বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/জীবসেবা ও বিশ্বপ্রেম

উইকিসংকলন থেকে
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ॥ জীবসেবা ও বিশ্বপ্রেম

 প্রেমের প্রতাপ মনুষ্যপ্রকৃতির সর্ব্বত্রই সমান দুর্দ্ধষ। প্রেমের সঞ্চার হইবামাত্র মনোভাব প্রশস্ত হয়। অশান্ত প্রকৃতিও মদভাব ধারণ করে এবং হীনমনা কাপুরুষও সাহসিকতা প্রাপ্ত হয়। অতি নীচ জঘন্য হৃদয়মধ্যেও শৌর্য্যাদি বীরগুণের এত প্রভূত সমাবেশ হইয়া থাকে যে, তদ্বারা প্রিয়জনের হিতসাধন ও সুখবিধানের আশা জন্মিলে সে সমস্ত জগৎকে তুচ্ছ করিয়া চলিতেও ভীত হয় না। প্রেমের প্রভাবে মানব যেন সম্যক্ রূপান্তরিত হইয়া অভিনব জীবন লাভ করে। তাহার ইন্দ্রিয়গণের নতুন শক্তির বিকাশ হয়। হৃদয়মধ্যে নবীন বাসনা প্রবলতর বেগে উদিত হয়; এবং ধর্ম্মের পবিত্র ভাব আসিয়া প্রবেশ করে। সে তখন কোন পরিবার বা সমাজের অন্তর্গত থাকে না। তখন তাহার স্বকীয় সত্ত্ববত্তা স্বতন্ত্র হইয়া দাঁড়ায়। বিশিষ্ট গুণসমূহের প্রতিকৃতিস্বরূপ সে তখন জগতের সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়। এবং আত্মার সতেজকণ্ঠই সত্যের ধ্রুবস্বর মনে করিয়া পথিবীর জীবসমূহের কল্যাণসাধনে আত্মসমর্পণ করে। এইখানেই বিশ্বপ্রেমের পরিচয়। এবং এইরপে জীবসমূহের কল্যাণসাধনের নামই সেবাধর্ম্ম।

 চৈতন্যদেব সনাতন প্রভুকে শিক্ষা দিয়াছিলেন:—

“জীবে দয়া নামে রুচি সাধুর সেবন।
এই তিন ধর্ম্ম ভিন্ন নাহি সনাতন॥”

 উপনিষৎকারও কহিয়াছেন:—

“এতৎ এয়ং শিক্ষেৎ দমং দানং দয়ামিতি।”

দম, দান ও দয়া এই তিন যত্নতঃ শিক্ষা করিবে। চৈতন্যপ্রভু যাহা শিক্ষা দিয়াছেন, তাহাই উপনিষৎকারেরও অনুশাসন। ফলতঃ জীবে দয়া, নামে রুচি ও সাধুসেবা বিশ্বপ্রেমেরই উপাদান।

 মনুষ্যের নিজ আত্মার সমান প্রিয় বস্তু সংসারে আর দ্বিতীয় নাই। স্ত্রী, পত্র, ধন, বন্ধু প্রভৃতি সমুদয়ই আত্মার প্রীতির জন্য। সুতরাং ‘আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু’ মানবের যখন এই জ্ঞান হয়, তখন মানব সর্ব্বভূতের কল্যাণ, আত্মকল্যাণ বলিয়া মনে করে এবং সর্ব্বভূতের সুখসাধন করিয়া আত্মসখ লাভ করে। এই অবস্থায় মানবহৃদয়ে সেবাধর্র্ম্ম জাগিয়া উঠে। পাঠকগণ, পূর্ব্ববর্ত্তী অধ্যায়সমুহে ভগবতী দেবীর সেবাধর্ম ও বিশ্বপ্রেমের অভাস প্রাপ্ত হইয়াছেন। এস্থলে আপনাদিগের অবগতির জন্য আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিলাম।

