লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/সারকাসে

উইকিসংকলন থেকে
অষ্টবিংশতি পরিচ্ছেদ।



সারকাসে।


 প্রথম রাত্রির পর সুরেশ ইংলণ্ডের নানা সহরে দর্শকমণ্ডলীয় সম্মুখে উপস্থিত হইয়া নানা ক্রীড়া দেখাইতে লাগিলেন। সারকাস ক্রীড়ক বলিয়া খ্যাতি লাভ তাহার হৃদয়ের ঐকান্তিক বাসনা; সারকাসক্রীড়ক বলিয়া যাহাতে তিনি জগতে অদ্বিতীয় হইতে পারেন, তাহাই তাঁহার জীবনের ব্রত হইল। যে কোন বিষয়েই হউক না কেন প্রাণপণ চেষ্টা পাইলে সিদ্ধ মনোরথ হওয়া বিচিত্র নহে। বিশেষতঃ সুরেশ চিরকালই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন,—যখন যে বিষয়ে মন নিবেশ করিতেন, যতক্ষণ না তাহাতে সিদ্ধি লাভ করিতেন, ততক্ষণ তাহা ছাডিছন না। এক্ষণে সরকাসে প্রবিষ্ট হইয়া যাহাতে প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারেন তাহার জন্য যত্ন বা পরিশ্রমের ত্রুটি করিলেন না। দিবসের অধিকাংশ সময়ই আপন ব্যবসার দক্ষতা লাভ কৰিব জন্য তাহার অনুশীলন করিতেন,—কাজেই দেখিতে দেখিতে তিনি এক জন অতি সুদক্ষ ক্রীড়ক হইয়া উঠিলেন। দেশ দেশান্তরে যেখানে তাঁহাদের ক্রীড়া হইতে লাগিল, সেই সেই স্থানেই তাঁহার খ্যাতিও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল,—ক্রমে তারতবাসী সারকাসওয়ালার নাম চারিদিকেই বাপ্ত হইল।

 সারকাসে প্রবেশ করিয়া সময় পাইলেই তিনি নানা পুস্তকাদি পাঠ করিতেন কিন্তু অনেক সময়ে তাহার সহ-সারকাসক্রীড়কগণ তাহার পড়া শুনার বিশেষ ব্যাঘাত দিত। বিশেযতঃ তাঁহাদের দলে যে কয়েকটী বালিকা ছিল, তাহারা তাহাকে বড়ই জ্বালাতন করিত;—তাঁহার হাতে বই দেখিলেই কাড়িয়া লইত,—তাঁহাকে পড়িতে দেখিলে তাহার নিকট আসিয়া হাসিত, তাহাকে হাসাইত, কিছুতেই পড়িতে দিত না। দলের অধিকাংশ যুবক যুবতীই সর্বদা আমোদ প্রমোদে থাকিতে ভালবাসিত, তাহাদের নিকট আমোদ প্রমোদই জীবনের সারব্রত ছিল; সময় ও সুবিধা পাইলেই হাসিতামাসা খেলা ধূলায় সময় কাটাইত,—ইহারা সুরেশকেও দলে লইবার জন্য ব্যগ্র হইল,—তাঁহাকে পড়াশুনা করতে দেখিলে নিকটে আসিয়া ব্যাঘাত ঘাটাইত।

 এইরূপে সারকাস দলে সুরেশের দিন কাটিতে লাগিল। এ দলের সহিত তিনি ইংলণ্ডের নানা শহরে ভ্রমণ করিলেন,—কিন্তু তিনি স্বদেশকে একেবারে ভুলেন নাই,—আত্মীয় স্বজনের নাম তাহার হৃদয় হইতে একেবারে মিলুপ্ত হইয়া যায় নাই। সাহেবদলে মিশিয়া পূরা সাহেব হইয়া তিনি তাহার স্বজাতিকে ভুলেন নাই। তিনি বরাবরই নিয়মিতরূপে তাঁহার খুল্লতাত কৈলাসবাবুকে পত্র লিখিতেন। যখন যেখানে যাইতেন, যাহা করিতেন, যে তাবে থাকিতেন, সকলই তাঁহাকে লিখিয়া পাঠাইতেন। স্নেহময়ী জননীর জন্য তিনি সর্ব্বদাই হৃদয়ে ব্যথা পাই-

তেন,—প্রত্যেক পত্রেই মাকে প্রণাম জানাইতেন,—পত্রের অধিকাংশই মায়ের কথার পূর্ণ থাকিত। কখন কখন যে তাহার প্রাণ দেশে ফিরিবার জন্য ব্যাকুল হইত,—আতমীয় স্বজনকে দেখিবার জন্য উৎসুক হইত, কখন কখন তাহার হৃদয় মায়ের জন্য কাঁদিয়া উঠিত, তাঁহার এই সময়ের পত্র পাঠ করিলে বেশ বুঝিতে পারা যায়। তাঁহার কয়েকখানি পত্র পরিশিষ্টরূপে এই পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হইল।

 সুরেশ পূর্ব্বে বিদেশে যত কষ্ট পাইয়াছিলেন, এক্ষণে সেই রূপ সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। এক্ষণে তাহার আহাবিহারের কোনই কষ্ট নাই;—সপ্তাহে সপ্তাহে ১৫/২০ শিলিং উপরন্তু। পাইতেছেন; তাঁহার পোষাক পরিচ্ছদ ভাল হইয়াছে, তিনি এক্ষণে ভদ্রসমাজে ভদ্রভাবে মিশিতে পারিয়াছেন এইরূপে তিনি সুখে স্বচ্ছন্দে মান সম্ভ্রমে থাকিয়া ক্রমে খ্যাতি লাভ করিতেছিলেন।

