মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/নলোপাখ্যানপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥নলোপাখ্যানপর্বাধ্যায়॥

১২। ভীমের অধৈর্য ― মহর্ষি বৃহদশ্ব

 একদিন পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে দুঃখিতমনে কাম্যকবনে উপবিষ্ট ছিলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাদের পৌরুষ আছে, বলবানদের সাহায্য নিয়ে আমরা আরও বলশালী হ’তে পারি, কিন্তু আপনার দ্যূতদোষের জন্য সকলে কষ্ট পাচ্ছি। রাজ্যশাসনই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, বনবাস নয়। আমরা অর্জুনকে ফিরিয়ে এনে এবং জনার্দন কৃষ্ণের সহায়তায় বার বৎসরের পূর্বেই ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করব। শত্রুরা দূর হ’লে আপনি বন থেকে ফিরে যাবেন, তা হলে আপনার দোষ হবে না। তার পর আমরা অনেক যজ্ঞ ক’রে পাপমুক্ত হয়ে উত্তম স্বর্গে যাব। রাজা, এইরূপই হ’তে পারে যদি আপনি নির্বুদ্ধিতা দীর্ঘসূত্রতা আর ধর্মপরায়ণতা ত্যাগ করেন। শঠতার দ্বারা শঠকে বধ করা পাপ নয়। ধর্মজ্ঞ লোকের বিচারে দুঃসহ দুঃখের কালে এক অহোরাত্রই এক বৎসরের সমান গণ্য হয়, এইরূপ বেদবচনও শোনা যায়। অতএব আমাদের তের দিনেই তের বৎসর পূর্ণ হয়েছে, দুর্যোধনাদিকে বধ করবার সময় এসেছে। দুর্যোধনের চর সর্বত্র আছে, অজ্ঞাতবাসকালেও সে আমাদের সন্ধান পেয়ে আবার বনবাসে পাঠাবে। যদি অজ্ঞাতবাস থেকে উত্তীর্ণ হই তবে সে আবার আপনাকে দ্যূতক্রীড়ায় ডাকবে। আপনার নিপুণতা নেই, খেলতে খেলতে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, সেজন্য আবার আপনি হারবেন।

 যুধিষ্ঠির ভীমকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মহাবাহু, তের বৎসর উত্তীর্ণ হলে তুমি আর অর্জুন নিশ্চয় দুর্যোধনকে বধ করবে। তুমি বলছ, সময় এসেছে, কিন্তু আমি মিথ্যা বলতে পারব না। শঠতা না ক’রেও তুমি শত্রু বধ করবে।

 এমন সময় মহর্ষি বৃহদশ্ব সেখানে এলেন। যুধিষ্ঠির যথাশাস্ত্র মধুপর্ক দিয়ে তাঁকে পূজা করলেন। বৃহদশ্ব বিশ্রামের পর উপবিষ্ট হলে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, ভগবান, ধূর্ত দ্যূতকারগণ আমার রাজ্য ও ধন শঠতার দ্বারা হরণ করেছে। আমি সরলস্বভাব, অক্ষনিপুণ নই। তারা আমার প্রিয়তমা ভার্যাকে দ্যূতসভায় নিয়ে গিয়েছিল, তার পর দ্বিতীয়বার দ্যূতে জয়লাভ ক’রে আমাদের বনে পাঠিয়েছে। দ্যূতসভায় তারা যে দারুণ কটুবাক্য বলেছে এবং আমার দুঃখার্ত সুহৃদ্‌গণ যা বলেছিলেন তা আমার হৃদয়ে নিহিত আছে, সমস্ত রাত্রি আমি সেইসকল কথা চিন্তা করি। অর্জুনের বিরহেও আমি যেন প্রাণহীন হয়ে আছি। আমার চেয়ে মন্দভাগ্য ও দুঃখার্ত কোনও রাজাকে আপনি জানেন কি?

 মহর্ষি বৃহদশ্ব বললেন, যদি শুনতে চাও তবে এক রাজার কথা বলব যিনি তোমার চেয়েও দুঃখী ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে বৃহদশ্ব নল রাজার এই উপাখ্যান বললেন—

১৩। নিষধরাজ নল ― দময়ন্তীর স্বয়ংবর

 নিষধ দেশে নল নামে এক বলশালী সদ্‌গুণান্বিত রূপবান অশ্বতত্ত্বজ্ঞ রাজা ছিলেন। তিনি বীরসেনের পুত্র, ব্রাহ্মণপালক, বেদজ্ঞ, দ্যূতপ্রিয়, সত্যবাদী, এবং বৃহৎ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। তাঁর সমকালে বিদর্ভ দেশে ভীম নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ও তাঁর মহিযী ব্রহ্মর্ষি দমনকে সেবায় তুষ্ট ক’রে একটি কন্যা ও তিনটি পুত্র লাভ করেন। কন্যার নাম দময়ন্তী, তিন পুত্রের নাম দম, দান্ত ও দমন। দময়ন্তীর ন্যায় সুন্দরী মনুষ্যলোকে কেউ ছিল না, দেবতারাও তাঁকে দেখে আনন্দিত হতেন।

 লোকে নল ও দময়ন্তীর নিকট পরস্পরের রূপগণের প্রশংসা করত, তার ফলে দেখা না হ’লেও তাঁরা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হলেন। একদিন নল নির্জন উদ্যানে বেড়াতে বেড়াতে কতকগুলি কনকবর্ণ হংস দেখতে পেলেন। তিনি একটিকে ধরলে সে বললে, রাজা, আমাকে মারবেন না, আমি আপনার প্রিয়কার্য করব, দময়ন্তীর কাছে গিয়ে আপনার সম্বন্ধে এমন ক’রে বলব যে তিনি অন্য পুরুষ কামনা করবেন না। নলের কাছে মুক্তি পেয়ে সেই হংস তার সহচরদের সঙ্গে বিদর্ভ দেশে দময়ন্তীর নিকট উপস্থিত হ’ল। রাজকন্যা ও তাঁর সখীরা সেই সকল আশ্চর্য হংস দেখে হৃষ্ট হয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা করলেন। দময়ন্তী যাকে ধরতে গেলেন সেই হংস মানুষের ভাষায় বললে, নিষধরাজ নল মূর্তিমান কন্দর্পের ন্যায় রূপবান, তাঁর সমান আর কেউ নেই। আপনি যেমন নারীরত্ন, নলও সেইরূপ পুরুষশ্রেষ্ঠ, উত্তমার সঙ্গে উত্তমের মিলন অতিশয় শুভকর হবে। দময়ন্তী উত্তর দিলেন, তুমি নলের কাছে গিয়ে তাঁকেও এই কথা ব’লো। তখন হংস নিষধরাজ্যে গিয়ে নলকে সকল কথা জানালে।

 দময়ন্তী চিন্তাগ্রস্ত বিবর্ণ ও কৃশ হতে লাগলেন। সখীদের মুখে কন্যার অসুস্থতার সংবাদ শুনে বিদর্ভরাজ ভীম ভাবলেন, কন্যা যৌবনলাভ করেছে, এখন তার স্বয়ংবর হওয়া উচিত। রাজা স্বয়ংবরের আয়োজন করলেন, তাঁর নিমন্ত্রণে বহু রাজা বিদর্ভ দেশে সমবেত হলেন।

 এই সময়ে নারদ ও পর্বত দেবর্ষিদ্বয় দেবরাজ ইন্দ্রের নিকটে গেলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর ইন্দ্র বললেন, যে ধর্মজ্ঞ রাজারা সমরে পরাঙ্‌মুখ না হয়ে জীবন ত্যাগ করেন তাঁরা অক্ষয় স্বর্গলোক লাভ করেন। সেই ক্ষত্রিয় বীরগণ কোথায়? সেই প্রিয় অতিথিগণকে আর এখানে আসতে দেখি না কেন? নারদ বললেন, দেবরাজ, তার কারণ শুনুন।—বিদর্ভরাজকন্যা দময়ন্তী তাঁর সৌন্দর্যে পৃথিবীর সমস্ত নারীকে অতিক্রম করেছেন, শীঘ্রই তাঁর স্বয়ংবর হবে। সেই নারীরত্নকে পাবার আশায় সকল রাজা আর রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন। এমন সময় অগ্নি প্রভৃতি লোকপালগণ ইন্দ্রের কাছে এলেন এবং নারদের কথা শুনে হৃষ্ট হয়ে সকলে বললেন, আমরাও যাব।

 ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম তাঁদের বাহন ও অনুচর সহ বিদর্ভ দেশে যাত্রা করলেন। পথে তাঁরা সাক্ষাৎ মন্মথতুল্য নলকে দেখে বিস্মিত হলেন, তাঁদের দময়ন্তীলাভের আশা দূর হ’ল। দেবগণ তাঁদের বিমান আকাশে রেখে ভূতলে নেমে নলকে বললেন, নিষধরাজ, তুমি সত্যব্রত, দূত হয়ে আমাদের সাহায্য কর। নল কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, করব। আপনারা কে? আমাকে কার দৌত্য করতে হবে? ইন্দ্র বললেন, আমরা অমর, দময়ন্তীর জন্য এসেছি। তুমি গিয়ে তাঁকে বল যে দেবতারা তাঁকে চান, তিনি ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম এই চারজনের একজনকে বরণ করুন। নল বললেন, আমিও তাঁকে চাই, নিজেই যখন প্রার্থী তখন পরের জন্য কি করে বলব? দেবগণ, আমাকে ক্ষমা করুন। দেবতারা বললেন, তুমি করব ব’লে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, এখন তার অন্যথা করতে পার না, অতএব শীঘ্র যাও। নল বললেন, সুরক্ষিত অন্তঃপুরে আমি কি ক’রে প্রবেশ করব? ইন্দ্র বললেন, তুমি প্রবেশ করতে পারবে।

 সখীগণে পরিবেষ্টিত দময়ন্তীর কাছে নল উপস্থিত হলেন। দময়ন্তী স্মিতমুখে বললেন, সর্বাঙ্গসুন্দর, তুমি কে? আমার হৃদয় হরণ করতে কেন এখানে এসেছ? নল বললেন, কল্যাণী, আমি নল, ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম এই চার দেবতার দূত হয়ে তোমার কাছে এসেছি, তাঁদের একজনকে পতিরূপে বরণ কর। দময়ন্তী বললেন, রাজা, আমি এবং আমার যা কিছু আছে সবই তোমার, তুমিই আমার প্রতি প্রণয়শীল হও। হংসদের কাছে সংবাদ পেয়ে তোমাকে পাবার জন্যই আমি স্বয়ংবরে রাজাদের আনিয়েছি। তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান কর তবে বিষ অগ্নি জল বা রজ্জুর দ্বারা আত্মহত্যা করব। নল বললেন, দেবতারা থাকতে মানবকে চাও কেন? আমি তাঁদের চরণধূলির তুল্যও নই, তাঁদের প্রতিই তোমার মন দেওয়া উচিত। দময়তী অশ্রুপ্লাবিতনয়নে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, দেবগণকে প্রণাম করি; মহারাজ, আমি তোমাকেই পতিত্বে বরণ করব। নল বললেন, কল্যাণী, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেবগণের দূত রূপে এসেছি, এখন স্বার্থসাধন কি ক’রে করব? দময়ন্তী বললেন, আমি নির্দোষ উপায় বলছি শোন। ইন্দ্রাদি লোকপালগণের সঙ্গে তুমিও স্বয়ংবর সভায় এস, আমি তাঁদের সম্মুখেই তোমাকে বরণ করব।

 নল ফিরে এসে দেবগণকে বললেন, আমি আপনাদের বার্তা দময়ন্তীকে জানিয়েছি, কিন্তু তিনি আমাকেই বরণ করতে চান। তিনি আপনাদের সকলকে এবং আমাকেও স্বয়ংবরসভায় আসতে বলেছেন।

 বিদর্ভরাজ ভীম শুভদিনে শুভক্ষণে স্বয়ংবরসভা আহ্বান করলেন। নানা দেশের রাজারা সুগন্ধ মাল্য ও মণিকুণ্ডলে ভূষিত হয়ে আসনে উপবিষ্ট হলেন। দময়ন্তী সভায় এলে তাঁর দেহেই রাজাদের দৃষ্টি লগ্ন হয়ে রইল, অন্যত্র গেল না। অনন্তর রাজাদের নামকীর্তন আরম্ভ হ’ল। দময়ন্তী তখন দেখলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের আকৃতি একই প্রকার, প্রত্যেককেই নল বলে মনে হয়। দময়ন্তী ভাবতে লাগলেন, এঁদের মধ্যে কে দেবতা আর কে নল তা কোন্ উপায়ে বুঝব? বৃদ্ধদের কাছে দেবতার যেসব লক্ষণ শুনেছি তা এই পাঁচজনের মধ্যে কারও দেখছি না। তখন দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবগণের উদ্দেশে নমস্কার ক’রে বললেন, আমি হংসগণের বাক্য শুনে নিষধরাজকে পতিত্বে বরণ করেছি, আমার সেই সত্য যেন রক্ষা পায়। দেবগণ নলকে দেখিয়ে দিন, তাঁরা নিজরূপ ধারণ করুন যাতে আমি নলকে চিনতে পারি।

 দময়ন্তীর করুণ প্রার্থনা শুনে এবং নলের প্রতি তাঁর পরম অনুরাগ জেনে ইন্দ্রাদি চারজন লোকপাল তাঁদের দেবচিহ্ণ ধারণ করলেন। দময়ন্তী দেখলেন, তাঁদের গাত্র স্বেদশূন্য, চক্ষু অপলক, দেহ ছায়াহীন। তাঁদের মাল্য অম্লান, অঙ্গ ধূলিশূন্য, ভূমি স্পর্শ না করেই তাঁরা বসে আছেন। কেবল একজনের এইসকল দেবলক্ষণ নেই দেখে দময়ন্তী বুঝলেন তিনিই নল। তখন লজ্জমানা দময়ন্তী বসনপ্রান্ত ধারণ ক’রে নলের স্কন্ধদেশে পরম শোভন মাল্য অর্পণ করলেন। রাজারা হা হা করে উঠলেন, দেবতা ও মহর্ষিগণ সাধু সাধু বললেন। নল হৃষ্টমনে দময়ন্তীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি দেবগণের সন্নিধিতে মানুষকেই বরণ করলে, আমাকে তোমার ভর্তা ও আজ্ঞানুবর্তী বলে জেনো। সুহাসিনী, যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে তত দিন আমি তোমারই অনুরক্ত থাকব।

 দেবতারা হৃষ্ট হয়ে নলকে বর দিলেন। ইন্দ্র বললেন, যজ্ঞকালে তুমি আমাকে প্রত্যক্ষ দেখবে এবং দেহান্তে উত্তম গতি লাভ করবে। অগ্নি বললেন তুমি যেখানে ইচ্ছা করবে সেখানেই আমার আবির্ভাব হবে এবং অন্তিমে তুমি প্রভাময় দিব্যলোকে যাবে। যম বললেন, তুমি যে খাদ্য পাক করবে তাই সুস্বাদু হবে, তুমি চিরকাল ধর্মপথে থাকবে। বরুণ বললেন, তুমি যেখানে জল চাইবে সেখানেই পাবে। দেবতারা সকলে মিলে নলকে উত্তম গন্ধমাল্য এবং যুগল সন্তান লাভের বর দিলেন।

 বিবাহের পর কিছুকাল বিদর্ভ দেশে থেকে নল তাঁর পত্নীর সঙ্গে স্বরাজ্যে ফিরে গেলেন। তিনি অশ্বমেধাদি বিবিধ যজ্ঞ করলেন। যথাকালে দময়ন্তী একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করলেন, তাদের নাম ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনা।

