সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/অন্ধকূপ-হত্যা

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

অন্ধকূপ-হত্যা।

 এখন আর কলিকাতার পুরাতন কেল্লার চিহ্নমাত্রও বর্ত্তমান নাই। সে কেল্লা পূর্ব্বপশ্চিমে দুইশত দশ গজ, দক্ষিণাংশে একশত ত্রিশ গজ, এবং উত্তরাংশে কেবলমাত্র একশত গজ পরিসর ছিল। চারিদিকে সুদৃঢ় প্রাচীর, চারি কোণে চারিটি বুরুজ, প্রত্যেক বুরুজে দশটি কামান, পূর্ব্বদিকের সুগঠিত সিংহদ্বারে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ত বদন ব্যাদান করিয়া, বৃটিশ-বণিকের অক্ষুন্ন অধ্যবসায়ের পরিচয় প্রদান করিত।[১] নবাব এব্রাহিম খাঁর শাসনশিথিলতার অবসর পাইয়া, সভাসিংহ এবং রহিম খাঁ যে সময়ে বর্দ্ধমানে স্বাধীন রাজ্য সংস্থাপন করিবার আয়োজন করিতে ছিলেন, সেই সময় চুঁচুড়ানিবাসী ওলন্দাজ এবং চন্দননগনিবাসী ফরাসী দিগের ন্যায় সুতানটী-নিবাসী ইংরাজ বণিকেরাও কলিকাতায় একটী ছোটখাট দুর্গ নির্ম্মাণ করেন।[২] কালক্রমে সেই দুর্গ “ফোর্ট উইলিয়ম” নামে পরিচিত হইয়া ইংরাজদিগের সর্ব্বপ্রধান আশ্রয়স্থান হইয়া উঠিয়া ছিল।

 এই নবজাত ইংরাজ-দুর্গের পশ্চিমপার্শ্বে ভাগীরথী-স্রোত অবিরাম গতিতে সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হইত; পূর্ব্বদিকে সিংহদ্বারের নিকট হইতে সরল সুপ্রশস্ত লালবাজারের রাজপথ বরাবর পূর্ব্বাভিমুখে বালিয়াঘাটা পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। নগররক্ষার আয়োজন শেষ হইলে, দুর্গরক্ষার জন্য ইংরাজের পূর্ব্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ—তিনদিকে তিনটি তোপমঞ্চ নির্মাণ করিয়া, তাহার উপর লক্ষ্যভেদী আগ্নেয়াস্ত্র পুঞ্জীকৃত করিয়াছিলেন। সকলেই ভাবিয়াছিলেন যে, সিরাজদ্দৌলা কোনক্রমে নগরপ্রবেশ করিতে পারিলেও, এই সকল তোপমঞ্চ বর্ত্তমান থাকিতে, কিছুতেই দুর্গপ্রবেশ করিতে পারিবেন না। বোধ হয়, সেই ভরসায় অনেকেই সাহস করিয়া দুর্গমধ্যে আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 যে সকল বীরপুঙ্গবগণ যুদ্ধের প্রথম উপক্রমেই নগরক্ষার আশায় জলাঞ্জলি দিয়া সর্ব্বপ্রযত্নে আত্মরক্ষা করিবার জন্য, ত্রাসকম্পিতকলেবরা ইংরাজ-মহিলার কণ্ঠলগ্ন হইয়া, দ্রুতপদে দুর্গাভ্যন্তর হইতে একে একে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আত্মকার্য্য সমর্থন করিবার জন্য উত্তরকালে অবলীলাক্রমে লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“দুর্গপ্রাচীর যেরূপ জরাজীর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে সাহস করিয়া দুর্গমধ্যে বাস করিলেই বা কি হইত? আর কোন কারণে না হউক, নিতান্ত অন্নাভাবেই পরাজয় স্বীকার করিতে হইত! গোলা, বারুদ এত অপ্রচুর যে, তাহাতে তিন দিনের অধিক আত্মরক্ষা করা সম্ভব হইত না। সত্য বটে, আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব ছিল না, কিন্তু তাহার অধিকাংশ কেবল চক্রহীন গতিহীন অবস্থায় ভগ্নকলেবরে প্রাচীরমূলে পড়িয়া থাকিত;—সেগুলি ব্যবহার করিবার উপায় ছিল না।[৩] কেল্লার অবস্থা সত্য সত্যই এরূপ শোচনীয় হইলে, তাঁহাদের আর অপরাধ কি? কিন্তু যাঁহাদের কেল্লা এরূপ জরাজীর্ণ, “রসদ” এরূপ অপ্রচুর, অস্ত্রশস্ত্র এরূপ অকর্মণ্য,—তাঁহারা যে কোন্ সাহসে সিরাজদ্দৌলার বিপুল সেনাতরঙ্গের সম্মুখে বুক বাঁধিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন, কেহই সে কথা মীমাংসা করিবার চেষ্টা করেন নাই!

 কলিকাতার দক্ষিণাংশে মহারাষ্ট্র-খাত সম্পূর্ণ হয় নাই; চারিদিকে যেরূপ বিজন বন, তাহাতে নবাব-সেনা হয় ত সে পথের সন্ধান জানিত না। সুতরাং তাহার নগরের উত্তরাংশে বরাহনগরে শিবিরসন্নিবেশ করিয়া বাগ বাজারের পথেই নগর-প্রবেশের আয়োজন করিতে লাগিল।

 ১৮ই জুন-প্রাতঃকালে নবাব-সেনা কামানে অগ্নিসংযোেগ করিল।[৪] ইংরাজ-সেনা সবিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে তাহাদিগের আক্রমণবেগ প্রতিহত করিবার জন্য জলস্থল বিকম্পিত করিয়া জাহাজ হইতে এবং পেয়িং নামক দুর্গপ্রাকার হইতে যুগপৎ গোলাবর্ষণ করিতেছিল; সুতরাং নবাবের সিপাহী-সেনা সহজে বাগবাজারের দিকে অগ্রসর হইতে পারিল না। অনেক চেষ্টায় খালের ধারের একটি ক্ষুদ্র ঝোপের মধ্যে কয়েকজন সিপাহী ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়াছিল; কিন্তু পিস্‌কার্ড নামক একজন ইংরাজসেনানী রজনীযোগে তাহাদিগকে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। ক্ষণিক উল্লাসে নির্ব্বাণোন্মুখ দীপশিখার ন্যায় ইংরাজপ্রতাপ চারিদিকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল![৫]

 উমাচরণের আহত জমাদার অলক্ষিতভাবে নগর হইতে পলায়ন করিয়া একেবারে নবাব-শিবিরে উপনীত হইলেন; এবং সিরাজদ্দৌলার নিকট আদ্যোপান্ত সকল কথা নিবেদন করিয়া দক্ষিণ এবং পূর্ব্বাঞ্চল হইতে নগরাক্রমণের সন্ধান প্রকাশ করিয়া দিলেন। রজনী প্রভাত হইবামাত্র উত্তরের কামানগর্জ্জন নীরব হইয়া গেল, পুর্ব্ব এবং দক্ষিণদিক হইতে যুগপৎ লৌহপিণ্ড ছুটিয়া আসিতে লাগিল। ইংরাজেরা তাড়াতাড়ি তোপমঞ্চে আরোহণ করিয়া নগরক্ষার জন্য কামানে অগ্নিসংযোগ করিতে ধাবিত হইলেন!