 গ্রীবকাশের পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র নারায়ণচন্দ্র কলিকাতায় অসিবার সময় বাটীর কোন অভিভাবককে সঙ্গে না লইয়া একাকী কখনই আসিতেন না। তিনি সচরাচর পিতামহ ঠাকুরদাসের সহিত আসিতেন। কখন কখন পিতামহীর সহিত অসিতেন, একবার পিতামহী ভগবতী দেবীর সহিত তিনি কলিকাতার আসিতেছিলেন। তৎকালে বীরসিংহ হইতে কলিকাতায় আসিবার পথ সুগম ছিল না। পিতামহীর সহিত আসিবার সময়ে তাহার কোন গ্রামের নিকটবর্ত্তী হইয়া শুনিলেন যে জনৈক গহস্থের গৃহ হইতে হৃদয়বিদারক ক্রন্দনধ্বনি উথিত হইতেছে। ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া দয়া ও করুণার মূর্ত্তিমতী প্রতিকৃতি ভগবতী দেবী পৌত্র নারায়ণচন্দ্রকে বলিলেন, “দাঁড়াত; এ বাড়ীতে কেন কাঁদিতেছে একবার শুনিয়া আসি।” এই কথা বলিয়া ভগবতী দেবী বালক নারায়ণচন্দ্রকে তথায় সাবধানে থাকিতে বলিয়া সেই গহস্থের বাটীতে প্রবেশ করিলেন। বালক নারায়ণচন্দ্র কিয়ৎক্ষণ তাঁহার অপেক্ষায় সেই পথের ধারে বসিয়া রহিলেন। পিতামহীর বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া কারণ জানিবার জন্য গৃহস্থের বাটীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, পিতামহী সেই অপরিচিত গৃহস্থের ক্রন্দনে যোগ দিয়াছেন। পৌত্র নারায়ণচন্দ্রকে যে দাঁড়াইয়া থাকিতে বলিয়া আসিয়াছেন, তাহাদের সহিত কাঁদিতে বসিয়া সে কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। ধন্য বিশ্বপ্রেম! তুমিই মানুষকে আত্মহারা করিয়া পরসেবায় নিয়োজিত করিতে পার! তোমার অসীম প্রভাব!

 এই প্রকার অপরিমেয় সেবাগুণেই তিনি বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের আপামর সাধারণকে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি পরের বিপদকে আপনারই বিপদ বলিয়া মনে করিতেন। কেহ বিপদাপন্ন হইয়াছে, ইহা তাঁহার শ্রুতিগোচর হইবামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ সেইখানে উপস্থিত হইতেন এবং তাহার বিপন্মোচনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। রোগার্ত্তের পাশে উপবেশন করিয়া তিনি জননীর ন্যায় তাহার শুশ্রষা করিতেন। রোগীর মলমূত্র তিনি চন্দনবৎ জ্ঞান করিতেন। তিনি স্বহস্তে তাহা মুক্ত করিতেন, তাঁহার মনে কিছুমাত্র ঘৃণার উদ্রেক হইত না। রুগ্নের শুশ্রুষায় তাঁহার আত্মপর বা ইতরভদ্র ভেদ ছিল না। হাড়ি, ডোম, তেওর, বাগ্দী প্রভৃতি কিছুই বিচার ছিল না। কেহ পীড়িত হইয়াছে কর্ণগোচর হইলেই তাহার শয্যাপার্শ্বে তিনি সমাসীন হইতেন। তিনি কাহারও ঔষধের ব্যবস্থা করিতেছেন,কাহারও পথ্য রধন করিয়া দিতেছেন, কাহারও বা অন্যবিধ শুশ্রুষা করিতেছেন, এইরূপে রুগ্নের পার্শ্বে তিনি মাতৃমূর্ত্তিতে বিরাজমান থাকিয়া সতত তাহাদিগকে অভয় প্রদান করিতেন। কোন বালিকা বিধবা হইয়াছে বা কাহারও পুত্রবিয়োগ ঘটিয়াছে শ্রবণমাত্রই তিনি সেই শোকার্ত্ত পরিবারের মধ্যে উপস্থিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে থাকিতেন। মধ্যে মধ্যে তিনি শোকে এতদূর অধীর হইয়া পড়িতেন যে, ধূলায় অবলুণ্ঠিত হইতে থাকিতেন। একসময় কোন প্রতিবেশীর একমাত্র পুত্র কঠিন পীড়াগ্রস্ত হয়। ভগবতী দেবী আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সেই বালকের শুশ্রূষায় দিবারাত্রি অতিবাহিত করিতেন। এইরূপে একাদিক্রমে তিনি ১০।১২ দিন রাত্রি জাগরণ করিয়ছিলেন ইহাতে কিছুমাত্র তাহার ক্লেশানুভব হয় নাই। পরিশেষে তাঁহার ক্রোড়েই সেই বালকের মত্যু হয়। তখন তিনি পুত্রশোকাতুরা মাতার ন্যায় সেই মৃতদেহ বক্ষে ধারণ করিয়া উম্মত্তের ন্যায় যেরূপ করুণ বিলাপ করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিলে পাষাণ হৃদয়ও বিদীর্ণ হইয়া যায়। পুত্রশোকাতুরা জননীর নিকট হইতে সন্তানের মৃতদেহ গ্রহণ করা যেরুপ দুরূহ ব্যাপার, তাঁহার নিকট হইতে সেই বালকের মৃতদেহ গ্রহণ করা ততোধিক দুরূহ ব্যাপার হইয়াছিল। এরূপ দ্রবীণহৃদয়,—এরূপ সমবেদনা,—এরুপ লোকসেবা—প্রকৃতপক্ষেই ইহজগতে এক বিচিত্র ব্যাপার। জীবসেবাই যেন তিনি শিবসেবা মনে করিতেন। লোকসেবায় তাঁহার ভগবৎসেবায়ই যেন প্রতীতি জন্মিত। ধন্য ভগবতী দেবী। তোমার সমস্তই বিচিত্র লীলা!