১৪। কলির আক্রমণ — নল-পুষ্করের দ্যূতক্রীড়া

 স্বয়ংবর থেকে ফেরবার পথে দেবতাদের সঙ্গে দ্বাপর আর কলির দেখা হ’ল। কলি বললেন, দময়ন্তীর উপর আমার মন পড়েছে, তাকে স্বয়ংবরে পাবার জন্য যাচ্ছি। ইন্দ্র হেসে বললেন, স্বয়ংবর হয়ে গেছে, আমাদের সমক্ষেই দময়ন্তী নল রাজাকে বরণ করেছেন। কলি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, দেবগণকে ত্যাগ করে সে মানুষকে বরণ করেছে, এজন্য তার কঠোর দণ্ড হওয়া উচিত। ইন্দ্র বললেন, কলি, নলের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন রাজাকে যে অভিশাপ দেয় সে নিজেই অভিশপ্ত হয়ে ঘোর নরকে পড়ে। দেবতাবা চ’লে গেলে কলি দ্বাপরকে বললেন, আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারছি না, নলের দেহে অধিষ্ঠান করে তাকে রাজ্যভ্রষ্ট করব। তুমি আমাকে সাহায্য করবার জন্য অক্ষের (পাশার) মধ্যে প্রবেশ কর।

 কলি নিষধরাজ্যে এসে নলের ছিদ্র অনুসন্ধান করতে লাগলেন। বার বৎসর পরে একদিন কলি দেখলেন, নল মূত্রত্যাগের পর পা না ধুয়ে শুধু আচমন করে সন্ধ্যা করছেন। সেই অবসরে কলি নলের দেহে প্রবেশ করলেন। তার পর তিনি নলের ভ্রাতা পুষ্করের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নলের সঙ্গে অক্ষক্রীড়া কর, আমার সাহায্যে নিষধরাজ্য জয় করতে পারবে। পুষ্কর সম্মত হয়ে নলের কাছে চললেন, কলি বৃষের রূপ ধারণ ক’রে পিছনে পিছনে গেলেন।

 নল পুষ্করের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না, দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রমে ক্রমে সুবর্ণ যানবাহন বসন প্রভৃতি বহু প্রকার ধন হারলেন। রাজাকে অক্ষক্রীড়ায় মত্ত দেখে মন্ত্রী, পুরবাসিগণ ও দময়ন্তী তাঁকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কলির আবেশে নল কোনও কথাই বললেন না। দময়ন্তী পুনর্বার নিজে গিয়ে এবং তাঁর ধাত্রী বৃহৎসেনাকে পাঠিয়ে রাজাকে প্রবুদ্ধ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও ফল হ’ল না। তখন দময়ন্তী সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডেকে আনিয়ে বললেন, রাজা বিপদে পড়েছেন, তুমি তাঁকে সাহায্য কর। তিনি পুষ্করের কাছে যত হেরে যাচ্ছেন ততই তাঁর খেলার আগ্রহ বাড়ছে। রাজা মোহগ্রস্ত হয়েছেন তাই সুহৃজ্জনের আর আমার কথা শুনছেন না। আমার মন ব্যাকুল হয়েছে, হয়তো তাঁর রাজ্যনাশ হবে। তুমি রথে দ্রুতগামী অশ্ব যোজনা কর, আমার পুত্রকন্যাকে কুণ্ডিন নগরে তাদের মাতামহের কাছে নিয়ে যাও। সেখানে আমার দুই সন্তান, রথ ও অশ্ব রেখে তুমি সেখানেই থেকো অথবা যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। সারথি বার্ষ্ণেয় মন্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে বিদর্ভ রাজধানীতে গেল এবং বালক-বালিকা, রথ ও অশ্ব সেখানে রেখে ভীম রাজার কাছে বিদায় নিলে। তার পর শোকার্ত হয়ে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে করতে অযোধ্যায় গেল এবং সেখানে রাজা ঋতুপর্ণের সারথির কর্মে নিযুক্ত হ’ল।

১৫। নল-দময়ন্তীর বিচ্ছেদ ― দময়ন্তীর পর্যটন

 নলের রাজ্য ও সমস্ত ধন অক্ষক্রীড়ায় জিতে নিয়ে পুষ্কর হেসে বললেন, আপনার সর্বস্ব আমি জয় করেছি, কেবল দময়ন্তী অবশিষ্ট আছেন, যদি ভাল মনে করেন তবে এখন তাঁকেই পণ রাখুন। পুণ্যশ্লোক নলের মন দুঃখে বিদীর্ণ হ’ল, তিনি কিছু না বলে তাঁর সকল অলংকার খুলে ফেললেন এবং বিপুল ঐশ্বর্য ত্যাগ ক’রে একবস্ত্রে অনাবৃতদেহে রাজ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। দময়ন্তীও একবস্ত্রে তাঁর সঙ্গে গেলেন।

 পুষ্করের শাসনে কোনও লোক নল-দময়ন্তীর সমাদর করলে না। তাঁরা কেবল জলপান ক’রে নগরের উপকণ্ঠে ত্রিরাত্র বাস করলেন। ক্ষুধার্ত নল ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলি পাখি দেখতে পেলেন, তাদের পালক স্বর্ণবর্ণ। নল ভাবলেন, এই পাখিগুলিই আজ আমাদের ভক্ষ্য হবে আর তাদের পক্ষই ধন হবে। তিনি তাঁর পরিধানের বস্ত্র খুলে ফেলে পাখিদের উপর চাপা দিলেন। পাখিরা বস্ত্র নিয়ে আকাশে উঠে বললে, দুর্বুদ্ধি নল, যা নিয়ে দ্যূতক্রীড়া করেছিলে আমরাই সেই পাশা। তুমি সবস্ত্রে গেলে আমাদের প্রীতি হবে না। বিবদ্ধ নল দময়ন্তীকে বললেন, অনিন্দিতা, যাদের প্রকোপে আমি ঐশ্বর্যহীন হয়েছি, যাদের জন্য আমরা প্রাণযাত্রার উপযুক্ত খাদ্য আর নিষধবাসীর সাহায্য পাচ্ছি না তারাই পক্ষী হয়ে আমার বস্ত্র হরণ করেছে। আমি দুঃখে জ্ঞানহীন হয়েছি। আমি তোমার স্বামী, তোমার ভালর জন্য যা বলছি শোন।—এখান থেকে কতকগুলি পথ অবন্তী ও ঋক্ষবান পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গেছে। ওই বিন্ধ্য পর্বত, ওই পয়োষ্ণী নদী, ওখানে প্রচুর ফলমূল সমন্বিত ঋষিদের আশ্রম আছে। এই বিদর্ভ দেশের পথ, এই কোশল দেশের, ওই দক্ষিণাপথের। নল কাতর হয়ে এই সব কথা বার বার দময়ন্তীকে বললেন।

 দময়ন্তী বললেন, তোমার অভিপ্রায় অনুমান ক’রে আমার হৃদয় কাঁপছে, সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে। তোমাকে ত্যাগ ক’রে আমি কি করে অন্যত্র যাব? ভিষকরা বলেন, সকল দুঃখে ভার্যার সমান ঔষধ নেই। নল বললেন, তুমি কেন আশঙ্কা করছ, আমি নিজেকে ত্যাগ করতে পারি কিন্তু তোমাকে পারি না। দময়ন্তী বললেন, মহারাজ, তবে বিদর্ভের পথ দেখাচ্ছ কেন? যদি আমার আত্মীয়দের কাছেই আমাকে পাঠাতে চাও তবে তুমিও চল না কেন? আমার পিতা বিদর্ভরাজ তোমাকে সসম্মানে আশ্রয় দেবেন, তুমি আমাদের গৃহে সুখে থাকতে পারবে। নল বললেন, পূর্বে সেখানে সমৃদ্ধ অবস্থায় গিয়েছিলাম, এখন নিঃস্ব হয়ে কি ক’রে যাব?

