বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধ সাধকের আদর্শ

উইকিসংকলন থেকে
বৌদ্ধ সাধকের আদর্শ

 জীবের অপরিহার্য্য দুঃখ মহাপুরুষ বুদ্ধের চিত্ত করুণায় দ্রব করিয়াছিল। তিনি যে আষ্টাঙ্গিক সাধনমার্গ আবিষ্কার করিয়াছেন সেই সাধন প্রণালী দুঃখ নিবৃত্তিরই সাধনা। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া প্রজ্ঞাদৃষ্টিদ্বারা শোকশল্যের সংস্থান অবগত হইয়াই তিনি সর্ব্বজীবের হিতার্থ এই পথ নির্দেশ করিয়াছেন।

 নির্ব্বাণলাভের জন্য যাঁহাদের চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে সেই সকল ধর্ম্মপ্রাণ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনশ্রেণীর সাধক দৃষ্ট হইয়া থকে। ইহাদের একদল তথাগতের বাণী শিরোধার্য্য করিয়া তাঁহারই নির্দ্ধারিত পথে বিহরণ করেন। দুঃখের অস্তিত্ব, উদ্ভব, নিবৃত্তি এবং নিবৃত্তির উপায় এই চতুরার্য্য সত্য সম্যক্ উপলদ্ধি করিয়া নির্ব্বাণ লাভই তাঁহাদের একমাত্র লক্ষ্য। ইহার “শ্রাবক” নামে অভিহিত হইয়া থাকেন।

 দ্বিতীয় শ্রেণীর সাধকগণও বিশুদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা শান্তিপদ নির্ব্বাণ লাভের নিমিত্ত তথাগতের প্রদর্শিত পন্থা অবলম্বন করেন। জন্মহেতু জীবকুল জরাব্যাধি ও মৃত্যুর যাতনা ভোগ করিতেছে,

এইজন্য অবিদ্যা হইতে কার্য্য কারণ পরম্পরায় কিরূপে জীবের উদ্ভব হইল ইহারা প্রজ্ঞাদ্বারা তাহারই উপলব্ধি করিয়া নির্ব্বাণ লাভ করিয়া থাকেন। ইহারা “প্রত্যেক বুদ্ধ” নামে আখ্যাত হইয়া থাকেন।

 অপর শ্রেণীর সাধকগণ “বুদ্ধত্ব” ও “সর্ব্বজ্ঞত্ব” লাভের জন্য পূর্ব্বপূর্ব্ব বুদ্ধদের ন্যায় নির্ব্বাণসাধনায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। বিশ্বপ্লাবিনী করুণার প্রেরণায় ইহারা বিশ্ববাসী দেবমানবের সুখকল্যাণ কামনায় নির্ব্বাণসাধনা করিয়া থাকেন। ইহারা “বোধিসত্ত্ব-মহাসত্ত্ব” আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।

 উল্লিখিত তিন শ্রেণীর সাধকই নির্ব্বাণ সাধনায় নিরত হইলেও শ্রাবক ও প্রত্যেক বুদ্ধদের সাধনার সহিত বোধিসত্ত্বদের সাধনার আকাশ পাতাল প্রভেদ লক্ষিত হইয়া থাকে। বোধিসত্ত্ব কখনো সংসারের কলকোলাহল হইতে দূরে নিভৃত শৈলগুহায় প্রবেশ করিয়া দেহের নশ্বরতাধ্যান করেন না, আপনার সুখ ও আপনার কল্যাণের জন্য তিনি বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠিত নহেন; অবিমিশ্র শান্তির লোভে তিনি নির্জ্জনতার সন্ধান না করিয়া, সর্ব্বজীবের নির্ব্বাণসাধনার নিমিত্ত সংসারের কোলাহলের মধ্যেই প্রবেশ করেন। যাহারা অবিদ্যার বশে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিয়া দুঃখ ভোগ করিতেছে, তিনি তাঁহার সমগ্র শক্তি তাহাদের হিতার্থে উৎসর্গ করেন, তাহাদের নিকটে নির্ব্বাণের অমৃতময়ী বাণী প্রচার করিয়া থাকেন।

