মা/প্রথম খণ্ড/সাত

উইকিসংকলন থেকে

—সাত—

 পরদিন জানা গেলো, বুকিন, শ্যামোয়লোভ, শেমোভ এবং আরো পাঁচজন ধরা পড়েছে।—ফেদিয়া মেজিন এসে সগর্বে খবর দিয়ে গেলো, তার বাড়িও থানাতল্লাশ হয়েছে, তবে তাকে ধরেনি।

 মিনিট কয়েক পরে প্রতিবেশী রাইবিন এলেন। রাইবিন বৃদ্ধ, বহুদর্শী এবং তথাকথিত ধর্ম-পদ্ধতির ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। পেভেলের সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যেই তার আলাপ জমে উঠলো। বললেন, তোমরা মদ খাওনা, খারাপ কিছু করনা, তাই সবাই তোমাদের সন্দেহ করে। এই-ই দুনিয়ার হাল! কর্তারা বলেন, তোমরা নাস্তিক...গির্জায় যাওনা, যদিও আমিও তথৈবচ। তারপর...ঐ বে-আইনী ইস্তাহারগুলি, ওগুলোও তো তোমরা ছড়াও, নয়?

 হাঁ।

 মা ভয়ে ভয়ে তা’ ঢাকতে চান। তারা কেবল হাসে।

 রাইবিন বলে, বেশ সুচিন্তিত লেখা, লোককে মাতিয়ে তোলে। সবসুদ্ধ বারোটা বেরিয়েছে, নয়?

 হাঁ।

 সবগুলিই আমি পড়েছি।

 তারপর কথা প্রসঙ্গে পেভেল অগ্নিগর্ভ ভাষায় ব্যক্ত ক’রে যেতে লাগলো, ধর্ম, রাজা, রাষ্ট্র-শাসন, কারখানা, দেশ-বিদেশের মজুর জীবন সম্বন্ধে তার অভিমত। রাইবিন হেসে বললেন, তরুণ তুমি, লোকচরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা তোমার খুবই কম।

 পেভেল বললো, কে তরুণ, কে বৃদ্ধ, সে কথা ছেড়ে দিন কার চির ধারা সত্য, তাই দেখুন।

 অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রতারিত হয়েছি, এইতো? তা’ আমারও মত তাই। আমিও বলি, আমাদের ধর্ম মিথ্যা, ধর্ম আমাদের ক্ষতি করেছে।

 মা এই নাস্তিক্যবাদে শিউরে উঠে’ বলেন, ঈশ্বরের কথা যখন ওঠে একটু সতর্ক হ’য়ে কথা কয়ো।...যে কাজ তোমরা করছ, তাই তোমাদের জীবনে সান্ত্বনা জোগায়, কিন্তু আমার ঈশ্বর ছাড়া যে কিছুই নেই। তাঁকে কেড়ে নিলে আমি দুঃখে কষ্টে কার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াব!

 পেভেল বললো, তুমি আমাদের কথা বুঝলে না, মা। যে মঙ্গলময় দয়াল ঈশ্বর তোমার উপাস্য, আমি তাঁর কথা বলিনি; আমি বলেছি, সেই ঈশ্বরের কথা, যাকে দিয়ে পুরুতের দল আমাদের শাসিয়ে রাখে, যার দোহাই দিয়ে মুষ্টিমেয়ের অন্যায় ইচ্ছার সম্মুখে আমাদের মাথা নোরাতে বাধ্য করে।

 রাইবিন টেবিল চাপড়ে বলেন, ঠিক বলেছ। ওরা আমাদের ঈশ্বরকে ভেঙে চুরে ওদের কার্যোপযোগী ক’রে নিয়েছে। ওদের হাতে যা-কিছু সব আমাদের বিরুদ্ধে। গির্জ্জায় ঈশ্বরের আমদানি শুধু আমাদের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখার জন্য—এ ঈশ্বরকে বদলে ফেলতে হ’বে, মা,—

 মা ব্যথিত হ’য়ে চলে গেলেন সেখান থেকে।

 রাইবিন পেভেলকে বলেন, দেখছো, এর আরম্ভ কোথায়! মাথায় নয়, হৃদয়ে। আর হৃদয় এমন স্থান যে, ও ছাড়া আর কিছু জন্মায় না তাতে।

 পেভেল দৃঢ়কণ্ঠে বললো, যুক্তি—একমাত্র যুক্তিই মানুষকে মুক্তি এনে দেবে।

 রাইবিন বললেন, কিন্তু যুক্তি তো শক্তি দিতে পারে না—শক্তির একমাত্র উৎস—হৃদয়।

 পেভেল রাইবিনে এমনি ক’রে অনেক কথা কাটাকাটি চললো।

 শেষটা রাইবিন বললেন, আমাদের কইতে হ’বে শুধু বর্তমানের কথা···ভবিষ্যতে কি হবে তা আমাদের অজ্ঞাত। মানুষকে মুক্ত ক’রে দাও, তারপর সে নিজেই বেছে নেবে, তার পক্ষে কোন্‌টা ভালো। তাদের মগজে ঢের বিদ্যা আমরা ঢুঁসে দিয়েছি, এবার এর অবসান হ’ক,—মানুষকে তার নিজের পথ নিজেকে খুঁজে নিতে দাও। হয়তো তারা চাইবে সমস্ত কিছু বর্জন করতে—সমস্ত জীবন, সমস্ত জ্ঞান;—হয়তো তারা দেখবে সকল বন্দোবস্তই তাদের বিরুদ্ধে। তুমি শুধু তাদের হাতে বইগুলি দিয়ে দাও, তারপর নিশ্চিন্ত থাকতে পারো; সব প্রশ্নের উত্তর তারা নিজেরাই দেখে নিতে পারবে। তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দাও যে, ঘোড়ার লাগাম যত কষাণো হয়, তত সে ছোটে কম।

 মা ক্রমে ক্রমে এ সব শুনতে অভ্যস্ত হন।