 লালবাজারের রাস্তার উপর যে পূর্ব্বতোপমঞ্চ নির্ম্মিত হইয়াছিল, তাহার কিয়দ্দূর সম্মুখেই “জেলখানা”। ইংরাজেরা তাহার উত্তর প্রাচীরে ছিদ্র ফুটাইয়া কয়েকটি কামান পাতিয়া রাখিয়াছিলেন, এবং লালবাজারের রাজপথে নবাব-সেনাদল নগরপ্রবেশ করিবামাত্র, জেলখানা ও পূর্ব্বতোপমঞ্চ হইতে যুগপৎ অনলবর্ষণ করিয়া শত্রুসেনার সর্বনাশ করিবেন ভাবিয়া কথঞ্চিৎ হৃষ্টান্তকরণেই যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হইতেছিলেন। কিন্তু নবাব-সেনা নির্ব্বোধের সরল রাজপথ বহিয়া তোপমঞ্চের সম্মুখ দিয়া অগ্রসর হইল না। তাহারা প্রহরিসেনাদলকে পরাজয় করিবামাত্র, উত্তর ও দক্ষিণদিকে সরিয়া পড়িতে লাগিল, এবং দেখিতে না দেখিতে ইংরাজদিগের তিনটি তোপমঞ্চই তিনদিক হইতে আক্রান্ত হইল। তখন আর নগর রক্ষা করা সম্ভব হইল না;—পূর্ব্বতোপমঞ্চের অধিনায়ক কাপ্তান ক্লেটন ও তাঁহার সহকারী হলওয়েল সাহেব দুর্গমধ্যে পলায়ন করিবামাত্র, চারিদিকে নবাব-সেনা অধিকার বিস্তার করিবার অবসর প্রাপ্ত হইল। তাহারা ইংরাজের তোপমঞ্চে আরোহণ করিয়া, ইংরাজের অস্ত্রসাহায্যেই দুর্গবাসী ইংরাজদিগের উপরে প্রচণ্ডবেগে গোলাবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। বীরপদভরে কলিকাতা সত্য সত্যই টলমল করিয়া উঠিল।

 দুর্গমূলে ভাগীরথীগর্ভে কতকগুলি ডিঙ্গী নৌকা এবং একখানি সুবৃহৎ জাহাজ প্রস্তুত ছিল। সায়ংকালে মহিলাদিগকে সেই জাহাজে পাঠাইয়া দিবার ব্যবস্থা হইল। ম্যানিংহাম এবং ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড মহিলাদিগের শরীররক্ষার্থ জাহাজ পর্য্যন্ত গমন করিতে অগ্রসর হইলেন; তখন সকলে মিলিয়া ধীরে ধীরে দুর্গাভ্যন্তর হইতে সায়াহ্নের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাগীরথীতীরে সমবেত হইতে লাগিলেন। মহিলামণ্ডলী জাহাজে আরোহণ করিলেন, কিন্তু ম্যানিংহাম এবং ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড আর জাহাজ হইতে অবতরণ করিতে, সম্মত হইলেন না। দুর্গরক্ষা করা নিতান্ত অসম্ভর বলিয়া অনেক সময়ে অনেক বীরপুরুষ দুগত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন;—তাহাতে লজ্জিত হইবার কারণ নাই। কিন্তু ম্যানিংহাম এবং ফাঙ্কল্যাণ্ড যেরূপভাবে দুর্গত্যাগ করিয়া রমণীমণ্ডলীর সহিত জাহাজে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাহাতে ইংরাজ ইতিহাস লেখকেরাও লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিয়াছেন![৬]

 যাঁহারা দুর্গমধ্যে আশ্রয়গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের দুর্গতির অবধি রহিল না। সকলেই উপদেশ দিবার জন্য লালায়িত, কেহই উপদেশপালনের জন্য প্রস্তুত নহেন![৭] বাহিরে নবাব-সেনার উন্মত্ত আস্ফালন, দুর্গমধ্যে ইংরাজমণ্ডলীতে তুমুল কোলাহল;—ফিরিঙ্গীদের আর্তনাদ, সৈনিকদিগের আত্মকলহ, সেনাপতিদিগের মতিভ্রম, নানাকারণে দুর্গমধ্যে শাসনক্ষমতা একেবারে শিথিল হইয়া পড়িল!

 রাত্রি দুই প্রহরের সময়ে নবাবসেনা দুর্গপ্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইল। তাহা দেখিয়া দুর্গরক্ষার জন্য অগ্রসর হওয়া দূরে থাকুক, সকলেই নিজ নিজ প্রাণরক্ষার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন;—সেনাপতি উপর্য্যুপরি তিনবার দামামাধ্বনি করিয়া সকলকেই আহ্বান করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু প্রহরিগণ ভিন্ন আর কেহ সে আহ্বানে কর্ণপাত করিলেন না![৮] দুর্গবাসিগণ সশস্ত্রদেহে জাগরিত রহিয়াছেন মনে করিয়া, নবাব-সেনা শিবিরে প্রস্থান করিল; কিন্তু সে রজনীতে ইংরাজদুর্গে কেহ আর নিদ্রালাভের অবসর পাইলেন না।

 রজনী দুই ঘটিকার সময়ে সামরিক সভার অধিবেশন হইল। নিম্নশ্রেণীর সেনাদল ভিন্ন আর আর সকলেই সে সভায় উপনীত হইলেন। দুই ঘণ্টা তর্ক বিতর্কের পর স্থির হইল যে, “আর দুর্গরক্ষার জন্য পণ্ডশ্রম করা অনাবশ্যক, তহবিল পত্র লইয়া পলায়ন করাই সুপরামর্শ![৯] কিন্তু কখন পলায়ন করিতে হইবে, কিভাবে পলায়ন করিতে হইবে, সে সকল কথার কিছুমাত্র মীমাংসা হইতে পারিল না।[১০]

