বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/চরিত্রমাহাত্ম্য

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ॥ চরিমাহাত্ম্য

 চরিত্রই মানব জীবনের মুকুটস্বরূপ। বিদ্যাবল ও ধনবল অপেক্ষা চরিত্রবলই শ্রেষ্ঠ। চরিত্রবান ব্যক্তি নীচকুলোদ্ভব হইলেও চরিত্রগুণে উচ্চকুলমর্য্যাদা লাভ করিয়া থাকেন। তিনি সম্পদবিহীন হইলেও লোকানুরাগরূপ অপার্থিব সম্পত্তি লাভ তাঁহারই ভাগ্যে ঘটে। ধন, মান অপেক্ষা চরিত্রের প্রাধান্যই অধিক।

 লোকের প্রবৃত্তি, সংসর্গ ও ব্যবহার আলোচনা করিলে তাহার চরিত্র নিণীত হয়। কোন্ ব্যক্তির চরিত্র কিরূপ, তাহা জানিতে হইলে তাহার কার্য্যকলাপের অনুসন্ধান প্রয়োজন। জনসমাজে উন্নতি লাভের যত উপায় আছে, বা থাকিতে পারে, চরিত্রবলই তন্মধ্যে প্রধান।

 জ্ঞানই বল, ইহা চিরন্তন সত্য। কিন্তু জ্ঞানবল অপেক্ষা চরিত্রবলই শ্রেষ্ঠ। যাহার হৃদয় আছে, অথচ সহৃদয়তা নাই; প্রতিভা আছে, সরলতা নাই; কার্য্যনৈপুণ্য আছে অথচ সাধুতা নাই; তাহার ঈদৃশ হৃদয়, প্রতিভা ও কার্য্যনিপুণতা দ্বারা জনসমাজের কি ইষ্ট সাধিত হইতে পারে? যাঁহার চিত্তে সরলতা, ধর্ম্মে অনুরাগ, গুরুজনে ভক্তি, আচরণে বিনয়, পরনিন্দায় বিরক্তি, পরোপকারে প্রবৃত্তি, মিথ্যাচরণে অশ্রদ্ধা, সর্ব্বজনে সমভাব আছে, তিনিই সচ্চরিত্র। সচ্চরিত্রের প্রতি অনুরাগ ও অসচ্চরিত্রের প্রতি বিরাগ আমাদের স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম্ম।

 চরিত্রের পবিত্রতার রক্ষা করা মানবের অবশ্যকর্তব্য কর্ম্ম। সাধুজন-প্রশংসনীয় কার্য্যকে কর্ত্তব্যকর্ম্ম কহে। কর্ত্তব্যপালনেই চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষিত হয়। কর্তব্যপালন করিতে হইলে, আত্মসংযমের প্রয়োজন, আত্মসংযম না থাকিলে লোক উচ্ছৃঙ্খল হইয়া থাকে; সুতরাং চরিত্রবান্ হইতে হইলে আত্মসংযম অভ্যাস করা উচিত। সত্যে অনুরাগ, ন্যায়পরতা ও অধ্যবসায় থাকিলে আত্মসংযম অভ্যস্ত হয়। অতএব চরিত্রগঠন করিতে হইলে সত্যের প্রতি অনুরাগের প্রয়োজন। সত্যে অনুরাগ থাকিলে, মনে কপটতা থাকিতে পারে না, মনে কপটতা না থাকিলে দুষ্কার্য্যেও প্রবৃত্তি হয় না।

 সচ্চরিত্রের মহত্ত্ব সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। লোকে সদ‍্গুণের সমাদর করে, কিন্তু সাধুচরিত্রের পুজা করিয়া থাকে। চরিত্রবান্ ব্যক্তি যে কার্যেই প্রবৃত্ত হউন, তাহাতেই উন্নতিলাভ করিতে পারেন। সকলেই তাঁহার প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান প্রদর্শন করিয়া থাকেন। যিনি প্রকৃত সুখে সুখী হইতে বাসনা করেন, তাঁহার চরিত্রের নির্ম্মলতা রক্ষা করা আবশ্যক। কারণ, চরিত্রবান্ ব্যক্তিই আত্মপ্রসাদ লাভে সমর্থ হন। তাঁহার চিত্তে প্রীতি, সুখ ও শান্তি সদা বিরাজমান থাকে।

 ভগবতী দেবীর বিবিধ সদ‍্গুণের কথা আমরা পুর্ব্বই উল্লেখ করিয়াছি। এবং ঐ সকল সদ‍্গুণের সমষ্টিই তাঁহার চরিত্র। কিন্তু তাঁহার সদ‍্গুণাবলীর মধ্যে এক একটি বিশেষ লক্ষণ আছে। সেইজন্য আমরা ‘চরিত্র মাহাত্ম্য’ নামে এই অধ্যায়ের অবতারণা করিলাম।

