মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/কৈরাতপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥কৈরাতপর্বাধ্যায়॥

১০। কিরাতবেশী মহাদেব ― অর্জুনের দিব্যাস্ত্রলাভ

 অর্জুন এক ঘোর বনে উপস্থিত হয়ে আকাশে শঙ্খ ও পটহের ধ্বনি শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে কঠোর তপস্যায় নিরত হ’লে মহর্ষিগণ মহাদেবকে জানালেন। মহাদেব কাঞ্চনতরুর ন্যায় উজ্জ্বল কিরাতের বেশ ধারণ করে পিনাকহস্তে দর্শন দিলেন। অনুরূপ বেশে দেবী উমা, তাঁর সহচরীবৃন্দ এবং ভূতগণ অনুগমন করলেন। ক্ষণমধ্যে সমস্ত বন নিঃশব্দ হ’ল, প্রস্রবণের নিনাদ ও পক্ষিরবও থেমে গেল। সেই সময়ে মূক নামে এক দানব বরাহের রূপে অর্জুনের দিকে ধাবিত হ’ল। অর্জুন শরাঘাত করতে গেলে কিরাতবেশী মহাদেব বললেন, এই নীলমেঘবর্ণ বরাহকে মারবার ইচ্ছা আমিই আগে করেছি। অর্জুন বারণ শুনলেন না, তিনি ও কিরাত এককালেই শরমোচন করলেন, দুই শর একসঙ্গে বরাহের দেহে বিদ্ধ হ’ল। মূক দানব ভীষণ রূপ ধারণ ক’রে ম’রে গেল। অর্জুন কিরাতকে সহাস্যে বললেন, কে তুমি কনককান্তি? এই বনে স্ত্রীদের নিয়ে বিচরণ করছ কেন? আমার বরাহকে কেন তুমি শরবিদ্ধ করলে? পর্বতবাসী, তুমি মৃগয়ার নিয়ম লঙ্ঘন করেছ সেজন্য তোমাকে বধ করব। কিরাত হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, বীর, আমবা এই বনেই থাকি, তুমি ভয় পেয়ো না। এই জনহীন দেশে কেন এসেছ? অর্জুন বললেন, মন্দবুদ্ধি, তুমি বলদর্পে নিজের দোষ মানছ না, আমার হাতে তোমার নিস্তার নেই।

 অর্জুন শরবর্ষণ করতে লাগলেন, পিনাকপাণি কিরাতরূপী শংকর অক্ষতশরীরে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে অর্জুন বললেন, সাধু সাধু। তাঁর অক্ষয় তুণীরের সমস্ত বাণ নিঃশেষ হ’ল, তিনি ধনুর্গুণ দিয়ে কিরাতকে আকর্ষণ ক’রে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন, কিরাত ধনু কেড়ে নিলেন। অর্জুন তাঁর মস্তকে খড়্‌গাঘাত করলেন, খড়্‌গ লাফিয়ে উঠল। অর্জুন বৃক্ষ আর শিলা দিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন, তাও বৃথা হ’ল। তখন দুজনে ঘোর মুষ্টিযুদ্ধ হাতে লাগল। কিরাতের বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে অর্জুনের শ্বাসরোধ হ’ল, তিনি নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে চৈতন্য পেয়ে তিনি মহাদেবের মৃন্ময় মূর্তি গড়ে পূজা করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর নিবেদিত মাল্য কিরাতের মস্তকে লগ্ন হচ্ছে। তখন তিনি কিরাতরূপী মহাদেবের চরণে পতিত হয়ে স্তব করতে লাগলেন।

 মহাদেব প্রীত হয়ে অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, পার্থ, তুমি পূর্বজন্মে বদরিকাশ্রমে নারায়ণের সহচর নর হয়ে অযুত বৎসর তপস্যা করেছিলে, তোমরা নিজ তেজে জগৎ রক্ষা করছ। তুমি অভীষ্ট বর চাও। অর্জুন বললেন, বৃষধ্বজ, ব্রহ্মশির নামে আপনার যে পাশুপত অস্ত্র আছে তাই আমাকে দিন, কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধকালে আমি তা প্রয়োগ করব। মহাদের মূর্তিমান কৃতান্তের তুল্য সেই অস্ত্র অর্জুনকে দান করে তার প্রয়োগ ও প্রত্যাহারের বিধি শিখিয়ে দিলেন। তার পর অর্জুনের অঙ্গ স্পর্শ ক’রে সকল ব্যথা দূর করে বললেন, এখন তুমি স্বর্গে যাও। এই ব’লে তিনি উমার সঙ্গে প্রস্থান করলেন।

 তখন বরুণ কুবের যম এবং ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ইন্দ্র অর্জুনের নিকট আবির্ভূত হলেন। যম তাঁর দণ্ড, বরুণ তাঁর পাশ, এবং কুবের অন্তর্ধান নামক অস্ত্র দান করলেন। ইন্দ্র বললেন, কৌন্তেয়, তোমাকে মহৎ কার্যের জন্য দেবলোকে যেতে হবে সেখানেই তোমাকে দিব্যাস্ত্রসমূহ দান করব। তার পর দেবতারা চ’লে গেলেন।