 নদীতীরে যে সকল ডিঙ্গী নৌকা বাঁধা ছিল, তাহার অনেকগুলিই রাতারাতি চলিয়া গিয়াছিল; পর্তুগীজ-রমণী ও বালক বালিকাদিগকে জাহাজে উঠাইবার জন্য প্রভাতে গুপ্তদ্বার উন্মোচন করিবামাত্র, ভাগীরথীতীরে মহাকলরব উপস্থিত হইল। সে কলরবে কেহ কাহারও কথায় কর্ণপাত করিবার অবসর পাইল না; সকলেই সর্ব্বাগ্রে জাহাজে উঠিয়া পলায়ন করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ইহাতে যাহা হইবার তাহাই হইল;—কেহ কেহ ডিঙ্গী উল্টাইয়া জলমগ্ন হইল, কেহ কেহ নবাব-শিবিরের তীরন্দাজদিগের হাতে দেহত্যাগ করিল, কেহ বা কায়ক্লেশে জাহাজে উঠিবামাত্র, নোঙ্গর তুলিয়া জাহাজখানি অবলীলাক্রমে ভাসিয়া চলিল। নবাব-সেনা তাহার উপর অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়া পলায়িত জাহাজের গতিশক্তি বর্দ্ধিত করিতে লাগিল। যাহারা পলায়নের অবসর না পাইয়া দুর্গমধ্যে অবরুদ্ধ রহিলেন তাহারা তাড়াতাড়ি দ্বাররোধ করিয়া পলায়িত বন্ধুদিগের নামোল্লেখ করিয়া নানারূপে হৃদয়-বেদনা প্রকাশ করিতে লাগিলেন।[১১]

 যাঁহারা এইরূপে অকস্মাৎ দুর্গত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন, তাঁহাদের মধ্যে গভর্ণর ড্রেক, সেনাপতি মিন্‌চিন্, কাপ্তান গ্রাণ্ট এবং মিঃ ম্যাকেটের নাম ইতিহাসে স্থানলাভ করিয়াছে![১২] উত্তরকালে ইতিহাস লিখিবার সময়ে অনেকে অনেকরূপ “কৈফিয়তের” সৃষ্টি করিয়া ইঁহাদের কলঙ্কমোচনের চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। ষ্টুয়ার্ট লিখিয়া গিয়াছেন যে, “গবর্ণর ড্রেক অতুল সাহসে দুর্গপ্রাচীরের উপর পাদচালনা করিয়া দুর্গরক্ষা করিতে ভীত হন নাই; কিন্তু যখন শুনিলেন যে, আর দুর্গার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, বারুদ ফুরাইয়া গিয়াছে, যাহা আছে তাহাও ভিজিয়া গিয়াছে,তখন নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়াই পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন!” এই কৈফিয়ত কত দূর সত্য তাহা বিচার করা নিষ্প্রয়োজন। যাঁহারা দুর্গমধ্যে অবরুদ্ধ রহিলেন, তাঁহারা হলওয়েল সাহেবকে সেনাপতি নির্ব্বাচন করিয়া সেই “ভিজা বারুদ” লইয়াই কেমন অতুল সাহসে দুই দিন পর্য্যন্ত নবাবসেনার গতিরোধ করিয়া অবশেষে দৈববিড়ম্বনায় কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন, সে কথা ইংরাজের ইতিহাসেই প্রকাশিত রহিয়াছে!

 হলওয়েল আর কি করিলেন! বাগবাজারের নিকটে যে একখানি যুদ্ধজাহাজ অপেক্ষা করিতেছিল, সেইখানি নিকটে আনিবার জন্য দুর্গ প্রাচীর হইতে সঙ্কেত করিতে লাগিলেন। নাবিকদিগের অনবধানতায় সে জাহাজ খুলিতে না খুলিতেই চড়ায় আটকাইয়া গেল, নবাবসেনার গুলিবর্ষণে নাবিকগণ ভাগীরথী সন্তরণ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। তখন অনেকে ভাবিলেন যে, অকস্মাৎ মতিভ্রান্ত হইয়া মহামতি ড্রেক সাহেব সময়ের উত্তেজনায় অগ্রপশ্চাৎ বিচার না করিয়া সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিয়াছেন; কিন্তু তিনি হয়ত নিজেই নিজের মতি ভ্রম বুঝিতে পারিয়া, সহকারিগণের উদ্ধার-কামনায় আবার জাহাজ লইয়া দুর্গদ্বারে উপনীত হইবেন। আশা কুহকিনী! ড্রেক সাহেব নিজে নিজে জাহাজ লইয়া আসিলেন না; দুর্গবাসিদিগের নানারূপ সঙ্কেতপূর্ণ কাতর-নিবেদন অবগত হইয়াও ফিরিয়া চাহিলেন না।[১৩] একজন ইতিহাস-লেখক বলিয়া গিয়াছেন যে, “পঞ্চদশ জন সাহসী রীপুরুষ একখানিমাত্র নৌকা লইয়া অগ্রসর হইলেই দুর্গবাসীদিগের দুর্দ্দশার অবসান হইতে পারিত; কিন্তু হায়! পলায়িত ইংরাজ পুরুষের মুখে পঞ্চদশজন বীরপুরুষও অগ্রসর হইলেন না।”[১৪]

 হলওয়েল দুর্গরক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও সিরাজদ্দৌলার গতিরোধ করিতে পারিলেন না; নবাব-সেনা ক্রমে ক্রমে দুর্গমূলে অগ্রসর হইতে লাগিল। ২০শে জুন সহস্র সহস্র নবাসেনা প্রত্যুষেই দুর্গমূলে সমবেত হইতে আরম্ভ করিল। তখন দুর্গবাসী ইংরাজগণ নিতান্ত ভীত হইয়া আত্মসমর্পণ করিবার জন্য হলওয়েকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। হলওয়েল আর কি করিবেন? তিনি অনন্যোপায় হইয়া ইংরাজের বিপদভঞ্জন উমাচরণের শরণাপন্ন হইলেন। পুর্ব্বকাহিনী স্মরণ করিয়া উমিঁচাদ ইংরাজকে প্রত্যাখ্যান করিলেন না। তাঁহাদের কাতর ক্রন্দনে অভিভূত হইয়া নবাব-সেনানায়ক রাজা মাণিকচাঁদের নিকট পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইলেন। “আর না, যথেষ্ট শিক্ষা হইয়াছে; অতঃপর নবাব যাহা বলিবেন, ইংরাজেরা তাহাই শিরোধার্য করিবেন,”[১৫] ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথায় নবাব রায়দুরের অনুগ্রহভিক্ষার জন্য উমিচাঁদ মাণিকচাঁদের নামে পত্র লিখিয়া হলওয়েলকে প্রদান করিলেন। হলওয়েল দুর্গ প্রাচীর হইতে সেই পত্রখানি বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলিবামাত্র তাহা কে যেন কুড়াইয়া লইয়া গেল; কিন্তু তাহার আর কোনরূপ প্রত্যুত্তর আসিল না। এদিকে নবাব-সেনার প্রবল পরাক্রমে অনেকেই আহত হইতেছেন, গোরাপল্টন গুদাম ভাঙ্গিয়া মদ্যপান করিয়া অধীর হইয়া উঠিয়াছে, হলওয়েল চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া সেনাসংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেছেন; এমন সময়ে অবরুদ্ধ ইংরাজসেনা সহসা পশ্চিমদিকের দুর্গদ্বার উন্মোচন করিয়া দিল! সেই উন্মুক্তদ্বারে জলস্রোতের ন্যায় প্রবল প্রবাহে নবাব-সেনা দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আর যুদ্ধ করিতে হইল না; সকলেই বন্দী হইলেন; ইংরাজদুর্গের সমুন্নত সিংহদ্বারের উপর সিরাজদ্দৌলার বিজয়পতাকা সগৌরবে অঙ্গবিস্তার করিল।