 পথিপার্শ্বে কোন জীবজন্তুর মতদেহ দেখিলে, অশ্রুধারায় ভগবতী দেবীর বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইত। গৃহপালিত কোন জীবজন্তু যন্ত্রণায় কাতর হইয়া পড়িয়াছে দেখিতে পাইলেই তিনি তাহার শুশ্রূষায় নিরত হইতেন। তিনি যখন শেষবার কাশীযাত্রা করেন, তথায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা পীড়িত হইয়াছেন এবং তাঁহার শুশ্রূষার কেহ নাই শ্রবণমাত্র ভগবতী দেবী তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সেবায় ব্যাপৃত হইলেন। তিনি স্বহস্তে ঐ বৃদ্ধার মলমূত্র পরিষ্কার করিতেছেন দেখিয়া বৃদ্ধা লজ্জিত হইতেছেন বুঝিতে পারিয়া ভগবতী দেবী বলিলেন, “আপনি লজ্জিত হইতেছেন কেন? আপনি আতুর, আপনার সেবা আর স্বয়ং অন্নপূর্ণার সেবায় প্রভেদ কি? ইহা ত মলমূত্র নহে, ইহা চন্দন! আমার মনে বিন্দুমাত্র ঘৃণার উদ্রেক হয় নাই।” বৃদ্ধা ভগবতী দেবীর এই কথা শ্রবণ করিয়া তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্তলের আশীর্ব্বাদ তাঁহাকে জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। পরে বৃদ্ধা সুস্থ হইলে, ভগবতী দেবী বিদ্যাসাগরকে বলিয়া তাঁহার ও অপর আরও দুই একটি বৃদ্ধার মাসহারার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন।

 বধূ ও কন্যাগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে, ভগবতী দেবী অধিকাংশ সময় লোকসেবায় অতিবাহিত করিতেন। তিনি দিবাভাগের সন্ধ্যা বন্দনাদি সমাপন ও কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া প্রতিদিন বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী পল্লীসমুহের গৃহে গৃহে ভ্রমণ করিতেন। কাহারও মুখ বিষন্ন দেখিলে, তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইত। অপাঙ্গ ভেদ করিয়া অশ্রুধারা নিপতিত হইত। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “তোমার মুখ শুষ্ক কেন? তোমার কি খাওয়া হয় নাই? তোমার কি অর্থকষ্ট হইয়াছে?” এইরপে তিনি গৃহে গৃহে সকলের অভাব জানিয়া তাহার প্রতিবিধান করিতেন। ইহাই তাঁহার নিত্য নৈমিত্তিক কার্য্য ছিল।

 ভগবতী দেবী শেষবার যখন কাশীধামে গমন করেন, তখন তাঁহার মাসাধিক তথায় অধিস্থতি করিবার ব্যবস্থা হয়। এই কথা শ্রবণ করিয়া বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ শোকাকুল হইয়াছিলেন। তিনি দুঃস্থ লোকদিগের মাসাধিকের জন্য সমস্ত দ্রব্যের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি যখন কাশীধামে যাত্রা করিলেন, তখন আবাল বৃদ্ধ বনিতা এমন কি গৃহস্থের কুলবধুগণ পর্যন্তও কিরুপ ব্যাকুলভাবে ক্রন্দন করিতে করিতে বীরসিংহের উপকণ্ঠস্থিত প্রান্তর পর্য্যন্ত তাঁহার অনুসরণ করিয়াছিলেন, সে দৃশ্য যিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, তিনিই উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন যে, বিশ্বপ্রেমের প্রতিদান এই বিশ্বেই রহিয়াছে! যিনি জগতের জন্য ক্রন্দন করেন, জগৎও তাঁহার জন্য ক্রন্দন করে! তাঁহার বিচ্ছেদ সহ্য করিতে পারে না!

 সত্য সত্যই ভগবতী মা আনন্দময়ীরূপে বীরসিংহে বিরাজমান ছিলেন। লোকের মুখে শষ্ক দেখিলে, তাঁহার হৃদয় বিগলিত হইত। নিরানন্দের ছায়া বিশ্ব হইতে বিলপ্ত হউক! বিশ্ব আনন্দে ভাসমান হউক!-বিশ্ব হাস্যে উদ্ভাসিত হউক!—এ আকাঙ্ক্ষা বিশ্বমাতার হৃদয়েই সম্ভবে! ধন্য ভগবতী দেবী! ধন্য তোমার বিশ্বপ্রেম!-ধন্য তোমার জীবসেবা।