মিবাররাজ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 নবাগত ধনুর্দ্ধারীর বেশভূষা ভীলদিগের মত কিন্তু তাহাকে দেখিতে ভীলদিগের মত নহে। তাহার বর্ণ গৌর, দেহ সুদীর্ঘ বলিষ্ঠ, প্রশস্ত বক্ষে ও জমাট মাংসপেশীযুক্ত হস্তে যেন বজ্রবল নিহিত, লৌহ গোলক তাহাতে পড়িলেও যেন চুরমার হইয়া যায়, অথচ সেই বিপুল বলশালী শরীরে ভীলদিগের মত একটা কঠোর কাঠিন্য ভাব নাই, তাহা সুঠাম সুগঠন। মাথার কাল কাল লম্বা লম্বা চুলের মধ্যে মুখখানি হাসি হাসি বালকের মত, ওষ্ঠাধরে এখনো শত্রুর রেখা পড়ে নাই, অথচ প্রশস্ত নয়নের দৃষ্টিতে এমন একটা প্রভুত্ব অঙ্কিত আছে, সমস্ত মূর্ত্তিতে এমন একটা বীরভাব ব্যাপ্ত হইয়া আছে—ষে তাহাকে দেখিলে বালক মনে হয় না, তাই আমরা তাহাকে যুবক বলি সম্বোধন করিয়াছি, কিন্তু বয়সে সে চতুর্দশ বর্ষের বালক মাত্র।

 ধনুকছিলাস্কন্ধ, বাণফলক-হস্ত, কৌপীনধারী যুবক—মুক্তপত্রে মুক্তমস্তকে মুক্তগাত্রে স্বর্ণ-কান্তিময় দেহের বীর- সৌন্দর্য্য প্রভাত-রৌদ্রে প্রকাশিত করিয়া যখন ভীলদিগের নিকট আসিয়া পোঁছিল—তখন—প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দেখিয়া কবির হৃদয়ে যেরূপ আনন্দ জন্মে যুবকের সেই সুবর্ণ-সুঠামবলিষ্ঠ মূর্ত্তি দেখিয়া তাহাদের সেইরূপ আনন্দ হইল। তাহাদের মনে হইল তাহার কান্তি পাইয়াই যেন প্রভাতটা এত উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। একজন কেবল সেরূপ আনন্দের ভাব প্রকাশ করিল না। বৃদ্ধ ভীল সস্নেহে অনন্দপূর্ণ-হৃদয়ে যুবকের পিঠে হাত দিয়া বলিলেন—“এতক্ষণে আইলি বাপুরে।” যুবক হাসিতে হাসিতে বলিল—“শেষ রাতে আমার দিদি শ্বশুরবাড়ী থেকে এসেছেন তাই আসিতে দেরী হয়ে গেল”—দিদি আসিয়াছেন—বলিতে যুবকের কত আনন্দ! বলিতে বলিতে সে আনন্দ যেন তাহার সর্বাঙ্গে ছাইয়া পড়িল; তাহার আনন্দ দেখিয়া ভীলেরাও মহা-আনন্দিত হইল-বলিল-“তবে চল রে চল-শিকারে চল—”

 সকলে মিলিয়া আনন্দ-রব করিতে করিতে শিকারে গমন করিল। অরণ্যে প্রবেশ করিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া, পাতা ছিঁড়িয়া, পাখী মারিয়া, পশু মারিয়া, ভয়বিহ্বল পলাতক পশুদিগের পশ্চাৎধাবিত হইয়া অরণ্য তোলপাড় করিতে লাগিল। এই সুপ্রভাতে অরণ্যবাসী নিরীহ পশু পক্ষীদিগের আকুল ক্রন্দন আর শিকারীদিগের পৈশাচিক উন্মত্ত চীৎকার ধ্বনি যতদুর গেল—বিদীর্ণ করিয়া তুলিল, কেবল মতি অরণ্য মহাকালের মত উদাস ভাবে এই সুখ দুঃখের প্রতি অবিচলিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, —তাহার প্রাণে সে হাসি কান্না বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিল না।