 সেনাপতি মীরজাফর খাঁ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য পাত্রমিত্রদিগকে সঙ্গে লইয়া নবাব সিরাজদ্দৌলা অপরাহ্ণ পাঁচ ঘটিকার সময়ে ইংরাজদুর্গে পদার্পণ করিলেন, এবং দরবারে সমাসীন হইয়াই উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভ কোথায়, তাহার সন্ধান লইবার অনুমতি করিলেন। ইংরাজের ইতিহাসেই লিথিত আছে যে, উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভ যখন সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন, তখন কাহাকেও কোনরূপ তিরস্কার করা দুরে থাকুক, সিরাজদ্দৌলা উভয়কেই যথোচিত সমাদরে আসনপ্রদান করিলেন। যে সকল ইতিহাসে পূর্ব্বকাহিনীর কিছুমাত্র উল্লেখ নাই, সে সকল ইতিহাস পড়িতে পড়িতে মনে হয় যে, যে কৃষ্ণবলভকে লইয়া এত গোলযোগ, তাঁহাকে হাতে পাইয়া এরূপ সমাদর করিবার অর্থ কি? সিরাজদ্দৌলাকে যাহারা নৃশংসম্বভাব উচ্ছৃঙ্খল যুবক বলিয়া পরিচিত করিতে চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা কৃষ্ণবল্লভের প্রতি সিরাজের সদয় ব্যবহারের মর্ম্মোদঘাটন করিবার আয়োজন করেন নাই।[১৬]

 ইংরাজদুর্গের কোষাগার হস্তগত করিয়া, ইংরাজদিগের উদ্ধত ব্যবহারের জন্যই যে তাহাদের এরূপ দুর্গতি হইল, তাহা বুঝাইয়া দিয়া, সিরাজদ্দৌলা বন্দিগণকে আশ্বাসদান করিলেন। ইংরাজেরা বন্দী; সিপাহীগণ তাহাদিগকে বন্দিবেশেই নবাবের নিকট বাঁধিয়া আনিয়াছিল। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা তাহা দেখিবামাত্র হলওয়েলের বন্ধনমোচন করিয়া অভয়দান করিলেন। দরবার ভঙ্গ হইল। রণশ্রান্ত বিজয়ী সেনা দল আশ্রয়স্থানের অনুসন্ধানে চারিদিকে সরিয়া পড়িতে লাগিল। সেনাপতি মাণিকচাঁদের উপর শাসনভার সমর্পণ করিয়া, সিরাজদ্দৌলা বিশ্রামভবনে গমন করিলেন। প্রভাতে যে ইংরাজদুর্গ বীরবিক্রমের লীলাভূমি বলিয়া স্পর্ধা করিতেছিল, সায়াহ্নে সেই দুর্গাভ্যন্তরে ইংরাজ বন্দী আর মুসলমান ভূপতি নিশ্চিন্ত হৃদয়ে বিরামশয্যায় নিদ্রাভিভূত হইলেন।

 ইংরাজ ইতিহাস-লেখকেরা বলেন যে, যাহারা আত্মসমর্পণ করিয়া বন্দী হইয়াছিলেন, সেই সকল হতভাগা ইংরাজ নরনারী, নিদাঘ সন্তপ্ত গভীর রজনীতে ক্ষুদ্রায়তন কারাকক্ষে নিদারুণ মর্ম্মযাতনায় ছট্‌ফট্ করিতে করিতে, অনেকেই প্রাণবিসর্জ্জন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন! মুসলমানদিগের ইতিহাসে ইহার উল্লেখ নাই;—ইংরাজদিগের ইতিহাসে ইহারই নাম লোমহর্ষণ “অন্ধকুপ-হত্যা”।

 অন্ধকূপ-হত্যার সর্ব্বপ্রধান সংবাদদাতা হলওয়েল সাহেব লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“লোকে বাঙ্গালার ইতিহাস পড়িয়া, কেবল এইমাত্র জানিয়া রাখিবে যে, ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ২০শে জুনের নিদাঘ-সন্তপ্ত নিশীথসময়ে ১৪৬ জন বন্দীর মধ্যে ১২৩ জন হতভাগা অন্ধকূপে জীবন বিসর্জ্জন করিতে বাধ্য হইয়াছিল। কেমন করিয়া এই সর্বনাশ সংঘটিত হইল, তাহার যথাযথ বর্ণনা করিতে পারেন, এমন অল্প লোকেই প্রাণ লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন!—যাঁহারা যত্ন করিলে কিছু কিঞ্চিৎ, লিখিয়া যাইতে পারিতেন, তাঁহারা কেহই সে শোচনীয় কাহিনী বর্ণনা করিবার চেষ্টা করেন নাই। লিখিব লিখিব করিয়া আমিও কতবার দৃঢ়-সংকল্প হইয়াছি; কিন্তু কতবার সে উদ্যম শিথিল হইয়া পড়িয়াছে! লিখিতে বসিলেই প্রাণের মধ্যে সেই নিদারুণ মর্ম্ম-যাতনার চিরপ্রদীপ্ত শোচনীয় স্মৃতি এরূপ হৃদয়বেদনা জাগরিত করিয়া দেয় যে, সেই লোমহর্ষণ দৃশ্যপট অঙ্কন করিবার জন্য যথোপযুক্ত ভাষা খুঁজিয়া পাইনা! পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মর্ম্ম-বেদনার দৃষ্টান্ত আর নাই।[১৭] সেই মর্ম্ম-বেদনায় শরীর ও মন যেরূপ অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা আবার কিয়ৎপরিমাণে প্রকৃতিস্থ হইয়াছে। সুতরাং অন্ধকুপহত্যার লোমহর্ষণ অত্যাচারকাহিনী বিস্মৃতি-গর্ভে বিসর্জ্জন না করিয়া, তাহা যথাসাধ্য লিপিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিলাম। স্মৃতিমাত্র অবলম্বন করিয়া লিখিতে বসিয়াছি; কিন্তু এক বর্ণও অতিরঞ্জিত করিয়া তুলিতে পারিব না;—যাহাই লিখি না কেন, তাহাতে প্রকৃত দুর্দশার অংশমাত্রও প্রকটিত হইবে না!

