুট্টো’-এখনই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে হত্যা কর’।


 ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ পাকিস্তানীদের মতলব বুঝে জীপ নিয়ে সীমান্তের দিকে চলে যান। নায়েক সুবেদার নূর মোহম্মদও (সাপোর্ট প্লাটুন কমাণ্ডার) গাড়ী নিয়ে সীমান্তে যায়। গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সকল কোম্পানীকে তিস্তা ব্রিজে ক্লোজ হতে বলেন।


 মোগলহাট কোম্পানী লালমনিরহাট আসলো। পাটগ্রাম কোম্পানী তিস্তা চলে আসে। চিলমারী কোম্পানীর কিছু তিস্তার পারে চলে আসে। আমরা তিস্তার পারে ৪০০/৫০০ জনের মত ইপিআর ডিফেন্স নিই ব্রিজ পর্যন্ত নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। ৩০শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত এখানেই পাকবাহিনীর সাথে প্রায় রোজ যুদ্ধ হয়েছে। পাকবাহিনী ব্রিজ অতিক্রম করে এপারে আসতে পারেনি। ৫ই এপ্রিল পাকবাহিনীর ব্যাপক  আক্রমণে আমরা পিছু হটি। আমরা ফুলবাড়ী থানাতে ডিফেন্স নিই ছোট্ট একটি নদীর পারে। তিস্তা থেকে কুড়িগ্রাম রোড আমরা অবরোধ করে থাকি। ১৩/১৪ এপ্রিল আমরা ৩টি কোম্পানী নিয়ে লালমনিরহাটে আসি পাক ঘাঁটি আক্রমণের জন্য। আমরা ঐ যুদ্ধে টিকতে ব্যর্থ হই। আমাদের ৬/৭ জন শহীদ হন। আমরা আবার ফুলবাড়ী চলে আসি।


 এপ্রিলের ২৫ তারিখে ১০নং শাখার সকল ফোর্স পাটেশ্বরীতে নিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। নাগেশ্বরী থানাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়। এখানে আমরা পাক্কা ডিফেন্স করি। আনসার-মুজাহিদসহ ১২০০ জনের মত ফোস ছিল। ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬শে জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় পাকবাহিনী সাথে খণ্ড যুদ্ধ হয়।


 ২৪শে জুন থেকে পাকবাহিনীর ব্যাপকবাবে চারিদিক থেকে শেলিং ও বিমান হামলা করে। ২৬শে জুন আমাদের সকল ডিফেন্স থেকে মুক্তি বাহিনী পিছু হটতে থাকে এবং পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখানে কিছু শহীদ হন। এখান থেকে সুবেদার বোরহান উদিনের সাথে আমাদের কোম্পানী সোনারহাট সেক্টরে চলে যায়। সুবেদার আরব আলী এবং অন্যান্যরা ভারতের শ্যামগঞ্জ পৌছায়। আমরা সোনারহাটে নদীর পারে ডিফেন্স নিই ৩০শে জুন। আগষ্টের ২২ তারিখ পর্যন্ত এখানে আমরা ডিফেন্স করে থাকি। এই সময়ের মধ্যে সোনারহাট ব্রিজে কয়েকদিন পর পর পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ বাধতো।


সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর
সাক্ষাৎকারঃ মোঃ নুরুজ্জামান
১৫-৭-১৯৭৮

 ২৭শে মার্চ রাত ৮ ঘটিকার দিকে আমরা প্রায় ২০/২৫ জন বাঙ্গালী ইপিআর সমবেত হয়ে পরামর্শ সভা করি। নায়েক সুবেদার নূর মোহম্মদ এই পরামর্শ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবাইকে সাহস দিয়ে বলেন যে, যেহেতু তিনি সবারই সিনিয়র, যেহেতু কোন ক্ষতি হলে আগে তারই হবে। কিন্তু আমি ভিন্নমত পোষণ করি ও জানাই যে, অস্বস্তিকর অবস্থায় আর বসে থাকা সম্ভব নয়। এখন আমরা নিরস্ত্র। যে কোন সময় আমাদের বিপদ হতে পারে। কাজেই হয় ব্যারাক থেকে আমাদের বেরিয়ে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে, নতুবা এখানকার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আমাদের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই পরামর্শ সভায় আমরা সবাই বিপদ বুঝতে পারি, কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি নাই।


 আমরা জানতে পেলাম যে, সাবেক বাঙ্গালী ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব নিখোঁজ হয়েছেন। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পূনরায় পরামর্শ সভা হয়। অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদেরকে আঘাত হানার স্বপক্ষে আমি উক্ত সভায় সোচ্চার হই। আমাদের পরামর্শ সভা যখন চলছিল তখন শহরের সেনাবাহিনীর গ্যারিসনের সৈন্যরা উত্তর দিকের একটি পুলের নিকটবর্তী গৃহস্থ বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করছিল। আমরা আগুন দেখার সাথে সাথে সৈন্যদের মেশিনগানের গুলির শব্দও শুনতে পাই। হঠাৎ দেখতে পাই পাঞ্জাবী সৈন্যদের জীপগুলো আমাদের ব্যারাকের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাইকে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়তে বলা হয়। আমি নিজেও নুরুল হক নামে একজন অসুস্থ বাঙ্গালী ইপিআরকে নিয়ে নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ি। ব্যারাক থেকে উত্তরে প্রায় ৫ মাইল দূরে জনৈক হিন্দু গৃহস্থ বাড়ীতে প্রথমে আশ্রয় নিই।