 আপনার হিতার্থে আপনার দুঃখ নিবৃত্তির নিমিত্ত শ্রাবক ও প্রত্যেক বুদ্ধগণ কঠিন সাধনায় প্রবৃত্ত হন। তাঁহাদের সাধনা প্রেমমূলক নহে, অনন্ত জীবের অশেষ দুঃখ তাঁহাদের চিন্তার বিষয়ীভূত হইতে পারে না, সুতরাং তাঁহারা বাসনার উচ্ছেদ সাধন করিয়া নির্ব্বাণ লাভ করিয়া থাকেন। এই নির্ব্বাণ, বাসনার নির্ব্বাণ মাত্র, প্রেম করুণা ও দাক্ষিণ্যের চরম অভিব্যক্তি নহে। কারণ ইহারা সাধনার শেষে যে সার্থকতা লাভ করিলেন সমদুঃখী মানব তদ্দ্বারা বিশেষ উপকৃত হইল না; সিদ্ধি লাভের পরে তাঁহারা পাপভারাক্রান্ত সাধারণ নরনারীর সহিত মিশিতেও সংকোচ বোধ করিয়া থাকেন। তাঁহাদের ধারণা এই যে, সর্ব্বজীবের নির্ব্বাণ সাধনা তাঁহাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও শক্তির অতীত।

 কিন্তু বোধিসত্ত্ব আপনাকে বুদ্ধেরই স্থলাভিষিক্ত বলিয়া অনুভব করেন, তিনি একাকী সংসার সমুদ্র অতিক্রম করিয়া সুখী নহেন; তিনি বলেন—“আমি বুদ্ধত্ব ও সর্ব্বজ্ঞত্ব লাভ করিয়া স্বয়ং যেমন সংসার সমুদ্র পার হইব, তেমনি সমস্ত দেবমানবকে পরপারে বহন করিয়া লইবার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করিব। যখন দেখিতেছি, আমার প্রতিবেশী আমারই ন্যায় দুঃসহ দুঃখের বোঝা বহন করিতেছে তখন আমি কেবল মাত্র আপনারই দুঃখ দূর করিবার জন্য ব্যস্ত হইব কেমন করিয়া?” এই নিমিত্ত তিনি সকল জীবের দুঃখের ভার আপনার শিরে গ্রহণ করিয়া অসাধ্য সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন।

 এই অসমসাহসিক সাধক কোন্‌ ভাবনার দ্বারা প্রণোদিত হইয়া এই সাধনসমরে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন? তিনি ভাবেন— অবিদ্যার বশে জীবকুল অহোরাত্র পাপাচরণে নিরত রহিয়াছে এবং তাহারই ফলে অশেষ ক্লেশ ভোগ করিতেছে। তাহাদের দুর্গতি বর্ণনাতীত। তাহারা তথাগতকে স্বীকার করে না, তাঁহারা মঙ্গলকর উপদেশ গ্রাহ্য করে না, সাধকদের প্রতিও তাহাদের শ্রদ্ধা নাই। এই ভাবনার প্রথম অভ্যুদয়ে বোধিসত্ত্বের চিত্ত শোকান্ধকারে আচ্ছন্ন হয়; সেই শোক মন্দীভূত হইবামাত্রই জীবের সেবার জন্য তাঁহার হৃদয়ে অবিচলিত সাধু সঙ্কল্প জাগিয়া উঠে, তিনি তখন সকল জীবের অবিদ্যার বোঝা গ্রহণ করিয়া সকলের জন্য নির্ব্বাণ সাধনায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন; তাঁহার বোঝা যতই ভারী হউক না কেন, সঙ্কল্পের সুদৃঢ় বর্ম্মে সমাবৃত হৃদয় কদাচ দমিয়া যায় না। তাঁহার প্রজ্ঞা তাঁহার করুণা তাঁহার মৈত্রী তাঁহার সুকৃতি সমস্তই অনন্তজীবের হিতসাধনে উৎসৃষ্ট।

 কি ব্রত গ্রহণ করিয়া উদ্বুদ্ধচিত্ত নবীন বোধিসত্ত্ব সাধনায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধগ্রন্থকার শান্তিদেব তৎপ্রণীত বোধিচর্য্যাবতার গ্রন্থে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করিয়াছেন। তথায় উক্ত হইয়াছে যে, বোধিসত্ত্ব এইরূপ সঙ্কল্প করেন:—বুদ্ধদেব আরাধনা করিয়া, তাঁহাদের শরণাপন্ন হইয়া, স্বকৃত পাপ স্বীকার করিয়া আমি যে পুণ্য অর্জ্জন করি তাহা জীবের হিতে ও বোধিলাভের আনুকূল্যে ব্যয়িত হউক। যাহারা ক্ষুধার্ত্ত আমি তাহাদের অন্ন, যাহারা তৃষিত আমি তাহাদের পানীয় হইতে ইচ্ছা করি। আমি আমাকে আমার বর্ত্তমান ও জন্মজন্মান্তরের ভাবী সত্তাকে জীবকল্যাণে উৎসর্গ করিলাম। পূর্ব্ববর্ত্তী বুদ্ধগণ যে ভাবের বশবর্ত্তী হইয়া ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন, আমি আপনাকে তাহাদের নিকটে অশেষ ঋণী মনে করিয়া সেই ভাবের অনুবর্ত্তী হইয়া সমগ্র জীবের নির্ব্বাণ সাধনায় প্রবৃত্ত হইলাম।

