বিষয়বস্তুতে চলুন

সচিত্র রেল অবতার/ডাক্তারবাবুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা

উইকিসংকলন থেকে

ডাক্তারবাবুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা।

 সতীশ চন্দ্র D.T.S আফিসের বারান্দায় একটা বেঞ্চির উপর বসে বসে ভাবছিল। সে আজ প্রায় এক সপ্তাহ বাড়ী থেকে এসেছে। বাড়ীতেই চিঠি গিছলো, যে সে টেলিগ্রাফ প্রোবেসনার নিযুক্ত হ’য়েছে—আসা মাত্র কাজে বাহাল হবে। কিন্তু তা’ হলো কৈ?—প্রথমেই বিপত্তি ডাক্তারী-পরীক্ষায়। রোগশূন্য, সম্পূর্ণ সুস্থ সবল হ’লেও, দেখতে ছিপছিপে ব’লে, ডাক্তার সাহেব, তা’কে ফেল করে বসে আছেন। ম্যালেরিয়ার দেশে তার বাড়ী বলে, বড় পিলে লিভার খুজে না পেলেও, ডাক্তার সাহেব কখনই বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি যে, সতীশের এ খুঁত গুলি নাই। তা ছাড়া, ডাক্তারের মতে সে “Colour blind”—অর্থাৎ রঙ্গ চিনতে পারে নাই। ডাক্তার যা’ বলেছেন তা অবশ্য ঠিক নয়। প্রথামত সতীশকে নানা রঙ্গের একরাশ উল (Wool) বার করে দেখান হয়েছিল—অনেক গুলোর নাম, ইংরাজীতে সতীশ ঠিক্ ঠিক্ বলতে পেরেছিল, কিন্তু কতক গুলোর ইংরাজী নাম ঠিক্ হয় নাই। সতীশ সাহেবকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল যে, সে রঙ্গ গুলো সবই চিন্তে পেরেছে—তার বাঙ্গলা নামও বল‍্তে পারে—তবে ইংরাজী নাম তার মনে পড়ছে না। সাহেব শুনেন নাই। এর পর সাহেবের মতে, সতীশের আর একটু দোষ হ’য়েছিল। সতীশকে রৌদ্রের দিকে মুখ করিয়ে, দাঁড় করিয়ে, দূর থেকে একটা ছোট ফোঁটা দেওয়া কার্ড, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যখন দেখান হচ্ছিল, তখন, সতীশ দুই একবার গুণে বলতে ভুল করেছিল, সাহেব সে সামান্য দোষটা দৃষ্টিহীনতার মধ্যে ধরে নিয়েছিলেন। কাজেই সতীশ ডাক্তারী সার্টিফিকেট পায় নাই।

 চাক‍্রীটা ফসকে যায় দেখে, নিরুপায় হয়ে, সে D.T.S. সাহেবের কাছে, ব্যাপার কি হয়েছে জানিয়ে, অন্য ডাক্তারের নিকট পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে ছিল। সাহেব আফিসে ছিলেন না ব’লে, এ পর্য্যন্ত কোন উত্তর পায় নাই। আজ সাহেব আফিসে এসেছেন, একটা কিছু হুকুম বেরুতে পারে বলে, সে আফিসে বসে তার প্রতীক্ষা ক’রছিল।

 * * * 

 বেলা ৪টার সময় আফিসের একটা চাপরাশী সতীশকে একখানা চিঠি দিলে—তা’তে লেখা আছে—সে বড় ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। বড় ডাক্তার সাহেব, তাঁর অন্য জায়গায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন।

 চিঠিখানা পেয়ে, সতীশ যে বিশেষ কিছু আশা পেলে— তা’ নয়। সে খুব জানত, ডাক্তার গুলো শেয়াল বিশেষ। যেমন সব শেয়ালের এক রা—ডাক্তারদের ও তেমনি। এক জনের যা’ মত, আর এক জনেরও তাই। সতীশকে যখন ফেল ক’রেছে, তখন যে সে আবার পাশ হবে, সেটা দুরাশা মাত্র।

 যা’ হোক, সকাল বেলায় সে বড় ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রলে। ডাক্তার সাহেব কিছু না বলে, তাকে অন্য একটা ষ্টেশনে, ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য চিঠি দিলেন।

 দুপুরের ট্রেণে সে সেই স্টেশনের দিকে রওনা হ’লো। স্টেশনে পৌঁছিয়েই, ডাক্তার খানার দিকে গেল। সেখান কার ডাক্তার একজন বাঙ্গালী বাবু। বয়স ৪৫৷৪৬ বৎসর। ডাক্তারীতে বেশ অভিজ্ঞতা ও সুনাম আছে। মুখখানা সর্ব্বদাই হাস্যোৎফুল্ল। ডাক্তার বাবুর প্রকৃতি সরল ও উদার।