 নল-দময়ন্তী একই বস্ত্র পরিধান করে বিচরণ করতে করতে একটি পথিকদের বিশ্রামস্থানে এলেন এবং ভূতলে শয়ন করলেন। দময়ন্তী তখনই নিদ্রিত হলেন। নল ভাবলেন, দময়ন্তী আমার জন্যই দুঃখভোগ করছেন, আমি না থাকলে ইনি হয়তো পিতৃগৃহে যাবেন। কলির দুষ্ট প্রভাবে নল দময়ন্তীকে ত্যাগ করাই স্থির করলেন এবং যে বস্ত্র তাঁরা দু’জনেই পরে ছিলেন তা দ্বিখণ্ড করবার জন্য ব্যগ্র হলেন। নল দেখলেন, আশ্রয়স্থানের এক প্রান্তে একটি কোষমুক্ত খড়্‌গ রয়েছে। সেই খড়্‌গ দিয়ে বস্ত্রের অর্ধভাগ কেটে নিয়ে নিদ্রিতা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ ক’রে নল দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হলেন, কিন্তু আবার ফিরে এসে পত্নীকে দেখে বিলাপ করতে লাগলেন। এইরূপে নল আন্দোলিতহহৃদয়ে বার বার ফিরে এসে অবশেষে প্রস্থান করলেন।

 নিদ্রা থেকে উঠে নলকে না দেখে দময়ন্তী শোকার্ত ও ভয়ার্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি পতির অন্বেষণে শ্বাপদসংকুল বনে প্রবেশ করলেন। সহসা কুম্ভীরের ন্যায় মহাকায় এক ক্ষুধার্ত অজগর তাঁকে ধরলে। দময়ন্তীর আর্তনাদ শুনে এক ব্যাধ তখনই সেখানে এল এবং তীক্ষ্ণ অস্ত্রে অজগরের মুখ চিরে দময়ন্তীকে উদ্ধার করলে। অজগরকে বধ ক’রে ব্যাধ দময়ন্তীকে প্রক্ষালনের জন্য জল এনে দিলে এবং আহারও দিলে। দময়ন্তী আহার করলে ব্যাধ বললে, মৃগশাবকাক্ষী, তুমি কে, কেন এখানে এসেছ? দময়ন্তী সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। অর্ধবসনধারিণী দময়ন্তীর রূপ দেখে ব্যাধ কামার্ত হয়ে তাঁকে ধরতে গেল। দময়ন্তী বললেন, যদি আমি নিষধরাজ ভিন্ন অন্য পুরুষকে মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে এই ক্ষুদ্র মৃগয়াজীবী গতাসু হয়ে প’ড়ে যাক। ব্যাধ তখনই প্রাণহীন হয়ে ভূপতিত হ’ল।

 দময়ন্তী ঝিল্লীনাদিত বহুবৃক্ষসমাকীর্ণ ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করলেন, সিংহ-ব্যাঘ্র-মহিষ-ভল্লুকাদি প্রাণী এবং ম্লেচ্ছ-তস্কর প্রভৃতি জাতি সেখানে বাস করে। তিনি উন্মত্তার ন্যায় শ্বাপদ পশু ও অচেতন পর্বতকে নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তিন অহোরাত্র উত্তর দিকে চ’লে তিনি এক রমণীয় তপোবনে উপস্থিত হলেন। তপস্বীরা বললেন, সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি কে? শোক ক’রো না, আশ্বস্ত হও। তুমি কি এই অরণ্যের বা পর্বতের বা নদীর দেবী? দময়ন্তী তাঁর ইতিহাস জানিয়ে বললেন, ভগবান, যদি কয়েক দিনের মধ্যে নল রাজার দেখা না পাই তবে আমি দেহত্যাগ করব। তপস্বীরা বললেন, কল্যাণী, তোমার মঙ্গল হবে, আমরা দেখছি তুমি শীঘ্রই নিষধরাজের দর্শন পাবে। তিনি সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সর্বরত্নসমন্বিত হয়ে নিজ রাজ্য শাসন করবেন, শত্রুদের ভয় উৎপাদন ও সুহৃদ্‌গণের শোক নাশ করবেন। এই ব’লে তপস্বীগণ অন্তর্হিত হলেন। দময়ন্তী বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? তাপসগণ কোথায় গেলেন? তাঁদের আশ্রম, পুণ্যসলিলা নদী, ফলপুষ্পশোভিত বৃক্ষ প্রভৃতি কোথায় গেল?

 নলের অন্বেষণে আবার যেতে যেতে দময়ন্তী এক নদীতীরে এসে দেখলেন, এক বৃহৎ বণিকের দল অনেক হস্তী অশ্ব রথ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তী সেই যাত্রিদলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁর উম্মত্তের ন্যায় অর্ধবসনাবৃত কৃশ মলিন মূর্তি দেখে কতকগুলি লোক ভয়ে পালিয়ে গেল, কেউ অন্য লোককে ডাকতে গেল, কেউ হাসতে লাগল। একজন বললে, কল্যাণী, তুমি কি মানবী, দেবতা যক্ষী, না রাক্ষসী? আমরা তোমার শরণ নিলাম, আমাদের রক্ষা কর, যাতে এই বণিকের দল নিরাপদে যেতে পারে তা কর। দময়ন্তী তাঁর পরিচয় দিলেন এবং নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন শচি নামক সার্থবাহ (বণিক্‌সংঘের নায়ক) বললেন, যশস্বিনী, নলকে আমরা দেখি নি, এই বনে আপনি ভিন্ন কোনও মানুষও দেখি নি। আমরা বাণিজ্যের জন্য চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে যাচ্ছি।

 নলের দেখা পাবেন এই আশায় দময়ন্তী সেই বণিকসংঘের সঙ্গে চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে সকলে এক বৃহৎ জলাশয়ের তীরে উপস্থিত হলেন। পরিশ্রান্ত বণিকের দল সেখানে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলে। সকলে নিদ্রিত হ’লে অর্ধরাত্রে এক দল মদমত্ত বন্য হস্তী বণিক সংঘের পালিত হস্তীদের মারবার জন্য সবেগে এল। সহসা আক্রান্ত হয়ে বণিকরা ভয়ে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল, বন্য হস্তীর দন্তাঘাতে ও পদের পেষণে অনেকে নিহত হ’ল, বহু উষ্ট্র ও অশ্বও বিনষ্ট হ’ল। হতাবশিষ্ট বণিকরা বলতে লাগল, আমরা বাণিজ্যদেবতা মণিভদ্রের এবং যক্ষাধিপ কুবেরের পূজা করি নি তারই এই ফল। কয়েকজন বললে, সেই উন্মত্তদর্শনা বিকৃতরূপা নারীই মায়াবলে এই বিপদ ঘটিয়েছে। নিশ্চয় সে রাক্ষসী যক্ষী বা পিশাচী, তাকে দেখলে আমরা হত্যা করব।

 এই কথা শুনতে পেয়ে দময়ন্তী বেগে বনমধ্যে পলায়ন করলেন। তিনি বিলাপ ক’রে বললেন, এই নির্জন অরণ্যে যে জনসংঘে আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও হস্তিযূথ এসে বিধ্বস্ত করলে, এও আমার মন্দভাগ্যের ফল। আমি স্বয়ংবরে ইন্দ্রাদি লোকপালগণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাঁদেরই কোপে আমার এই দুর্দশা হয়েছে। হতাবশিষ্ট লোকদের মধ্যে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন, দময়ন্তী তাঁদের সঙ্গে যেতে লাগলেন। বহুকাল পর্যটনের পর দময়ন্তী একদিন সায়াহ্ণকালে চেদিরাজ সুবাহুর নগরে উপস্থিত হলেন। তাঁকে উন্মত্তার ন্যায় দেখে গ্রাম্য বালকগণ কৌতূহলের বশে তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। দময়ন্তী রাজগ্রাসাদের নিকটে এলে রাজমাতা তাঁকে দেখতে পেয়ে এক ধাত্রীকে বললেন, ওই দুঃখিনী শরণার্থিনী নারীকে লোকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি ওকে নিয়ে এস।