 “অন্ধকূপের কথা লিখিবার পূর্ব্বে পূর্ব্ববর্তী কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা করা আবশ্যক। অপরাহ্ণ ছয় ঘটিকার সময়ে নবাব ও তাঁহার সেনাদল দুর্গপ্রবেশ করেন। আমার সঙ্গে সেদিন নবাবের তিনবার দেখা হয়। সাত ঘটিকার একটু পূর্ব্বে শেষ সাক্ষাৎ;—তিনি তখনও এই বলিয়া আশ্বাস দিলেন যে, তিনিও একজন বীরপুরুষ, এবং বীরপুরুষের ন্যায় বলিতেছেন, ‘আমাদের কিছুমাত্র অনিষ্ট হইবে না।’ আমার এখন পর্যন্তও এইরূপ বিশ্বাস রহিয়াছে যে, আমাদের সম্বন্ধে নিতান্ত সাধারণভাবে হুকুম দেওয়া ব্যতীত, কোথায় রাখিতে হইবে, কেমন করিয়া রাখিতে হইবে, এ সকল কথা সিরাজদ্দৌলা কিছুই বলিয়া দেন নাই। আমরা যেন পলায়ন করিতে না পারি,—বোধ হয় এই পর্য্যন্তই বলিয়া থাকিবেন! যাহারা এই কয় দিনের যুদ্ধকলহে চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিল, তাহাদের সহকারী সিপাহীগণ, প্রতিশোধ লইবার জন্যই আমাদের এরূপ দুর্গতি করিয়াছিল; ইহাই আমার ধারণা।

 “সন্ধ্যা হইল। অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া আসিতে লাগিল। একজন প্রহরী আসিয়া আমাদিগকে একটি বিস্তৃত বারান্দায় খিলানের কাছে বসিতে বলিল। সে স্থান অন্ধকুপ কারাগার এবং প্রহরী-বারিকের পশ্চিম দিকে। সম্মুখে ময়দান। সেখানে মশাল জ্বালাইয়া চারি পাঁচ শত গোলন্দাজ দাঁড়াইয়া ছিল। আমরা চাহিয়া দেখিলাম যে, চারিদিকেই আগুন লাগিয়া উঠিয়াছে। বড় ভয় হইল। সকলেই ভাবিলাম যে, আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিবার জন্যই বুঝি এত লোক মশাল লইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে! ৭॥৹ টার সময়ে কতিপয় সেনানায়ক মশাল লইয়া প্রাচীয়-সংলগ্ন কক্ষগুলি তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তখন আর সন্দেহ রহিল না; আমাদের অনুমানই ঠিক হইল ভাবিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলাম। ভাবিলাম যে, শীঘ্র শীঘ্র অগ্নি-সৎকার শেষ করিবার জন্য নিকটস্থ কক্ষগুলিতেও অগ্নিসংযোগ করিতে আসিতেছে! তখন সকলেই স্থির করিলাম,আর না, এইবার প্রহরী দিগের উপর লাফাইয়া পড়িব, তরবারি কাড়িয়া লইব, সম্মুখে যে সকল গোলন্দাজ দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদিগকে সদর্পে আক্রমণ করিয়া, বীরের ন্যায় জীবনবিসর্জ্জন করিব,—কাপুরুষের মত রহিয়া রহিয়া আগুনে পুড়িয়া মরিব না! বেলি, জেন্‌কস্‌ ও রেভেলী বলিলেন,—‘সহসা এত বড় দুঃসাহসের কার্য্য করিয়া কি হইবে? আগে ব্যাপার কি দেখিয়া আইস।’ আমি একটু উঠিয়া গিয়া দেখিতে লাগিলাম। কিন্তু যাহা দেখিলাম তাহাতে ভ্রম দূর হইয়া গেল! আমাদিগকে কোথায় রাত্রিবাস করিতে হইবে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, মশাল লইয়া স্থানান্বেষণ করিতেছে;—“দেখিলাম যে, পাহারাবারিকের ঘরগুলির অনুসন্ধান চলিতেছে।

 “এইখানে একজন লোকের পরিচয় দিয়া রাখি। ইহার নাম লিচ্;—ইনি কোম্পানীর কলিকাতার কুঠীর কর্ম্মকার ছিলেন। আগে ইঁহাকে কেবল বন্ধু বলিয়াই সমাদর করিতাম, কিন্তু বন্ধু আজি যেরূপ ব্যবহার করিলেন, তাহতে অধিকতর সমাদর করা আবশ্যক। মুসলমানেরা যে সময়ে তুমুল কোলাহল করিয়া প্রবেশ করিতেছিল, লিচ্ সেই অবসরে পলায়ন করিয়াছিলেন। অন্ধকার হইলে ফিরিয়া আসিয়া আমাকে চুপি চুপি বলিতে লাগিলেন যে, তিনি নদীতীরে নৌকা প্রস্তুত করিয়া আমাকে সংবাদ দিতে আসিয়াছেন; আমি পলায়ন করিতে প্রস্তুত কিনা কেবল তাহাই জানিবার জন্য গুপ্তপথে দুর্গপ্রবেশ করিয়াছেন। সে সময়ে আমাদের কাছে অধিক প্রহরী ছিল না; যাহারা ছিল তাহারাও সন্দেহশূন্য হইয়া দূরে দূরে পদচারণ করিতেছিল,ইচ্ছা থাকিলে পলায়ন করিতে কোনরূপ অসুবিধা হইত না। কিন্তু যাহারা আমার আজ্ঞায় দুর্গরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া অবশেষে আমার সঙ্গে শত্রুহস্তে বন্দী হইয়াছেন, তাহাদিগকে অসহায় অবস্থায় নবাবের হাতে সমর্পণ করিয়া, একাকী প্রাণ লইয়া পলায়ন করিতে প্রবৃত্তি হইল না। তখন লিচ্ অবলীলাক্রমে বলিয়া উঠিলেন যে,— কেবল আমার জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়াছিলেন; আমিই যদি পলায়ন না করিলাম, তবে তিনি আর একাকী পলায়ন করিবেন কেন? বলা বাহুল্য যে, কাহারও পলায়ন করা হইল না!