 সতীশ প্রণাম করে চিঠি খানা দিতেই, তিনি তাকে যত্নের সহিত বস‍্তে বল্লেন। তারপর চিঠিখানা পড়ে, সতীশকে তার বাড়ী কোথায়, পড়া শুনা কতদূর হয়েছে, বাপ মা আছেন কিনা, বিবাহ হয়েছে কিনা, জায়গা জমি কিরূপ আছে ইত্যাদি খুঁটি নাটি অনেক কথাই জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে—সতীশ তার, বাড়ী-বর্দ্ধমান জেলায়, পড়া শুনায়—এণ্ট্রান্স পাশ, বাপ মা—বর্ত্তমান, এখনও অবিবাহিত, আর জায়গা জমি মধ্যবিত্ত গেরস্তর মত আছে জানালে, ডাক্তার বাবু ভারী প্রীত হ’লেন। তারপর বল্লেন—“আপনার পরীক্ষে ত করা যাবে, এখন আপনি এখানে এসে উঠেছেন কোথায়? চেনা শোনা কেউ আছে কি?

 সতীশ বল্লে—“আজ্ঞে, না। পরিচিত এখানে কেউ নেই, তবে আজকার রাতটা হোটেলে কাটিয়ে দেবো এখন।”

 ডাক্তার বাবু হেসে বল্লেন—“হোটেলে যেতে হবে না, আমার বাসাতেই থাকবেন, আহারাদিও হ’বে। এই প্রথম বিদেশে বেরিয়েছেন, কষ্ট করা তত অভ্যাস হয় নি। হোটেলে খাওয়া ত আছেই।”

 সতীশ সঙ্কুচিত হলেও তা’তেই স্বীকার হ’লো।

 পরীক্ষা কখন হবে জিজ্ঞাসা করাতে, ডাক্তার বাবু বল্লেন— “আজ আর নয়, কাল সকালেই হবে।”

 সতীশ, জায়গাটা কিরূপ দেখবার জন্য, বে’র হলো।

 সন্ধ্যা হবার একটু দেরী আছে। পথের মাঝে ডাক্তার। বাবুর সঙ্গে সতীশের দেখা হলো। ডাক্তার বাবু বল্লেন—“এ জায়গাটা ত’ আর সহর নয়—দেখবার তেমন কিছুই নাই। তবে এই খোলা মাঠটা আছে বলে, সকাল সন্ধ্যায় একটু বেশ বেড়াতে পারা যায়। আপনার যদি বেড়ান শেষ হয়ে থাকে, তবে আসুন, এক সঙ্গে বাসায় যাওয়া যাক।”

 রেল লাইনের ধার দিয়েই রাস্তা। যেতে যেতে ডাক্তার বাবু বল্লেন—“একটা গাড়ী আসচে বোধ হয়। সিগন্যালের পাখাটা কিন্তু ভাল করে পড়ে নাই—আলোটা এক রকম দেখা যাচ্ছে না—বোধ হয় গাড়ীটা দাঁড়িয়ে যাবে।”

 সতীশ সিগন্যালের দিকে চাইলে। তার পর বল্লে—“আজ্ঞে হাঁ, পাখাটা একবারেই ভাল রকম করে পড়েনি। আলোটা, কতকটা লাল, কতকটা সবুজ, আবার কতকটা সাদা দেখা যাচ্ছে। কেন—এক রকম আলো না হলে, গাড়ী দাঁড়িয়ে যায় নাকি?”

 ডাক্তার বাবু বল্লেন—“হাঁ, আলোটা শুধু সবুজ হওয়া দরকার।”

 পরে অন্য কথাবার্ত্তা বলতে বলতে, দুজনে বাসায় এসে পৌঁছুলেন।

 রাত্রে চব্য চু্য্য, লেহ্য, পেয় আহারের আয়োজন হয়েছিল। ডাক্তার বাবুর স্ত্রী নিজেই পাক করে ছিলেন। ডাক্তার বাবু নিজে খেতে ও লোককে খাওয়াতে জানেন। তিনি সতীশকে অসঙ্কোচে ও তৃপ্তির সঙ্গে খেতে দেখে, ভারী খুসি হ’লেন।

 একটি ভাল বিছানা সতীশকে ঘুমুতে দেওয়া হ’লো।

 * * * 

 সকাল হলে সতীশ খোলা মাঠের দিকে বে’র হলো। পাড়াগাঁয়ে-লোক—পাইখানা তত পচ্ছন্দ করে না। খোলা মাঠে শৌচাদি সারবে, আর খানিকটা বেড়িয়েও নেবে, সতীশ এরূপ মনে করে বের হ’য়েছিল।

 একটা ছোট নদীর ধারে শৌচাদি সারা হয়েছে, এখন দাঁতন করা চাই। মাঠে কতকগুলো বড় বড় আম ও বুনো গাছ ভিন্ন আর কিছু নাই। আম ডাল ভেঙ্গেই দাঁতন করা যাক্ মনে করে, জুতো খুলে, সতীশ একটা বড় আম গাছে উঠে পড়ল। গাছে উঠা, সাঁতার দেওয়া, কুস্তী করা, দৌড় ঝাঁপ, এ বিষয়ে সতীশ খুব পটু।

 যখন আম ডাল ভেঙ্গে, সতীশ গাছে বসেই দাঁতন করছে তখন দেখে, ডাক্তার বাবু গাছটার ভারী কাছে এসে পড়েছেন। গাছে চড়ে থাকাটা ভদ্রোচিত হবে না বলে, কিছু মাত্র চিন্তা না করে, দোতালার চেয়ে উঁচু একটা ডাল থেকে, ঝুপ্ করে নীচে লাফিয়ে পড়ল।

 ডাক্তার বাবু প্রায় গাছের তলায় এসে পড়েছিলেন। হেসে বল্লেন— “সতীশ বাবু গাছে উঠে করছিলেন কি?”