 দময়ন্তী এলে রাজমাতা বললেন, এই দুর্দশাতেও তোমাকে রূপবতী দেখছি, মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের ন্যায় তুমি কে? দময়ন্তী বললেন, আমি পতিব্রতা সদ্‌বংশীয়া সৈরিন্ধ্রী[১]। আমার ভর্তার গুণের সংখ্যা করা যায় না, কিন্তু দুর্দৈববশে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে তিনি বনে এসেছিলেন, সেখানে আমাকে নিদ্রিত অবস্থায় ত্যাগ করে চ’লে গেছেন। বিরহতাপে দিবারাত্র দগ্ধ হয়ে আমি তাঁর অন্বেষণ করছি। রাজমাতা বললেন, কল্যাণী, তোমার উপর আমার স্নেহ হয়েছে, আমার কাছেই তুমি থাক। আমার লোকেরা তোমার পতির অন্বেষণ করবে, হয়তো তিনি ঘুরতে ঘুরতে নিজেই এখানে এসে পড়বেন।

 দময়ন্তী বললেন, বীরজননী, আমি আপনার কাছে থাকব, কিন্তু কারও উচ্ছিষ্ট খাব না বা পা ধুইয়ে দেব না। পতির অন্বেষণের জন্য আমি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করব, কিন্তু অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলব না। যদি কোনও পুরুষ আমাকে প্রার্থনা করে তবে আপনি তাকে বধদণ্ড দেবেন। রাজমাতা সানন্দে সম্মত হলেন, এবং নিজ দুহিতা সুনন্দাকে ডেকে বললেন, এই দেবরূপিণী সৈরিন্ধ্রী তোমার সমবয়স্কা, ইনি তোমার সখী হবেন। সুনন্দা হৃষ্টচিত্তে দময়ন্তীকে নিজগৃহে নিয়ে গেলেন।

১৬। কর্কোটক নাগ ― নলের রূপান্তর

 দময়ন্তীকে ত্যাগ ক’রে নল গহন বনে গিয়ে দেখলেন, দাবাগ্নি জ্বলছে এবং কেউ তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছে, পুণ্যশ্লোক নল, শীঘ্র আসুন। নল অগ্নির নিকটে এলে এক কুণ্ডলীকৃত নাগরাজ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, রাজা, আমি কর্কোটক নাগ, মহর্ষি নারদকে প্রতারিত করেছিলাম সেজন্য তিনি শাপ দিয়েছেন — এই স্থানে স্থাবরের ন্যায় পড়ে থাক, নল যখন তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাবেন তখন শাপমুক্ত হবে। আপনি আমাকে রক্ষা করুন, আমি সখা হয়ে আপনাকে সৎপরামর্শ দেব। এই ব’লে নাগেন্দ্র কর্কোটক অঙ্গুষ্ঠ-প্রমাণ হলেন, নল তাঁকে নিয়ে দাবাগ্নিশূন্য স্থানে চললেন।

 যেতে যেতে কর্কোটক বললেন, নিষধরাজ, আপনি পদক্ষেপ গণনা ক’রে চলুন, আমি আপনার মহোপকার করব। নল দশম পদক্ষেপ করবামাত্র কর্কোটক তাঁকে দংশন করলেন, তৎক্ষণাৎ নলের রূপ বিকৃত হয়ে গেল। কর্কোটক নিজ মূর্তি ধারণ ক’রে বললেন, মহারাজ, লোকে আপনাকে যাতে চিনতে না পারে সেজন্য আপনার প্রকৃত রূপ অন্তর্হিত ক’রে দিলাম। যে কলি কর্তৃক আবিষ্ট হয়ে আপনি প্রতারিত ও মহাদুঃখে পতিত হয়েছেন সে এখন আমার বিষে আক্রান্ত হয়ে আপনার দেহে কষ্টে বাস করবে। আপনি অযোধ্যায় ইক্ষাকুবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণের কাছে গিয়ে বললুন যে আপনি বাহুক নামক সারথি। তিনি আপনার নিকট অশ্বহৃদয় শিখে নিয়ে আপনাকে অক্ষহৃদয়[২] দান করবেন। ঋতুপর্ণ আপনার সখা হবেন, আপনিও দ্যূতক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে শ্রেয়োলাভ করবেন এবং পত্নী পুত্রকন্যা ও রাজ্য ফিরে পাবেন। যখন পূর্বরূপ ধারণের ইচ্ছা হবে তখন আমাকে স্মরণ করে এই বসন পরিধান করবেন। এই ব’লে কর্কোটক নলকে দিব্য বস্ত্রযুগল দান করে অন্তর্হিত হলেন।

 দশ দিন পরে নল ঋতুপর্ণ রাজার কাছে এসে বললেন, আমার নাম বাহুক, অশ্বচালনায় আমার তুল্য নিপুণ লোক পৃথিবীতে নেই। সংকটকালে এবং কোনও কার্যে নৈপণ্যের প্রয়োজন হ’লে আমি মন্ত্রণা দিতে পারব, রন্ধনবিদ্যাও আমি বিশেষরূপে জানি। সর্বপ্রকার শিল্প ও দূরূহ কার্য সম্পাদনেও আমি যত্নশীল হব। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক, তুমি আমার কাছে থাক, তোমার ভাল হবে। দশ সহস্র মুদ্রা বেতনে তুমি আমার অশ্বাধ্যক্ষ নিবৃত্ত হ’লে বার্ষ্ণেয়[৩] ও জীবল[৪] তোমার সেবা করবে।

 ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে নল সসম্মানে বাস করতে লাগলেন। দময়ন্তীকে স্মরণ ক’রে তিনি প্রত্যহ সায়ংকালে এই শ্লোক বলতেন—

ক্ব নু সা ক্ষুৎপিপাসার্তা শ্রান্তা শেতে তপস্বিনী।
স্মরন্তী তস্য মন্দস্য কং বা সাঽদ্যোপতিষ্ঠতি॥

— সেই ক্ষুৎপিপাসার্তা শ্রান্তা দুঃখিনী আজ কোথায় শুয়ে আছে? এই হতভাগ্যকে স্মরণ করে সে আজ কার আশ্রয়ে বাস করছে?

 একদিন জীবল বললে, বাহুক, কোন্ নারীর জন্য তুমি নিত্য এরূপ বিলাপ কর? নল বললেন, কোনও এক মন্দবুদ্ধি পুরুষ ঘটনাক্রমে তার অত্যন্ত আদরণীয়া পত্নীর সহিত বিচ্ছেদের ফলে শোকে দগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করছে। নিশাকালে তার প্রিয়াকে স্মরণ ক’রে সে এই শ্লোক গান করে। সেই পতিপরিত্যক্তা বালা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে একাকী শ্বাপদসংকুল দারুণ বনে বিচরণ করছে, হায়, তার জীবনধারণ দুষ্কর।

১৭। পিত্রালয়ে দময়ন্তী ― নল-ঋতুপর্ণের বিদর্ভ যাত্রা

 বিদভরাজ ভীম তাঁর কন্যা ও জামাতার অন্বেষণের জন্য বহুউ ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন। তাঁরা প্রচুর পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নানা দেশে নল-দময়ন্তীকে খুঁজতে লাগলেন। সুদেব নামে এক ব্রাহ্মণ চেদি দেশে এসে রাজভবনে যজ্ঞকালে দময়ন্তীকে দেখতে পেলেন। সুদেব নিজের পরিচয় দিয়ে দময়ন্তীকে তাঁর পিতা মাতা ও পুত্রকন্যার কুশল জানালেন। ভ্রাতার প্রিয় সখা সুদেবকে দেখে দময়ন্তী কাঁদতে লাগলেন। সুনন্দার কাছে সংবাদ পেয়ে রাজমাতা তখনই সেখানে এলেন এবং সুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রাহ্মণ, ইনি কার ভার্যা, কার কন্যা? আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন কেন? আপনিই বা এঁকে জানলেন কি ক’রে? সুদেব নল-দময়ন্তীর ইতিহাস বিবৃত ক’রে বললেন, দেবী, এঁর অন্বেষণে আমরা সর্বত্র ভ্রমণ করেছি, এখন আপনার আলয়ে এঁকে পেলাম। এঁর অতুলনীয় রূপ এবং দুই ভ্রূর মধ্যে যে পদ্মাকৃতি জটুল রয়েছে তা দেখেই ধূমাবৃত অগ্নির ন্যায় এঁকে আমি চিনেছি।