 ভগবতী দেবী দয়ার মূর্ত্তিমতী প্রতিকৃতি ছিলেন। তাঁহার এই দয়া ও পরোপকার প্রবৃত্তিই তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিয়াছে। তাঁহার এই দুই প্রবৃত্তি সাধারণ মানবের ঐ দুই প্রবৃত্তি অপেক্ষা অনেক উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার এই দয়া ও পরোপকার প্রবৃত্তি বৈরাগ্যসম্ভূত নহে! সংসারে এরূপ নরনারীর অভাব নাই, যাঁহারা অতুল ঐশ্বর্য্য ও বিপুল বিভবের অধীশ্বর বা অধীশ্বরী। কিন্তু শমনের শাসনদণ্ডের কঠোর আঘাতে একে একে তাঁহাদের সংসারে সমস্ত বন্ধনই ছিন্ন হইয়াছে। অতুল বিভব সম্ভোগের কেহই নাই। এরপ অবস্থায় অতুল ঐশ্বর্য্য ও বিপুল বিভব তাঁহাদের হৃদয়ের শান্তি স্থাপন করিতে অসমর্থ। তখন তাঁহারা পারত্রিক মঙ্গলসাধনের জন্য মুক্তহস্তে বিপুল অর্থদান করিয়া অন্যের দুঃখমোচনে প্রবত্ত হন। তাঁহাদের এরূপ দয়া ও পরোপকার প্রবৃত্তি প্রশংসার যোগ্য হইলেও উহা বৈরাগ্যসম্ভুত। কিন্তু ভগবতী দেবীর সংসারবন্ধন পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্র, দৌহিত্রী প্রভৃতি লইয়া তাঁহার বৃহৎ পরিবার, অনেক আত্মীয় স্বজন। ইহা সত্ত্বেও তিনি বসুধাবাসীজনগণকে আত্মীয় বলিয়া ভাবিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার বিশ্বব্যাপী বিশাল হৃদয়ে সকলকে স্থান দিয়াছিলেন—ইহাই তাহার দয়া গণের বিশেষত্ব। তাঁহার দয়ারূপ মন্দাকিনীর স্বাদুধারা, একপ্রাণতা, সমদর্শিতা ও শ্রদ্ধারূপ ত্রিধারার সম্মিলনে সৃষ্ট হইয়াছিল। ইহাও তাঁহার দয়াগুণের আর এক বিশেষত্ব। বিপন্ন ব্যক্তিকে দেখিবামাত্রই তাঁহার হৃদয় বিচলিত হইত। অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে করিতে তাহার বিপন্মোচনের জন্য তিনি যত্নবতী হইতেন। তাঁহার এই দয়া প্রবৃত্তির মূলে সহানুভূতি বিদ্যমান ছিল। অপরের দুঃখকে স্বকীয় দুঃখ বলিয়া অনুভব করিয়া, একপ্রাণ হইয়া, তিনি তাঁহার দয়াপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতেন। তাঁহার, দয়া কখনও স্বার্থের পূতিগন্ধে বা পক্ষপাতদোষে অপবিত্র বা কলঙ্কিত হয় নাই। কিংবা দানে অহঙ্কার প্রকাশে তাঁহার আদৌ প্রবৃত্তি ছিল না। তিনি পরের উপকারের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং পরের উপকার করিয়াই জীবৎকাল পর্য্যবসিত করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম্য বিলাসিতার সহিত পরার্থ পরতার বিষম দ্বন্দ্ব। তিনি বিলাসিতারূপ ব্যাধিকে পরিবার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিতে দেন নাই। এবং বিলাসিতার স্থলে মিতাচারের প্রয়োগ দ্বারা পরার্থ পরতা সাধন করিয়াছিলেন।

 তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম তিনি তাঁহার পূর্ব্বাপর অবস্থা স্মতিপথে জাগরূক রাখিতে পারিয়াছিলেন। তিনি বালিকা বধূ বেশেই শ্বশুর গহে আগমন করিয়াছিলেন এবং দরিদ্র সংসারেই প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সেই দরিদ্র অবস্থা তিনি চিরজীবন স্মৃতিপটে অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উন্নতির সহিত ভাগ্যের যথেষ্ট পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের পরাকাষ্ঠার সময়েও তাঁহার মানসিক অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটে নাই। তিনি দীনভাবে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং দীনভাবেই ইহসংসার পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম্য-জীবনের দুর্দ্দিনে যাহা তাঁহার নিত্যসহচর ছিল, সুদিনেও তিনি তাহার নিত্য পূজা করিয়াছিলেন। চরকায় সূতা কাটিয়া সেই সূতা বিক্রয় দ্বারা তাঁহার শ্বশ্রূদেবী অতিকষ্টে সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন। আমরণ ভগবতী দেবী সেই চরকার নিত্যপূজা করিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যখন একাদশ বৃহস্পতির অবস্থা, তখন পর্যন্তও রাত্রি দেড় ঘটিকার পর প্রায় দুই ঘণ্টা একাকিনী বসিয়া ভগবতী দেবী নিত্য চরকায় সূতা কাটিতেন। তাহাতে তিনি কিছু মাত্র অপমান বোধ করিতেন না। হারিসন্ সাহেব যখন বীরসিংহের বাটীতে আগমন করেন, তখন ঐ চরকা দেখিয়া সাহেব শম্ভুবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “এটা কি?” শম্ভুবাবু; তাহার কোন সদুত্তর না দিয়া বিষয়ান্তরে সাহেবের চিত্ত আকৃষ্ট করিয়াছিলেন। পরিশেষে সাহেব প্রস্থান করিলে, শম্ভবাবু ক্রোধপরবশ হইয়া সেই চরকা ভাঙ্গিয়া ফেলেন। ভগবতী দেবী তাঁহার এই ব্যবহারে এতদূর দুঃখিত হইয়াছিলেন যে, তিনি একদিন অন্নজল পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। পরিশেষে শম্ভবাবু চরকা নির্মাণ করিয়া দিলে, তিনি অন্নজল গ্রহণ করিয়াছিলেন। আমরা মহাত্মা রামদনলাল সরকারের চরিত্রেও এইরপে মাহাত্ম্য দেখিতে পাই। রামদোল হাটখোলা দত্তবাটীর সরকার ছিলেন। পরিশেষে তাঁহার সাধুতার পুরস্কার স্বরূপ মদনমোহন দত্ত তাহাকে লক্ষ টাকা প্রদান করেন। যখন রামদুলাল অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি তখনও তিনি দত্তগৃহে মাসিক বেতন দশ টাকা স্বয়ং আনিতে যাইতেন। এবং মদনমোহন দত্তের সম্মুখে যাইবার সময় পাদুকা পরিত্যাগ করিয়া করযোড়ে তাঁহার সম্মখে দণ্ডায়মান থাকিতেন।

 অহঙ্কার ভগবতী দেবীর হৃদয় স্পশ করিতে পারে নাই। ধনমদে তাঁহাকে গর্ব্বিত করিতে পারে নাই। দয়া তাঁহার প্রকৃতিসিদ্ধ ধর্ম ছিল। অনুগত-প্রতিপালন ও আশ্রিতবাৎসল্য, তাঁহার স্বভাবকে মধুময় করিয়াছিল।

 তাঁহার চরিত্রের আর এক মাহাত্ম্য, তাঁহার প্রফুল্লচিত্ততা। ফলতঃ প্রফুল্লচিত্ততা সূর্য্যালোকস্বরপ। এই আলোক দ্বারা চিত্তক্ষেত্র উদ্দীপ্ত হইলে, আমরা মানব জীবন যেরূপ সার্থকতার সহিত উপভোগ করিতে পারি, এমন অন্য কিছুর সাহায্যে পারি না। প্রফুল্পচিত্ত ব্যক্তির নিকটে জগতের সামান্য পদার্থও সুন্দর ও সুখকর। যিনি সতত প্রফুল্লচিত্ত থাকেন, তিনি যেমন উৎসাহের সহিত জীবনের কার্যসমূহ সম্পাদন করিতে পারেন, সদা-বিরক্ত কর্কশভাব ব্যক্তি তেমন পারেন। প্রফুল্লচিত্ত ব্যক্তি যেমন স্বয়ং সর্ব্বদা সুখী থাকেন, অন্যকেও সেইরূপ সতত সুখী করেন। অন্য ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিলেই সুখবোধ করে।

 এই অমূল্য প্রফুল্লচিত্ততা লাভ করিবার জন্য ধর্ম্মই প্রকৃষ্ট উপায়। পৃথিবীতে প্রকৃত ধার্ম্মিক ব্যক্তিই প্রফুল্লচিত্ত হইতে পারেন। প্রফুল্লচিত্ততা জীবনের পবিত্রতা ও ঈশ্বরে অটল বিশ্বাসের ফল। যিনি রিপুসকলকে বশীভূত করিয়া শান্তচিত্ত হইয়াছেন, যিনি পাপাচরণ না করিয়া শুদ্ধমনা হইয়া জীবনের কর্ত্তব্য পালন করেন, যাঁহাকে কোনরুপ কৃতকার্য্যের জন্য অনুতাপ বা ভয় করিতে হয় না, এবং যিনি ঈশ্বরের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছেন, সেই সাধুহৃদয়েই সর্ব্বদা প্রফুল্লতার হিল্লোল প্রবাহিত হইতে থাকে।