 “যাহারা এতক্ষণ স্থান খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল, তাহারা আসিয়া পাহারা-বারিকের বামপার্শ্বস্থ গৃহমধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য আমাদিগকে আদেশ করিতে লাগিল। সেই বারিকে সিপাহীদিগের নিদ্রার জন্য কতকগুলি তক্তাপোষ ছিল, বায়ুসমাগমেরও অসুবিধা ছিল না;—ভাবিলাম বুঝি সমুদয় দিনের রণশ্রান্তি দূর করিবার সদুপায় হইল; সেইজন্য ইচ্ছাপূর্ব্বক তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিলাম। এই বারিকের ভিতর দিয়াই অন্ধকুপকারাগারের প্রবেশদ্বার! কতকগুলি সিপাহী আসিয়া বন্দুক উঠাইয়া সেই অন্ধকূপে প্রবেশ করিবার জন্য ইঙ্গিত করিতে লাগিল। নিরস্ত্র দেহে সে ইঙ্গিত অবহেলা করিতে সাহস হইল না। যাহারা পশ্চাতে ছিল, তাহারাও বেগে ঠেলিয়া আসিতে লাগিল। সম্মুখের তরঙ্গ যেমন পশ্চাতের তরঙ্গাঘাতে কেবল সম্মু খের দিকেই ছুটিয়া চলে, আমরাও সেইরূপ তাড়াতাড়ি পাড়াপাড়ি করিয়া অন্ধকূপের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিলাম! সে অন্ধকূপ যে এত ক্ষুদ্রায়তন তাহা জানিতাম না; আমি কেন, দুই একজন সৈনিক ভিন্ন কেহই তাহা জানিতেন না। যদি জানিতাম যে সত্য সত্যই তাহা অন্ধকুপ, তবে বরং আদেশ লঙ্ঘন করিয়া প্রহরীহস্তে জীবনবিসর্জ্জন করিতাম; তথাপি সে অন্ধকূপের মধ্যে ইচ্ছাপুর্ব্বক পদার্পণ করিতাম না!

 “আমিই সর্ব্বাগ্রে প্রবেশ করিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বেলি, জেন্‌কস্, কুক্, কোলস্, স্কট, রেভেলি এবং বুকাননও প্রবেশ করিলেন। দ্বারের নিকটেই জানালা; আমি প্রবেশ করিয়া সেই জানালার ধারে আশ্রয় পাইলাম। কোল্‌স্‌ এবং স্কট্ উভয়েই আহত; সুতরাং তাহাদিগকে সেখানে ডাকিয়া লইলাম। আর আর সকলে আমাদের আশে পাশে যে যেখানে পারিল, ঘিরিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। দরজা বন্ধ হইল। আট্‌টা বাজিয়া গেল।

 ‘এইরূপে রণ-পরিশ্রান্ত ১৪৬ জন হতভাগা নিদারুণ নিদাঘসন্তপ্ত অন্ধকার রজনীতে বায়ুসমাগমবিরহিত ১৮ ফুট আয়তনের একটি ক্ষুদ্র কক্ষে বন্দী হইল! একটি মাত্রদ্বার, তাহাও উত্তরদিকে। দুইটিমাত্র জানালা, তাহাও লৌহশলাকাবেষ্টিত। একটু যে শীতল বাতাস পাইব তাহারও উপায় নাই! এই অবস্থা স্মরণ করিলে, আমাদের দুঃখ, দুর্দশা কিয়ৎপরিমাণে অনুভব করা সহজ হইবে।

 “আমাদের যে কত না দুর্গতি হইবে, তাহার ভয়াবহ দৃশ্যপট যেন জীবন্তভাবে চক্ষুর সম্মুখে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল; কারাকক্ষের আয়তন দেখিয়াই চক্ষুস্থির হইয়া গেল। সকলে মিলিয়া রুদ্ধদ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলি বার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল; —কিন্তু সে প্রচণ্ড বিক্রম বিফল হইল; দ্বার খুলিল না!

 “তখন ক্রোধান্ধ-কলেবরে সকলে মিলিয়া উন্মত্তের মত আস্ফালন করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম যে, সে নিষ্ফল ক্রোধে কেবল শরীর মন শীঘ্র শীঘ্র অবসন্ন হইয়া পড়িবে। সুতরাং শান্ত হইবার জন্য বারবার অনুরোধ করিতে লাগিলাম।

 “সকলে শান্ত হইলে, অবসর পাইয়া কিংকর্তব্য চিন্তা করিবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে পার্শ্বস্থ আহত বন্ধুদ্বয় মৃত্যু-যাতনায় বিকট আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন। নানাভাবে মানুষকে দেহত্যাগ করিতে দেখিয়া, এবং সর্ব্বদা মৃত্যুকাহিনী আলোচনা করিয়া মৃত্যুচিন্তা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। নিজের জন্য ভয় হইল না; কিন্তু সহকারীদিগের যন্ত্রণা দেখিয়া স্থির থাকিতে পারিলাম না।

“পাহারাওয়ালাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ জমাদার ছিল। মুখ দেখিয়া মনে হইল, সে যেন আমাদের মর্ম্মযাতনায় কাতরতা অনুভব করিতেছে! তাহা দেখিয়া কথঞ্চিৎ সাহস হইল। তাহাকে জানালার কাছে ডাকিয়া আনিয়া বলিলাম যে, স্থানাভাবে আমাদের বড়ই দুর্গতি হইতেছে। সে যদি অন্ততঃ অর্দ্ধেক লোক আর একটি ঘরে রাখিতে পায়ে, তবে প্রভাত হইবামাত্র সহস্র মুদ্রা পুরস্কার পাইবে। জমাদার চলিয়া গেল; কিন্তু একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল,—“অসম্ভব!” আমি ভাবিলাম যে, পারিতোষিকের অঙ্ক বুঝি কম হইয়াছে, তখন দুই সহস্র মুদ্রার প্রলোভন দেখাইলাম। জমাদার আবার চলিয়া গেল; কিন্তু এবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল যে,—একেবারেই অসম্ভব। নবাব নিদ্রাগত। তাঁহার অনুমতি না লইয়া এমন কার্য্যে কে হস্তক্ষেপ করিবে? আর তাঁহাকে যে জাগাইবে এমন সাহসই বা কাহার?”

 “এতক্ষণ অনেকেই শান্ত হইয়া ছিলেন, কিন্তু সকলেরই বিলক্ষণ যন্ত্রণা আরম্ভ হইয়াছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সর্ব্বশরীর এরূপ ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল যে, না দেখিলে অনুমান করা অসম্ভব। শরীরের রক্ত যেন একেবারে জল হইয়া বাহির হইতে লাগিল! ধারা বহিয়া ঘর্ম্মস্রোত ছুটিয়া চলিল! সকলেই পিপাসায় কাতর হইয়া পড়িলাম।

 “নয়টা না বাজিতেই পিপাসা ও শ্বাসকষ্ট অসহ্য হইয়া উঠিল। একেবারে বায়ুরোধ হইলে বরং ভাল হইত,তৎক্ষণাৎ সকল যাতনার অবসান হইত! তাহা হইল না। যে পরিমাণে বাতাস পাইতে লাগিলাম, তাহাতে না যন্ত্রণার অবসান হইল, না জীবন-ধারণের সুবিধা


 “আর পিপাসা সহ্য করিতে পারিলাম না। শ্বাসকষ্টও বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। দশ মিনিট থাকিতে না থাকিতেই বুকের মধ্যে খিল ধরিয়া আসিতে লাগিল। সে মর্ম্ম-যাতনা আর অধিকক্ষণ সহ্য করিতে পারিলাম না। উঠিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু পিপাসা, শ্বাসকষ্ট এবং বুকের ব্যথা যেন বাড়িয়া উঠিল। তখনও সংজ্ঞা ছিল, কিন্তু হায়! সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যু হইতেছে না কেন,—আর কত কষ্ট সহিব,—আর কতক্ষণে মৃত্যু আসিয়া সকল যন্ত্রণার অবসান করিবে,—এই চিন্তায় ক্রমেই অবসন্ন হইতে লাগিলাম। একটু বাতাস,—একটু বাতাস,—আর কিছু না, কেবল একটু বিশুদ্ধ বাতাস;—মনে হইল বুঝি একটু বাতাস পাইলেই সকল যন্ত্রণার অবসান হইতে পারে। তখন দ্বিগুণবলে লোক ঠেলিয়া জানালার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। লোকে পাড়াপাড়ি করিয়া জানালা ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে; সুতরাং জানালার নিকটে পৌঁছিতে পারিলাম না। জানালার ধারে একসারি লোক, তাহার পরে আর একসারি,—তাহার পরে আরও একসারি! অনেক চেষ্টায় সেই তৃতীয় সারিতে একটুমাত্র স্থান পাইলাম; সেখান হইতেই হাত বাড়াইয়া জানালার গরাদে চাপিয়া ধরিলাম।

 “বেদনা এবং শ্বাসকষ্ট যেন দূর হইয়া গেল, কিন্তু পিপাসা একে বারে অসহ্য হইয়া উঠিল। এতক্ষণ নীরবে সকল কষ্ট বহন করিতেছিলাম;—আর পারিলাম না! একেবারে অধীর হইয়া মর্ম্মবেদনায় আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিলাম,—“ঈশ্বরের দোহাই! আমাকে একটু জল দাও।” সাড়াশব্দ না পাইয়া সকলেই ভাবিয়াছিল যে, আমি বুঝি বহুক্ষণ পঞ্চত্বলাভ করিয়াছি। কিন্তু সাড়া পাইবামাত্র সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরে উত্তেজিত হইয়া সকলেই সেই মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যে “জল দাও, জল দাও” বলিয়া আমাকে জলদান করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল।

 “প্রাণ ভরিয়া জলপান করিলাম। কিন্তু সে অতৃপ্ত পিপাসা কিছুতেই তৃপ্তিলাভ করিল না! তখন জলপানে বিরত হইয়া ঘর্ম্মবিন্দু সংগ্রহ করিয়া ওষ্ঠসিঞ্চনের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। হায়! হায়! সে ঘর্ম্মবিন্দুর বিন্দুমাত্রও মাটিতে পড়িয়া গেলে, কত কষ্টই বোধ হইতে লাগিল!

 ১১॥৹টার মধ্যেই সকলে বিকারগ্রস্ত হইয়া উঠিল। কেহ কেহ এমন উন্মত্ত হইয়া উঠিল যে, আর কিছুতেই শান্ত করা গেল না। যাহারা জানালার আশ্রয় পাইয়াছিল, কেবল তাহারাই কথঞ্চিৎ শান্ত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। বাতাস,—বাতাস,—আর একটু বাতাস,—আরও একটু বাতাস,—চারিদিক হইতে কেবল এই মর্ম্মভেদী আর্তনাদ! গুলি করিয়া মার—আমাকে আগে মার-আমাকেই আগে মার,— চারিদিক হইতে কেবল এই ভয়ঙ্কর কোলাহল! অনেকে প্রহরীদিগকে উত্তেজিত করিবার জন্য, নবাব এবং মাণিকচাঁদের নামোল্লেখ করিয়া অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করিতে করিতে উন্মত্তের মত জানালার উপর আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল! যাহারা অবসন্ন হইয়া পড়িল, তাহারা গৃহমধ্যে সহকারীদিগের শবদেহ আলিঙ্গন করিয়া চিরনিদ্রায় অভিভূত হইতে লাগিল। যাহারা জীবিত রহিল, তাহারা জানালা আক্রমণের জন্য প্রচণ্ডবেগে সহকারীদিগকে পদদলিত করিয়া ছুটিয়া চলিল! কেহ দাঁড়াইয়া, কেহ কাহারও কাঁধের উপর চড়িয়া প্রাণপণে জানালার গরাদে চাপিয়া ধরিতে লাগিল;—তখন আর কাহার সাধ্য যে তাহাদিগকে সরাইয়া দেয়। আমার কাঁধের উপর যেন পাষাণ চাপিয়া পড়িল। গুরুভারে অবনত হইলেও পরিত্রাণ নাই; যে দুর্গন্ধ! যেন নাসারন্ধ্র জ্বলিয়া উঠিতে লাগিল।