 সানন্দা দময়ন্তীর ললাটের মল মুছিয়ে দিলেন, তখন সেই জটুল মেঘমুক্ত চন্দ্রের ন্যায় সুস্পষ্ট হ’ল। তা দেখে রাজমাতা ও সুনন্দা দময়ন্তীকে জড়িয়ে ধ’রে কাঁদতে লাগলেন। রাজমাতা অশ্রুপূর্ণ নয়নে বললেন, তুমি আমার ভগিনীর কন্যা, ওই জটুল দেখে চিনেছি। দশার্ণরাজ সুদামা তোমার মাতার ও আমার পিতা তোমার জন্মকালে দশার্ণদেশে পিতৃগৃহে আমি তোমাকে দেখেছিলাম। দময়ন্তী, তোমার পক্ষে আমার গৃহ তোমার পিতৃগৃহেরই সমান। দময়ন্তী আনন্দিত হয়ে মাতৃষ্বসাকে প্রণাম ক’রে বললেন, আমি অপরিচিত থেকেও আপনার কাছে সসুখে বাস করেছি, এখন আরও সুখে থাকতে পারব। কিন্তু মাতা, পুত্রকন্যার বিচ্ছেদে আমি শোকার্ত হয়ে আছি, অতএব আজ্ঞা দিন আমি বিদর্ভ দেশে যাব।

 রাজমাতা তাঁর পুত্রের অনুমতি নিয়ে বিশাল সৈন্যদল সহ দময়ন্তীকে মনুষ্যবাহিত যানে বিদর্ভরাজ্যে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা ভীম আনন্দিত হয়ে সহস্র গো, গ্রাম ও ধন দান ক’রে সুদেবকে তুষ্ট করলেন। দময়ন্তী তাঁর জননীকে বললেন, যদি আমার জীবন রক্ষা করতে চান তবে আমার পতিকে আনবার চেষ্টা করুন। রাজার আজ্ঞায় ব্রাহ্মণগণ চতুর্দিকে যাত্রা করলেন। দময়ন্তী তাঁদের ব’লে দিলেন, আপনারা সকল রাষ্ট্রে জনসংসদে এই কথা বার বার বলবেন — ‘দ্যূতকার, বস্ত্রার্ধ ছিন্ন ক’রে নিদ্রিতা প্রিয়াকে অরণ্যে ফেলে কোথায় গেছ? সে এখনও অর্ধবস্ত্রে আবৃত হয়ে তোমার জন্য রোদন করছে। রাজা, দয়া কর, প্রতিবাক্য বল।’ আপনারা এইরূপ বললে কোনও লোক যদি উত্তর দেন তবে ফিরে এসে আমাকে জানাবেন, কিন্তু কেউ যেন আপনাদের চিনতে না পারে।

 দীর্ঘকাল পরে পর্ণাদ নামে এক ব্রাহ্মণ ফিরে এসে বললেন, আমি ঋতুপর্ণ রাজার সভায় গিয়ে আপনার বাক্য বলেছি, কিন্তু তিনি বা কোনও সভাসদ উত্তর দিলেন না। তার পর আমি বাহুক নামক এক রাজভৃত্যের কাছে গেলাম। সে রাজার সারথি, কুরূপ, খর্ববাহু দ্রুত রথচালনায় নিপুণ, সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করতেও জানে। সে বহুবার নিঃশ্বাস ফেলে ও রোদন ক’রে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলে, তার পর বললে, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বসন হরণ করেছিল, সেই মোহগ্রস্ত বিপদাপন্ন ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ ক’রে চ’লে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না। এই বার্তা শনে দময়ন্তী তাঁর জননীকে বললেন, আপনি পিতাকে কিছু জানাবেন না। এখন সুদেব শীঘ্র ঋতুপর্ণের রাজধানী অযোধ্যায় যান এবং নলকে আনবার চেষ্টা করুন।

 দময়ন্তী পর্ণাদকে পারিতোষিক দিয়ে বললেন, বিপ্র, নল এখানে এলে আমি আবার আপনাকে ধনদান করব। পর্ণাদ কৃতার্থ হয়ে চ’লে গেলে দময়ন্তী সুদেবকে বললেন, আপনি সত্বর অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণকে বলুন — ভীম রাজার কন্যা দময়ন্তীর পুনর্বার স্বয়ংবর হবে, কল্য সূর্যোদয়কালে তিনি দ্বিতীয় পতি বরণ করবেন, কারণ নল জীবিত আছেন কিনা জানা যাচ্ছে না। বহু রাজা ও রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন, আপনিও যান।


 সহদেবের বার্তা শুনে ঋতুপর্ণ নলকে বললেন, বাহুক, আমি একদিনের মধ্যে বিদর্ভরাজ্যে দময়ন্তীর স্বয়ংবরে যেতে ইচ্ছা করি। নল দুঃখার্ত হয়ে ভাবলেন, আমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই কি তিনি এই উপায় স্থির করেছেন? আমি হীনমতি অপরাধী, তাঁকে প্রতারিত করেছি, হয়তো সেজন্যই তিনি এই নৃশংস কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন। না, তিনি কখনও এমন করবেন না, বিশেষত তাঁর যখন সন্তান রয়েছে। ঋতুপর্ণকে নল বললেন যে তিনি একদিনেই বিদর্ভনগরে পৌঁছবেন তার পর তিনি অশ্বশালায় গিয়ে কয়েকটি সিন্ধুদেশজাত কৃশকায় অশ্ব বেছে নিলেন। তা দেখে রাজা কিঞ্চিৎ রুষ্ট হয়ে বললেন, বাহুক, এইসকল ক্ষীণজীবী অশ্ব নিচ্ছ কেন, আমাকে কি প্রতারিত করতে চাও? নল উত্তর দিলেন, মহারাজ, এই অশ্বগুলির ললাট মস্তক পার্শ্ব প্রভৃতি স্থানে দশটি রোমাবর্ত— আছে, দ্রুতগমনে এরাই শ্রেষ্ঠ। তবে আপনি যদি অন্য অশ্ব উপযুক্ত মনে করেন, তাই নেব। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক, তুমি অশ্বতত্ত্বজ্ঞ, যে অশ্ব ভাল মনে কর তাই নাও। তখন নল নিজের নির্বাচিত চারটি অশ্ব রথে যুক্ত করলেন।