 ২৮শে মার্চ ভোর বেলা কালীগঞ্জ থানার এম-সি-এ করিম উদ্দিন সাহেবের নিকট উপস্থিত হই। তাঁর সাথে পরামর্শ করে প্রায় ৩০ জন ছাত্রকে জোগাড় করা হয়। সীমান্তবর্তী ভারতীয় ফাঁড়ি থেকে কিংবা ভারতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ আনার জন্য ছাত্রদেরকে পাঠানো হয়। এরপর তাড়াহুড়ো করে স্থানীয় আসসার-মুজাহিদ ও ছাত্রদের সমন্বয়ে প্রায় ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দানের কাজ শুরু করি। এম-সি-এ করিম উদ্দিন সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিনই রংপুর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম, লালমনিরহাট, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, থানার সমস্ত ইপিআর ফাঁড়িগুলোতে সংবাদ পাঠানো হয়। এই সংবাদে সাবেক ইপিআরদেরকে সশস্ত্র অভিযানের জন্য সংগঠিত হয়ে একযোগে রংপুর শহরে অবস্থিত সামরিক গ্যারিসনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল।

 ১লা এপ্রিল সাবেক ইপিআর কোম্পানী প্রধান সুবেদার বোরহান উদ্দীন বাঙ্গালী ইপিআরদেরকে সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধের জন্য কাকিনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ডিফেন্স দেন। এদিকে আমি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী গড়ে তুলি। এই কোম্পানী দুটির কমাণ্ডার ছিলেন যথাক্রমে মুজাহিদ তমিজ উদ্দিন এবং আনসার কমাণ্ডার রিয়াজ উদ্দিন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন পরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন তার কোম্পানীসহ সুবেদার বোরহানের কোম্পানীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কমাণ্ডার রিয়াজউদ্দিনকে তার কোম্পানীসহ গঙ্গাচড়া ও কালীগঞ্জ থানার তিস্তা নদীর তিনটি ঘাট পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল।

 ৮ই এপ্রিল রাত ১টার দিকে সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানী লালমনিরহাট থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের পরপরই সুবেদার বোরহান তার কোম্পানীকে সরিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের দিকে নিয়ে যান।

 ৯ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা কালী বাজারের কাছাকাছি এসে পড়লে আমরা সবাই সরে পড়ি। ১৪ই এপ্রিল ফুলবাড়ী থানায় উপস্থিত হই। এই ফুলবাড়ী থানাতেই সাবেক ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে ঐসময় দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না তিনি আমাকে ভারত সীমান্তবর্তী থানা ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে যান। আমি নওয়াজেশ সাহেবের সহকারী হিসাবে কার্যভার গ্রহন করি। প্রকৃতপক্ষে ভুরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পুরো সেক্টরে পরিণত হয়েছিল। রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে থেকে সাবেক ইপিআর মুজাহিদ-আনসার এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রবৃন্দ দলে দলে ভুরুঙ্গামারী থানায় আসতে থাকে। আমরা তাদেরকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানী গঠন করি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভুরুঙ্গামারী থানা সদরেই দেয়া শুরু হয়। সুবেদার বোরহান পাঁচগাছি থেকে কাউয়াহাগা পর্যন্ত ধরলা নদীর বিস্তৃত নদী তীর এলাকা জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানী মোতায়েন করেন। অপরদিকে সাবেক ইপিআর সুবেদার আরব আলী কাউয়াহাগা থেকে গোরল মঞ্জিল পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে দুটি কোম্পানী মোতায়েন করেন।

 কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরে পাকিস্তানী সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করার পর ভুরুঙ্গামারী থানার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠানো হয়। তারা অধিকৃত কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী উলিপুরে সাফল্যের সাথে গেরিলা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

 নবগঠিত বাংলাদেশ বাহিনীর সি-ইন-সি কর্নেল ওসমানী ২৪শে মে ভুরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে আসেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য এবং কুড়িগ্রাম শহরের সাথেই প্রবাহিত ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ আমাদের প্রতিরোধ ঘাঁটি মজবুত করার জন্য পর্যন্ত ও ভারী অস্ত্র প্রদানের আহবান আমরা জানাই। এর ফলে আমরা ভারত থেকে দুটি এসএমজি ও দুটি ৮১ এম-এম মর্টার পাই। এই অস্ত্র দুটো ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ পাটেশ্বর ডিফেন্স ও কাউয়াহাগা ডিফেন্স ব্যবহার করা হয়। হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে এই অস্ত্র খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত উক্ত এসএমজি দুটো ফেরত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে এসএমজি দুটো তাড়াহুড়ো করে ফেরত দেয়া হয়।

 এদিকে ২৬শে মে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারী কামানের সাহায্যে পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা তিস্তা নদীর তীর থেকে শেল বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধরা ভারী অস্ত্রের অভাবে বাংকার থেকে উঠে ভূরঙ্গামারীর দিকে ফিরে আসতে থাকে। মূলতঃ ঐ দিনই পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়।

  1. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন।