মিবার-গৌরব-কথা/ময় ভূখা হুঁ
দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন দুইবার মিবারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করিয়াছিলেন। প্রথম বারেই তিনি চিতোর এক প্রকার শ্মশানে পরিণত করিয়া যান, তথাপি আবার দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন। এবারে মিবারের রাণা লক্ষ্মণ সিংহ ঘোর চিন্তায় অভিভূত হইলেন। কিন্তু রাজপুত বীরগণ ভীত হইলেন না, অতুল সাহসের সহিত যুদ্ধের আয়োজন করিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে হিন্দু মুসলমানে ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। চিতোরের বীরগণ একে একে প্রায় সকলেই রণক্ষেত্রে শয়ন করিলেন তথাপি যুদ্ধের বিরাম নাই। রাণা অপার চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। চিতোর যে বীরশূন্য হইল। যাঁহাদের উৎসাহবাক্যে, যাঁহাদের চক্ষের অগ্নিতে রাণার অবসন্ন প্রাণে নূতন সাহস-নূতন বল আসিত, কোথায় সে সকল চিতোরের বীরগণ। বীরের রক্তে চিতোর ভূমি ভাসিয়া গেল, তবুত শত্রু শাসিত হইল না। দিন দিনই যবন সেনা চারিদিক গ্রাস করিয়া ফেলিল। মিবারের স্বাধীনতা আর বুঝি রক্ষা হয় না। পবিত্র চিতোর ভূমি যবন হস্তে কলঙ্কিত হইবে। বীর বাপ্পা রাওয়ের বংশের প্রদীপ চির-নির্ব্বাপিত হইবে। মিবারের রাণার নাম এবার ভারত ইতিহাস হইতে মুছিয়া যাইবে।” এই সকল বিষম চিন্তায় রাণা লক্ষণ সিংহ একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। তিনি আহার নিদ্রা একেবারে ত্যাগ করিলেন। দিবা রাত্র উন্মাদের ন্যায় থাকিতেন, “হায় কি হইবে! চিতোরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী না জানি কি অপরাধে আমার প্রতি বিমুখ হইলেন। চিতোরের বীরগণ অতুল বীরত্ব দেখাইয়া একে একে সকলে ধরাশায়ী হইলেন, যুদ্ধ করিতে আর কেহও রহিল না। তবুও দেবী প্রসন্ন হইলেন না। হায়! কি অপরাধ করিলাম। কোন পাপে চিতোর যবন হস্তে এত অবমাননা সহ্য করিতেছে।”
একদিন গভীর রাত্রে সমুদায় জগৎ যখন নিস্তব্ধ— কোন সাড়া শব্দ নাই—কেবল অদূরে মাঝে মাঝে প্রহরীর ডাক শুনা যাইতেছে, রাণা তখন দুই হস্তে মস্তক ধরিয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। মধ্যে মধ্যে হৃদয় ভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পাগলের ন্যায় উর্দ্ধদিকে চাহিতেছেন আবার তখনই দুইহস্তে মুখ লুকাইয়া ভাবিতেছেন। সম্মুখে সোনার প্রদীপ মিট্মিট করিয়া জ্বলিতেছে। এমন সময় সহসা রাণা চক্ষু দুটী বিস্ফারিত করিয়া কান পাতিয়া ব্যগ্রতার সহিত চাহিয়া দেখিলেন ও শুনিলেন, যেন অদূরে নিশার নিস্তব্বতা ভেদ করিয়া তারস্বরে কে বলিয়া উঠিল “ময় ভূখা হুঁ।” আবার কাণ পাতিলেন আবার সেই রব শুনিলেন। এ কে! এ কে! চিতোরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী? দেখিতে দেখিতে দেবী তাঁহার সম্মুখে আবির্ভূতা হইলেন। রাণা গলবস্ত্র হইয়া চরণে লুটায়া পড়িলেন, “মাতঃ, কিসের ক্ষুধা তোমার! এত বীরের রক্তে তোমার ক্ষুধা গেল না? জীবন আহুতি দিতে আর কে বাকী আছে? কি অপরাধে রাজপুতের বংশ নির্ম্মূল হইবে?” দেবী ধীর গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “চিতোরের জন্য রাজ মুকুটধারী দ্বাদশটী রাজকুমার রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জ্জন না দিলে আমি প্রসন্ন হইব না। চিতোর স্বাধীনতা হারাইবে।”— এই কথা শুনিয়াই রাণা মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। পর দিন অমাত্যগণকে ডাকিয়া দেবীর আবির্ভাবের কথা বলিলেন। তাঁহারা বিশ্বাস করিলেন না। পরদিন আবার দেবী ঐ প্রকারে দেখা দিয়া বলিলেন, “প্রতিদিন এক একটী রাজকুমার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, তিন দিন রাজ্য ভোগের পর, চতুর্থ দিবসে রণক্ষেত্রে প্রাণ দিবে, এইরূপে বারটী রাজ কুমার প্রাণ উৎসর্গ করিলেই চিতোরের মঙ্গল হইবে!—তবেই আমার ক্ষুধা যাইবে, নচেৎ নহে! এই বলিয়া দেবী অন্তর্ধান হইলেন। রাণা শুনিয়া উন্মাদ প্রায় হইলেন। রাণা লক্ষ্মণ সিংহের দ্বাদশটী পুত্র ছিল। ভাবিলেন, সকলেই যদি রণক্ষেত্রে প্রাণ দেয়, বাপ্পা রাওয়ের বংশে বাতী দিতে কে আর থাকিবে? কিন্তু রাজকুমারেরা দেবীর কথা শুনিয়া উৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, “পিতঃ! শোক করিবেন না, তুচ্ছ প্রাণ দানে যদি দেশের স্বাধীনতা রক্ষা হয়, সৌভাগ্য আমাদের। দেবীর যদি ইহাই বাসনা হয়, অচিরে ইহা পূর্ণ হইবে।” জ্যেষ্ঠ পুত্র অরিসিংহের রাজ্যাভিষেক হইল। তিন দিন রাজ্যভোগের পর চতুর্থ দিবসে তিনি পিতার চরণধুলি লইয়া প্রসন্ন মনে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করিলেন, আর ফিরিলেন না। দ্বিতীয় পুত্র অজয় সিংহ পিতার পরম আদরের ধন। রাণা কিছুতেই তাঁহাকে প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে দিলেন না। আর দশজন রাজকুমার রাজমুকুট ধারণ করিয়া একে একে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জ্জন দিলেন। রাজপুত রমণীগণ জলন্ত চিতায় শয়ন করিলেন। চিতোর ধ্বংস হইল। অজয় সিংহ দীনভাবে কৈলবারায় বাস করিয়া চিতোর স্বাধীন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন বটে কিন্তু সক্ষম হন নাই। অরি সিংহের জ্যেষ্ঠপুত্র মহাবীর হামির যবন হস্ত হইতে চিতোর উদ্ধার করিয়াছিলেন।