 ঋতুপর্ণ রথে উঠলে নল সারথি বার্ষ্ণেয়কে তুলে নিলেন এবং মহাবেগে রথ চালালেন। বার্ষ্ণেয় ভাবলে, এই বাহুক কি ইন্দ্রের সারথি মাতলি না স্বয়ং নল রাজা? বয়সে নলের তুল্য হলেও এ আকৃতিতে বিরূপ ও খর্ব। বাহুকের রথচালনা দেখে ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। সহসা তাঁর উত্তরীয় উড়ে যাওয়ায় তিনি বললেন, রথ থামাও, বার্ষ্ণেয় আমার উত্তরীয় নিয়ে আসুক। নল বললেন, আমরা এক যোজন ছাড়িয়ে এসেছি, এখন উত্তরীয় পাওয়া অসম্ভব। ঋতুপর্ণ বিশেষ প্রীত হলেন না। তিনি এক বিভীতক (বহেড়া) বৃক্ষ দেখিয়ে বললেন, বাহুক, সকলে সব বিষয় জানে না, তুমি আমার গণনার শক্তি দেখ।— এই বৃক্ষ থেকে ভূমিতে পতিত পত্রের সংখ্যা এক শ এক, ফলের সংখ্যাও তাই। এর শাখায় পাঁচ কোটি পত্র আর দু হাজার পঁচানব্বই ফল আছে, তুমি গণনা ক’রে দেখ। রথ থামিয়ে নল বললেন, মহারাজ আপনি গর্ব করছেন, আমি এই বৃক্ষ কেটে ফেলে পত্র ও ফল গণনা করব। রাজা বললেন, এখন বিলম্ব করবার সময় নয়। নল বললেন, আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আর যদি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তবে সম্মুখের পথ ভাল আছে, বার্ষ্ণেয় আপনাকে নিয়ে যাক। ঋতুপর্ণ অনুনয় ক’রে বললেন, বাহুক, তোমার তুল্য সারথি পৃথিবীতে নেই, আমি তোমার শরণাপন্ন, গমনে বিঘ্ন করো না। যদি আজ সূর্যাস্তের পূর্বে বিদর্ভদেশে যেতে পার তবে তুমি যা চাইবে তাই দেব। নল বললেন, আমি পত্র আর ফল গণনা ক’রে বিদর্ভে যাব। রাজা অনিচ্ছায় বললেন, আমি শাখার এক অংশের পত্র ও ফলের সংখ্যা বলছি, তাই গণনা করে সন্তুষ্ট হও। নল শাখা কেটে গণনা করে বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শক্তি অতি অদ্ভুত, আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনি আমার বিদ্যা অশ্বহৃদয় নিন।

 ঋতুপর্ণ অশ্বহৃদয় শিখে নলকে অক্ষহৃদয় দান করলেন। তৎক্ষণাৎ কলি কর্কোটক-বিষ বমন করতে করতে নলের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অন্যের অদৃশ্য হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে ক্রুদ্ধ নলকে বললেন, নৃপতি, আমাকে অভিশাপ দিও না, আমি তোমাকে পরমা কীর্তি দান করব। যে লোক তোমার নাম কীর্তন করবে তার কলিভয় থাকবে না। এই ব’লে তিনি বিভীতক বৃক্ষে প্রবেশ করলেন। কলির প্রভাব থেকে মুক্ত নলের সন্তাপ দূর হ’ল, কিন্তু তখনও তিনি বিরূপ হয়ে রইলেন।

১৮। নল-দময়ন্তীর পুনর্মিলন

 ঋতুপর্ণ সায়ংকালে বিদর্ভরাজপুর কুণ্ডিন নগরে প্রবেশ করলেন। নলচালিত রথের মেঘগর্জনের ন্যায় ধ্বনি শুনে দময়ন্তী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয় মহীপতি নল এখানে আসছেন। আজ যদি তাঁর চন্দ্রবদন না দেখতে পাই, যদি তাঁর বাহুদ্বয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় মরব। দময়ন্তী জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাসাদের উপরে উঠে ঋতুপর্ণ বাষ্ণেয় ও বাহুককে দেখতে পেলেন।

 ঋতুপর্ণ স্বয়ংবরের কোনও আয়োজন দেখতে পেলেন না। বিদর্ভমাজ ভীম কিছুই জানতেন না, তিনি ঋতুপর্ণকে সসম্মানে সংবর্ধনা ক’রে তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ঋতুপর্ণ দেখলেন, কোনও রাজা বা রাজপুত্র স্বয়ংবরের জন্য আসেন নি; অগত্যা তিনি বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনাকে অভিবাদন করতে এসেছি। রাজা ভীমও বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, শত যোজনের অধিক পথ অতিক্রম ক’রে কেবল অভিবাদনের জন্য এঁর আসবার কারণ কি?

 রাজভৃত্যগণ ঋতুপর্ণকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট গৃহে নিয়ে গেল, বার্ষ্ণেয়ও তাঁর সঙ্গে গেল। বাহুকরপী নল রথশালায় রথ নিয়ে গিয়ে অশ্বদের যথাবিধি পরিচর্যা ক’রে রথেতেই বসলেন। দময়ন্তী নলকে না দেখে শোকার্তা হলেন, তিনি কেশিনী নামে এক দূতীকে বললেন, তুমি জেনে এস ওই হ্রস্ববাহু বিরূপ রথচালকটি কে?

 দময়ন্তীর উপদেশ অনুসারে কেশিনী নলের কাছে গিয়ে কুশলপ্রশ্ন ক’রে বললে, দময়ন্তী জানতে চান আপনারা অযোধ্যা থেকে কেন এখানে এসেছেন। আপনি কে, আপনাদের সঙ্গে যে তৃতীয় লোকটি এসেছে সেই বা কে? নল উত্তর দিলেন, দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবর হবে শুনে রাজা ঋতুপর্ণ এখানে এসেছেন। আমি অশ্ববিদ্যায় বিশারদ সেজন্য রাজা আমাকে সারথি করেছেন, আমি তাঁর আহারও প্রস্তুত করি। তৃতীয় লোকটির নাম বার্ষ্ণেয়, পূর্বে সে নলের সারথি ছিল, নল রাজ্যত্যাগ করার পর থেকে সে রাজা ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে আছে। কেশিনী বললে, বাহুক, নল কোথায় আছেন বার্ষ্ণেয় কি তা জানে? নল বললেন, সে বা অন্য কেউ নলের সংবাদ জানে না, তাঁর রূপ নষ্ট হয়েছে, তিনি আত্মগোপন ক’রে বিচরণ করছেন। কেশিনী বললে, যে ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তাঁর কথার উত্তরে আপনি যা বলেছিলেন দময়ন্তী পুনর্বার তা আপনার নিকট শুনতে চান। নল অশ্রুপপূর্ণনয়নে বাষ্পগদ্‌গদস্বরে পূর্ববৎ বললেন, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বস্ত্র হরণ করেছিল সেই মোহগ্রস্ত বিপদাপন্ন ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ করে চলে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না।

 কেশিনীর কাছে সমস্ত শুনে দময়ন্তী অনুমান করলেন, বাহুকই নল। তিনি কেশিনীকে বললেন, তুমি আবার বাহুকের কাছে গিয়ে তাঁর আচরণ ও কার্যের কৌশল লক্ষ্য কর। তিনি চাইলেও তাঁকে জল দিও না। কেশিনী পুনর্বার গেল এবং ফিরে এসে বললে, এমন শুদ্ধাচার মানুষ আমি কখনও দেখি নি। ইনি অনুচ্চ দ্বারে প্রবেশকালে নত হন না, দ্বারই তাঁর জন্য উচ্চ হয়ে যায়। ঋতুপর্ণের ভোজনের জন্য আমাদের রাজা বিবিধ পশুমাংস পাঠিয়েছেন, মাংস ধোবার জন্য কলসও সেখানে আছে। বাহুকের দৃষ্টিপাতে কলস জলপূর্ণ হয়ে গেল। মাংস ধুয়ে উননে চড়িয়ে বাহুক এক মুষ্টি তৃণ সূর্যকিরণে ধরলেন, তখনই তৃণ প্রজ্জ্বলিত হ’ল। তিনি অগ্নি স্পর্শ করলে দগ্ধ হন না, পুষ্প মর্দন করলে তা বিকৃত হয় না, আরও সুগন্ধ ও বিকশিত হয়। দময়ন্তী বললেন, কেশিনী, তুমি আবার যাও, তাঁকে না জানিয়ে তাঁর রাঁধা মাংস কিছু নিয়ে এস। কেশিনী মাংস আনলে দময়ন্তী তা চেখে বুঝলেন যে নলই তা রেঁধেছেন। তখন তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে কেশিনীর সঙ্গে বাহুকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নল ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার পর কোশনীকে বললেন, এই বালক-বালিকা আমার পুত্র-কন্যার সদৃশ সেজন্য আমি কাঁদছি। ভদ্রে, আমরা অন্য দেশের অতিথি, তুমি বার বার এলে লোকে দোষ দেবে, অতএব তুমি যাও।