 বোধিসত্ত্বের এই নির্ব্বাণ সাধনা উচ্ছেদ মূলক নহে, তিনি এক দিকে আপনার ভোগ বাসনা সম্পূর্ণ বিসর্জ্জন করিয়া যেমন স্বার্থমূলক অহংকে সঙ্কুচিত করেন, অপর দিকে করুণায় বিগলিত হইয়া, মৈত্রী ভাবনা দ্বারা আপনাকে লোক লোকান্তরে ব্যাপ্ত করিয়া দিয়া থাকেন। তিনি ধ্যানপরায়ণ হইয়াও করুণ-হৃদয়, বিনয়ী ও সহিষ্ণু। তাঁহার সকল কর্ম্ম, সকল চেষ্টা এবং সকল ধ্যানের মূলে জীবের প্রতি অপ্রমেয় সহানুভূতি বিদ্যমান রহিয়াছে। অবশ্য ব্রতগ্রহণ করিবামাত্রই বোধিসত্ত্ব সর্ব্বপাপ হইতে মুক্তি লাভ করিয়া থাকেন কেহ যেন ভ্রমেও এমন কথা মনে না করেন। পাপ প্রলোভনের হস্ত হইতে উদ্ধার লাভের নিমিত্ত তাঁহাকে শীল গ্রহণ করিতে হয় সত্য, কিন্তু তিনি জানেন যে পরার্থে আপনাকে সর্ব্বতোভাবে অর্পণ করিবার জন্যই তিনি শীল গ্রহণ করিলেন। জীবের প্রতি করুণা রক্ষা করিবার নিমিত্ত তিনি অসীম ক্ষান্তিকে তাঁহার চিত্তের ভূষণ করিয়া লইয়াছেন। কোন দুর্ব্বিনীত নিষ্ঠুর ব্যক্তি তাঁহাকে আঘাত করিলেও তিনি ক্রুদ্ধ হইবেন না; মনে করিবেন, আমি যখন দেহধারী জীব তখন আমাকে দৈহিক উৎপীড়ন সহিতেই হইবে। আঘাতকারী ব্যক্তি আমার শত্রু নহে, বুদ্ধগণেরই ন্যায় পরম মিত্র; আঘাত করিয়া সে আমাকে সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাশীলতা শিক্ষা করিবার সুযোগ প্রদান করিয়াছে; নিষ্পাপ হইবার নিমিত্ত আমাকে এই গুণ দুইটির অধিকারী হইতে হইবে। যাহারা আমার সহিত শক্রতাচরণ করে তাহাদের প্রতি ক্রুদ্ধ না হইয়া আমি তাহাদিগকে কৃপা করিব। বুদ্ধগণ যেমন অবিচলিত চিত্তে মুক্তির চিন্তা করিয়াছেন আমিও তাঁহাই করিব।

 সাধনা দ্বারা বোধিসত্ত্ব দিব্যদর্শন দিব্যশ্রবণ প্রভৃতি অলৌকিক ঋদ্ধি লাভ করিয়া থাকেন এবং তিনি শ্রেষ্ঠতম মঙ্গল ও শান্তি লাভ করিয়াও কৃতার্থ হন। কিন্তু ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি কোন কালেই নিবদ্ধ নহে। তিনি পরম পাপীর উদ্ধার সাধনের নিমিত্ত অকুণ্ঠিত চিত্তে নরকের দুর্গমতম প্রদেশে গমন করেন। তাঁহার সমস্ত তেজোবীর্য্য, সমস্ত উদ্যম, সমস্ত চেষ্টা জীবপ্রীতির রসপ্রস্রবণ হইতে উৎসারিত। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধগণের ন্যায় সম্যক্‌ সম্বুদ্ধ নহেন। জীবহিত সাধনের উৎসাহের আধিক্য তাঁহার কার্য্যে কত ত্রুটী কত স্খলন পতন দৃষ্ট হইবে। কিন্তু তাঁহার কোন অপরাধই স্বার্থপরতা দ্বারা কলুষিত নহে, জীবপ্রেমের দ্বারা সংস্পৃষ্ট। কিন্তু সকল স্খলন পতন সত্ত্বেও বোধিসত্ত্ব বিশ্বের উদার রাজবর্ত্ম দিয়া পরিপূর্ণ আদর্শের দিকে তীব্র গতিতে অগ্রসর হইতেছেন।