 সতীশবাবু একটু অপ্রতিভ হ’য়ে বল্লে—“আজ্ঞে দাঁতন খুঁজে পাচ্ছিলুম না, তাই গাছটায় উঠ‍্তে হয়েছিলো।”

 ডাক্তার বাবু বল্লেন, “বেশ, বেশ, সব রকমই জানা দরকার। পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা, সহরের ছেলেদের চেয়ে এ বিষয়ে খুব মজবুত।”

 তার পর ডাক্তার বাবু বেড়াতে চলে গেলেন।

 * * * 

 বেলা ৮টার সময় সতীশ পরীক্ষার জন্য ডাক্তার খানায়। গেল। ডাক্তার বাবু, তাকে কোন রকম পরীক্ষা না করেই, সার্টিফিকেট খানি তার হাতে দিলেন। সতীশের মুখের দিকে চেয়ে ডাক্তার বাবু বুঝ‍্তে পাল্লেন—সে বেশ একটু বিস্মিত হয়েছে।

 খানিক পরে, একটু হেসে ডাক্তার বাবু বল্লেন—“সতীশ বাবু, আপনি মনে করেছেন আমি আপনার উপর দয়া করে এই সাটিফিকেট খানা দিয়েছি—তা নয়। আমাদের মেডিক্যাল সায়ান্সে অনুসারে, স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করবার নানা রকম প্রণালী আছে ও তা’তে খুব সুক্ষা ভাবে দেহের বিষয় ধরা যায় বটে, কিন্তু তবুও তা সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। তারপরে ডাক্তার অনুসারে পরীক্ষার ও তারতম্য হ’য়ে থাকে। আপনারা কোম্পানীর কাজ করবেন, স্বাস্থ্যের হিসাবে আপনারা কর্ম্মক্ষম কিনা—দৃষ্টিশক্তি আছে কি না। —এই সব দেখবার জন্যই, আমাদের কাছে আপনাদিগকে পাঠান হয়। মোটামুটি হিসাবে আমাদের দেখা দরকার, কারণ—যখন আমরা বলতে পারি না— সাটিফিকেট দেবার পর মুহূর্ত্তে আপনাদের দেহের অবস্থা কি হতে পারে। আর এই যে আপনি ডাক্তার সাহেবের কাছে, রঙ্গ গুলার ইংরাজী নাম বল্‌তে পারেন নি। আপনি বলছেন ও আমিও বিশ্বাস করি, যে আপনি সমস্ত রঙ্গগুলোর ইংরাজী নাম না জানলেও, বাঙ্গালা নাম জানেন। কিন্তু সমস্ত রঙ্গগুলোর নাম কেই বা জানে, আর তা জানবারই বা প্রয়োজন কি? রঙ্গের বিষয়ে দৃষ্টি বিভ্রম হয় কি না, তা ধরতে বেশীক্ষণ লাগে না। আমি আপনাকে বেশী পরীক্ষা করি নাই ও তার জন্য যে আমার কর্তব্যের ত্রুটী হ’য়েছে এ আমি মনে করি না। আমি যখন দেখলুম আপনার মুখ খানি স্বাস্থ্যপূর্ণ, আপনি একটা উঁচু ডাল থেকে অনায়াসে লাফিয়ে পড়লেন—একটুকুও হাঁফালেন না—সহজ ভাবে আমার সঙ্গে কথা কইলেন, দূর থেকে সন্ধ্যার এই সময় সিগন্যালের লাল, সবুজ, সাদা, আলো দেখতে পেলেন, রাত্রে আমার বাসায় পর্যাপ্ত আহার করলেন, তখন আর আপনার স্বাস্থ্যের অভাব কি? আপনাকে আমি ন্যায় মতই সার্টিফিকেট খানি দিয়েছি, আপনার বিস্মিত হবার কিছুই কারণ নাই।”

 সতীশ কোন কথাই বলতে পারলে না। ডাক্তার বাবুর অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেখে, তার মনে হ’তে লাগল—সেই ছোকরা সাহেব ডাক্তার ও এই অভিজ্ঞ বাঙ্গালী ডাক্তার বাবুর মধ্যে কত প্রভেদ। এটি দলছাড়া লোক—না হলে সব শেয়ালেরই এক রা।

 আহারাদি সেরে, ডাক্তার বাবু ও তাঁর স্ত্রীকে ভক্তিভরে প্রণাম করে, সতীশচন্দ্র সার্টিফিকেট দাখিল করতে, স্মিতমুখে রওনা হলো।

সম্পূর্ণ।