লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/বিচ্ছেদ
একদিন সুরেশ বাজার হইতে নিজ প্রয়োজনীয় কতকগুলি দ্রব্য ক্রয় করিয়া আনিলেন। এইরূপ দ্রব্যাদি আনিলে উক্ত জারমান বালিকা তাহার দ্রব্যাদি লইয়া তাহার বাক্সে গুছাইয়া রাখিয়া দিতেন। অদ্যও ইনি সুরেশের দ্রব্যাদি এক এক করিয়া কাগজের মোড়ক হইতে খুলিতেছিলেন। একটী দ্রব্য একখানি পুরাতন জারমান সংবাদপত্রে জড়িত ছিল। নিজ দেশের সংবাদ পত্রই হউক বা যে কারণেই হউক বালিকার সৃষ্টি সেই কাগজে আকৃষ্ট হইল। তিনি কাগজখানি তুলিয়া লইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন, ক্রমে তাহার দৃষ্টি একটা বিজ্ঞাপনে পডিল। বিজ্ঞাপনটীতে মৃত্যু শয্যায় শায়িতা জননী নিরুদ্দেশ কন্যাকে সত্বর তাঁহার সহিত মৃত্যুকালে একবার দেখা করিবার জন্য কাতর কণ্ঠে অনুনয় করিতেছেন। বিজ্ঞাপনটী দেখিয়া বালিকার দুই চক্ষু হইতে দরবিগলিত ধারে নয়নাশ্রু বলিল। সুরেশ অন্যদিকে চাহিয়া ছিলেন, সহসা ফিয়িয়া বালিকাকে কাঁদিতে দেখিয়া তিনি আশ্চর্য্যান্বিত ও ব্যথিত হইলে, তিনি সাদরে বালিকার হস্ত ধারণ করিয়া সস্নেহে সপ্রেমে তাঁহার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার প্রশ্ন বালিকা শোকে আরও অভিভূত হইয়া পড়িল, তাহার হস্তে কাগজখানি দিয়া তাহার বুকে মুখ লুকাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সুরেশ বালিকার নিকটই কিছু কিছু জারমান ও ফ্রেঞ্চ শিক্ষা করিয়াছিলেন,—মূতরাং তিনি পাঠ করিয়া বিজ্ঞাপনের মর্ম্ম এক রূপ জ্ঞাত হইতে পারিলেন। তিনি বুঝিলেন যে ৰালিকার সদ্বংশে জন্ম; বাল্যকালে কেবলমাত্র চতুর্দশ বৎসর বয়সে সারকাস শিক্ষা করিবার জন্য ইনি গৃহ হইতে পলায়ন কবিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার পলায়নের পূর্বেই তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়, এখন তাঁহার মাতা মৃত্যুশয্যায় শায়িতা! মৃত্যুশয্যায় একবার কন্যাকে দেখিবার জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়াছেন। নিরুদ্দেশ কন্যা কোথায় তিনি তাহা জানেন না, তাই কাতর কণ্ঠে সম্বাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়াছেন। কন্যাও এ সময়ে মাতাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইলেন।
পরদিবস তিনি স্বদেশে প্রত্যাগমনের জন্য প্রস্তুত হইয়া সকলের নিকট বিদায় লইলেন। সুরেশ তাহাকে লণ্ডন পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিতে চলিলেন। লণ্ডন বন্দরে বালিকা একখানি ভাল জাহাজে উঠিয়া স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন। জাহাজে সুয়েশকে বিদায় দিবার সময় তিনি তাঁহার হৃদয়ভাব আর লুকাইয়া রাখিতে পারিলেন না। তিনি যে সুরেশের নিকট তাঁহার হৃদয় প্রাণ সমস্তই বিসর্জ্জন দিয়াছেন তাহা প্রকাশ্যভাবে বলিলেন। শুনিয়া সুরেশের প্রাণ হর্ষ-বিষাদে পূর্ণ হইল, তিনি সজল নয়নে সাদরে বালিকার নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন, বলিলেন, “তোমার আমার আকাশ পাতাল প্রভেদ, আমাদের বিবাহের সম্ভাবনা নাই। আমাকে ভুলিয়া যাও, যদি পারি, আমিও ভুলিবার চেষ্টা করিব।”