 এক্ষণে তিনি আর বালক নাই-যৌবনে উপনীত হইয়াছেন। যৌবন-সুলভ ভাবাবেশে তাহার দেহ মন সমস্তই উৎফুল্ল হইয়াছে,—তাঁহার হৃদয়ে তাঁহার অজ্ঞাতসারেই প্রেম দেখা দিয়াছে। সারকাসদলে কয়েকটী বালিকা ছিল, ইহার মধ্যে একটী জারমান-জারমানি দেশে জন্ম।—তবে এই বালিকা বা যুবতী জারমান হইলেও ঠিক ইংরাজের ন্যায় কথা বলিতে পারিতেন। ইনি ইহার গত জীবনের বিষয় কাহাকেও কিছু বলিতেন না,—ইহার পিতা মাতা বা গৃহের কথা কেহ জানিত না, ইনিও কাহাকে কিছু এ সম্বন্ধে বলিতেন না। কেহ এ সম্বন্ধে কথা তুলিলে ইনি বিলক্ষণ বিরক্ত হইতেন। ভ্রুকুটি করিতেন। ইহার প্রকৃতি বড় গম্ভীর ছিল-ইহার সেই গাম্ভীর্য্যে দলের সকলে ইহাকে ভর করিত,—মান্য করিত। দলের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ ঘটিলে ইনি উপস্থিত হইয়া নিয়স্ত হইতে আজ্ঞা করিলে তখনই সকল মিটয়া যাইত,—ইহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে কাহারও সাহস কুলাইত না।

 অন্যায় বালিকাগণ অপেক্ষা শিক্ষায় ও বংশমর্য্যাদায় যে ইনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইত;—দেখিতে তাহাদের অপেক্ষা বিলক্ষণ সুন্দরীও ছিলেন। বিশেষতঃ ইহার চুল ঘন কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার সুরেশ ইহাকে বড়ই সুন্দরী দেখিতেন। ইহার ভালবাসা পাইবার জন্য দলের অনেকেই লালয়িত হইয়াছিল। বাহিরের দর্শকগণের মধ্যেও অনেকে ইহাঁর জন্য পাগল হইয়াছিল,—কিন্তু ইনি কাহাকেই কোনরূপে উৎসাহিত কয়িতেন না,—ইহার গম্ভীরভাবে ভীত হইয়া ইহার সহিত কোন রূপ প্রেমালাপ করিতে কেহও সাহস পাইত না। কিন্তু ইহার প্রাণ যে সুরেশের দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। ইনি প্রকাশ্যভাবে সকলের সম্মুখে অন্যান্যের ন্যয় সুরেশের সহিত বিশেষ গাম্ভীর্য্যের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতেন। অন্যান্যকে যে রূপ দেখিতেন, সুরেশকেও তেমনই দেখিতেন;—সুরেশের প্রতি যে ইহার মন আকৃষ্ট হইয়া ছিল তাহা কেহই জানিতে পারিত না। তবে যখন ইনি ঘটনা ক্রমে সুরেশের সহিত একাকিনী একত্র হইয়া পড়িতেন, তখন ইহার গাম্ভীর্য্য ভাব লোপ পাইত; সুরেশকে প্রেমের চক্ষে দেখিতেন। তাঁহার সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে বিশেষ আমোদ পাইতেন, পড়াশুনায় তাঁহাকে উৎসাহিত করিতেন, তাঁহার গত জীবনের সমস্ত কথা শুনিবার জযন্য কৌতূহল প্রকাশ করিতেন। তিনি মনোভাব গোপন করিবার চেষ্টা করিলেও সময় সময় পারিতেন না। তাঁহার বদনে তাঁহার চক্ষে তাঁহার মনের ভাব প্রতিফলিত হইত। সুরেশ যে ইহা একেবারে বুঝিতেন না, তাহা নহে,—তবে তিনি তাঁহার মনকে এ কথা বিশ্বাস করিতে দিতেন না। তিনি মন হইতে সর্ব্বদাই রমণীর মূর্তি অন্তর্হিত করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিলেন; কিন্তু তিনি যতই চেষ্টা করেন, যতই হৃদয়কে দমন করিতে চাহিতেন, ততই হৃদরের বেগ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; তিনি কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।

 তাঁহার বিবাহের অবস্থা নহে, তিনি এক্ষণে যাহা উপর্জ্জন করেন তাহাতে মেম বিবাহ করা চলে না। বিবাহ করিয়া তাহাকে কোথায় লইয়া যাইবেন? ইংরাজী হিসাবে এক্ষণে তাঁহার বিবাহের বয়স হয় নাই,—এখন বিবাহের ইচ্ছাকে তাহার হৃদয়ে কোনমতেই স্থান দেওয়া কর্তব্য নহে। এই সকল ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি হৃদয় হইতে তাহার প্রেম দূর করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা পাইতে লাগিলেন, হৃদয়ের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, হদয়ের ভাব হৃদয়ে লুক্কাইত করিবার জন্য সর্বদা চেষ্টিত রহিলেন, অথাচ সময় সময় যখন তিনি রমণীর সহিত একত্রে একাকী থাকিতেন, তখন ভাব ভঙ্গীতে তাঁহার মনের ভাব প্রকাশ হইয়া পড়িত অন্য কেহ তাঁহাদের মনোভাব জানিতে না পারিলেও তাঁহাদের দুই জনের মনের ভাব দুইজনে বুঝিতে বাকি থাকিত না। এইরূপে উভয়ে উভয়ের অজ্ঞাতসারে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হইতেছিলেন।