 দময়ন্তী তাঁর মাতাকে বললেন, আমি বহু পরীক্ষায় বুঝেছি যে বাহুকই নল, কেবল তাঁর রূপের জন্য আমার সংশয় আছে। এখন আমি নিজেই তাঁকে দেখতে চাই, আপনি পিতাকে জানিয়ে বা না জানিয়ে আমাকে অনুমতি দিন। পিতা মাতার সম্মতিক্রমে দময়ন্তী নলকে তাঁর গৃহে আনালেন। কাষায়বসনা জটাধারিণী মলিনাঙ্গী দময়ন্তী সরোদনে বললেন, বাহুক, নিদ্রিত পত্নীকে বনে পরিত্যাগ ক’রে চ’লে গেছেন এমন কোনও ধর্মজ্ঞ পুরুষকে জান কি? পুণ্যশ্লোক নল ভিন্ন আর কে সন্তানবতী পতিব্রতা ভার্যাকে বিনা দোষে ত্যাগ করতে পারে? নল বললেন, কল্যাণী, যার জন্য আমার রাজ্য নষ্ট হয়েছে সেই কলির প্রভাবেই আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম। তোমার অভিশাপে দগ্ধ হয়ে কলি আমার দেহে বাস করছিল, এখন আমি তাকে জয় করেছি, সেই পাপ দূর হয়েছে। কিন্তু তুমি দ্বিতীয় পতি বরণে প্রবৃত্ত হয়েছ কেন? দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে কম্পিতদেহে বললেন, নিষধরাজ, আমার দোষ দিতে পার না, দেবগণকে বর্জন ক’রে আমি তোমাকেই বরণ করেছিলাম। তোমার অন্বেষণে আমি সর্বত্র লোক পাঠিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ পর্ণাদের মুখে তোমার বাক্য শুনেই তোমাকে আনাবার জন্য আমি স্বয়ংবর রূপ উপায় অবলম্বন করেছি। যদি আমি পাপ করে থাকি তবে বায়ু, সূর্য চন্দ্র আমার প্রাণ হরণ করুন।

 অন্তরীক্ষ থেকে বায়, বললেন, নল, এঁর কোনও পাপ নেই, আমরা তিন বৎসর এঁর সাক্ষী ও রক্ষী হয়ে আছি। তুমি ভিন্ন কেউ একদিনে শত যোজন পথ অতিক্রম করতে পারে না, তোমাকে আনাবার জন্যই ইনি অসাধারণ উপায় স্থির করেছিলেন। তখন পুষ্পেবৃষ্টি হ’ল, দেবদুন্দুভি বাজতে লাগল। নাগরাজ কর্কোটকের বস্ত্র পরিধান ক’রে নল তাঁর পূর্বরূপ ফিরে পেলেন, দময়ন্তী তাঁকে আলিঙ্গন ক’রে রোদন করতে লাগলেন। অর্ধসঞ্জাতশস্য ভূমি জল পেয়ে যেমন হয়, সেইরূপ দময়ন্তী ভর্তাকে পেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন।

১৯। নলের রাজ্যোদ্ধার

 পরদিন প্রভাতকালে নল রাজা সুসজ্জিত হয়ে দময়ন্তীর সঙ্গে শ্বশুর ভীম রাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন করলেন, ভীমও পরম আনন্দে নলকে পত্রের ন্যায় গ্রহণ করলেন। রাজধানী ধ্বজ পতাকা ও পুষ্পে অলংকৃত করা হ’ল, নগরবাসীরা হর্ষধ্বনি করতে লাগল। ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে নলকে বললেন, নিষধরাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি পত্নীর সঙ্গে পুনর্মিলিত হলেন। আমার গৃহে আপনার অজ্ঞাতবাসকালে যদি আমি কোনও অপরাধ করে থাকি তো ক্ষমা করুন। নল বললেন, মহারাজ, আপনি কিছুমাত্র অপরাধ করেন নি, আপনি পূর্বে আমার সখা ও আত্মীয় ছিলেন, এখন আরও প্রীতিভাজন হলেন। তার পর ঋতুপর্ণ নলের নিকট অশ্বহৃদয় শিক্ষা করে এবং তাঁকে অক্ষহৃদয় দান করে স্বরাজ্যে প্রস্থান করলেন।

 এক মাস পরে নল সসৈন্যে নিজ রাজ্যে প্রবেশ ক’রে পুষ্করকে বললেন, আমি বহু ধন উপার্জন করেছি, পুনর্বার দ্যূতক্রীড়া করব। আমার সমস্ত ধন ও দময়ন্তীকে পণ রাখছি, তুমি রাজ্য পণ রাখ। যদি দ্যূতক্রীড়ায় অসম্মত হও তবে আমার সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ কর। পুষ্কর সহাস্যে বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনি আবার এসেছেন, আমি আপনার ধন জয় ক’রে নেধ, সুন্দরী দময়ন্তী আমার সেবা করবেন। নলের ইচ্ছা হ’ল তিনি খড়্‌গাঘাতে পুষ্করের শিরশ্ছেদ করেন, কিন্তু কোধ সংবরণ ক’রে বললেন, এখন বাক্যব্যয়ে লাভ কি, আগে জয়ী হও তার পর ব’লো।

 এক পণেই নল পুষ্করের সর্বস্ব জয় করলেন। তিনি বললেন, মূর্খ, তুমি বৈদর্ভীকে পেলে না, নিজেই সপরিবারে তাঁর দাস হ’লে। আমার পূর্বের পরাজয় কলির প্রভাবে হয়েছিল, তোমার তাতে কর্তৃত্ব ছিল না। পরের দোষ তোমাতে আরোপ করব না, তুমি আমার ভ্রাতা, আমার রাজ্যের এক অংশ তোমাকে দিলাম। তোমার প্রতি আমার স্নেহ কখনও নষ্ট হবে না, তুমি শত বৎসর জীবিত থাক। এই ব’লে নল ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করলেন। পুণ্যশ্লোক নলকে অভিবাদন ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে পুষ্কর বললেন, মহারাজ, আপনার কীর্তি অক্ষয় হক, আপনি আমাকে প্রাণ ও রাজ্য দান করলেন, আপনি অযুত বৎসর জীবিত থাকুন। এক মাস পরে পুষ্কর হৃষ্টচিত্তে নিজ রাজধানীতে চলে গেলেন। অমাত্যগণ নগরবাসী ও জনপদবাসী সকলে আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে নলকে বললেন, মহারাজ, আমরা পরম সুখ লাভ করেছি; দেবগণ যেমন দেবরাজের পূজা করেন সেইরূপ আপনার পূজা করবার জন্য আমরা আবার আপনাকে পেয়েছি।


 নলোপাখ্যান শেষ ক’রে বৃহদশ্ব বললেন, যুধিষ্ঠির, নল রাজা দ্যূতক্রীড়ার ফলে ভার্যার সঙ্গে এইরূপ দুঃখভোগ করেছিলেন, পরে আবার সমৃদ্ধিলাভও করেছিলেন। কর্কোটক নাগ, নল-দময়ন্তী আর রাজর্ষি ঋতুপর্ণের ইতিহাস শুনলে কলির ভয় দূর হয়। তুমি আশ্বস্ত হও, বিষাদগ্রস্ত হয়ো না। তোমার ভয় আছে, আবার কেউ দ্যূতক্রীড়ায় তোমাকে আহ্বান করবে; এই ভয় আমি দূর করছি। আমি সমগ্র অক্ষহৃদয় জানি, তুমি তা শিক্ষা কর। এই ব’লে বৃহদশ্ব যুধিষ্ঠিরকে অক্ষহহৃদয় দান ক’রে তীর্থভ্রমণে চলে গেলেন।

  1. যে নারী পরগৃহে স্বাধীনভাবে থেকে শিল্পাদির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে।
  2. ‘হৃদয়’এর অর্থ গুপ্তবিদ্যা, অর্থাৎ অশ্বচালনায় বা অক্ষক্রীড়ায় অসাধারণ নৈপুণ্য।
  3. ১৪-পরিচ্ছেদে উক্ত নল-সারথি।
  4. ঋতুপর্ণের পূর্বসারথি।