 “এমন নিদারুণ পরীক্ষায় পড়িয়া ধর্ম্মবুদ্ধি স্থির রাখিতে পারিলাম না। সহসা মনে হইল যে, আমার কাছে একখানি ছুরিকা রহিয়াছে কেন? সেই ছুরিকা বাহির করিয়া শিরা উপশিরা খণ্ড খণ্ড করিবার আয়োজন করিলাম! অকস্মাৎ যেন ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা প্রত্যাবর্ত্তন করিল। কাপুরুষের ন্যায় আত্ম-হত্যা করা বড়ই নীচকার্য্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। তখন প্রায় ২টা বাজে বাজে। এরূপ ভাবে আর অধিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলাম না। আমার কাছে কেয়ারী নামে একজন নৌ-সেনানায়ক দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি সমস্ত দিন অতুল বিক্রমে দুর্গরক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহাকে আমার স্থান অধিকার করিবার জন্য আহ্বান করিয়া আমি গৃহমধ্যে মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিতে কৃতসংকল্প হইলাম। কেয়ারী ধন্যবাদ দিলেন; কিন্তু তিনি আর আমার স্থান অধিকার করিতে পারিলেন না—আমার কাঁধের উপর একজন ওলন্দাজ বসিয়াছিল, স্থানটুকু সেই অধিকার করিয়া ফেলিল। কেয়ারী তাঁহার বিশালবাহু বিস্তার করিয়া, ভিড় ঠেলিয়া আমাকে গৃহ মধ্যে টানিয়া আনিলেন; কিন্তু তাঁহার সকল শক্তি সহসা ভাঙ্গিয়া পড়িল; দেখিতে না দেখিতে কেয়ারী সহসা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন!

 “গৃহমধ্যে আসিলেও কিছুক্ষণ কথঞ্চিৎ সংজ্ঞা ছিল। তখন কিন্তু যাতনা-বোধ ছিল না। তাহার পরে সকল সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়া গেল! প্রভাতে কুক্ সাহেবের প্রস্তাবে লসিংটন এবং ওয়াল্‌কট্‌ মৃতদেহের ভিতর হইতে আমাকে টানিয়া বাহির করিয়াছিলেন, কিন্তু আমি তখন একেবারে সংজ্ঞাহীন। তাহার পর প্রভাতের শীতল বাতাস লাগিয়া চেতনাশক্তি ধীরে ধীরে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিল।”[১৮]

 ২১শে জুন প্রাতঃকালে নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন হলওয়েলকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, প্রহরিগণ তখন দুর্দ্দশার কথা জ্ঞাপন করিল। হলওয়েল নিজেই লিখিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহাদের দুর্দ্দশার কথা শুনিবামাত্র সিরাজদ্দৌলা তাঁহাকে কারামুক্ত করিয়া জীবনরক্ষা করিয়াছিলেন। হলওয়েল যখন নবাবদরবারে উপনীত হইলেন, তখন তিনি একরূপ শক্তিহীন,—শুষ্ককণ্ঠে জিহ্বার জড়তা বৃদ্ধি হইয়া বাক্‌শক্তি রহিত হইয়া গিয়াছে। হলওয়েল লিখিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার দুর্দ্দশা দেখিয়া সিরাজদ্দৌলা তাঁহাকে বসিবার জন্য আসন দান করিয়া জলপান করিতে দিয়াছিলেন। ইংরাজদিগের রাজকোষ কোথায় লুক্কায়িত আছে হলওয়েল তাহা কিছুই বলিতে পারিলেন না। রাজা মাণিকচাঁদ তাঁহাকে এবং তাঁহার তিনজন সঙ্গীকে উঠাইয়া লইয়া বন্দীবেশে মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করিলেন; আর আর সকলেই মুক্তিলাভ করিল।

 হলওয়েল এবং তাঁহার সঙ্গিগণ কারারুদ্ধ হইলেন কেন, সে কথা হলওয়েল নিজেই প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলেন যে, উমিচাঁদের উত্তেজনায়, রাজা মাণিকচাঁদের আদেশেই তাঁহারা বন্দীভাবে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হইয়াছিলেন; সিরাজদ্দৌলা তাহার জন্য কিছুমাত্র অপরাধী নহেন। হলওয়েলের বিশ্বাস এইরূপ যে, উমিচাঁদ কারারুদ্ধ হইয়া যে সকল মর্ম্মপীড়া ভোগ করিয়াছিলেন, তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। উমিচাঁদ যে নিতান্ত অন্যায় উৎপীড়নে উৎপীড়িত হইয়াছিলেন, সে কথা হলওয়েলও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং হলওয়েলের অনুমান সত্য হইলেও, তাহার সহিত সিরাজদ্দৌলার কিছুমাত্র সংস্রব ছিল না। উমিচাঁদ সে সময়ে শোকে তাপে জর্জ্জরিত। যাঁহারা সন্দেহমূলে তাঁহাকে ধনেবংশে বিনষ্ট করিয়াছিলেন, উমিচাঁদ যে তাঁহাদের জন্য যৎকিঞ্চিৎ উৎপীড়নের ব্যবস্থা করিবেন, তাহা একেবারে অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু স্বাভাবিক হইলেও প্রমাণাভাব;—একমাত্র হলওয়েলের অনুমানই যাহা কিছু প্রমাণ![১৯]

  1. Stewart's History of Bengal.
  2. Early Records of British India.
  3. First Report of the Committee of the House of Commnons, 1772.
  4. নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসের মতে ১৬ই জুন হইতে যুদ্ধারম্ভ হয়।
  5. Orme, vol, ii, 62.
  6. In such circumstances, the expediency of abandoning the fort and retreating on ship-board naturally occurred to the beseiged and such a retreat might have been made without dishonor. But the want of concert, together with the criminal eagerness manifested by some of the principal servants of the Company to provide for their own safety at any sacrifice, made the closing scene of the seige one of the most disgraceful in which Englishmen have ever been engaged. Thornton's History of the British Empire. vol. I. 190.
  7. From the time that we were confined to the defence of the fort itself, nothing was to be seen but disorder, riots and confusion. Every body was officious in advising, but no one was properly qualified to give advice— The evidence of John Cooke Esqr...
  8. Orme, vol. ii, 69.
  9. Orme, vol, ii, 69.
  10. That money and effects were that night embarked, is a truth known to everybody-Holwell's India Tracts, P 321.
  11. The astonishment of those who remained in the fort was not greater than their indignation,—Orme, vol. ii 71. বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, এইরূপে দুর্গমধ্যে ১৯০ জন সৈন্য ও ভলাণ্টিয়ার অবরুদ্ধ হয়। প্রমাণ স্থলে কুকের নামোল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু পলায়নের পুর্ব্বে দুর্গমধ্যে ১৭০ জন মাত্র লোক থাকা সেক্রেটারী কুকের কথায় পাওয়া যায় বলিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় নিজেই উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। হলওয়েলের মতে ৮ই জুনের জনসংখ্যা ১৯০।
  12. Among those who left the factory in this unaccountable manner, were, the Governor Mr. Drake, Mr. Macket, Captain Commandant Minchin, and Captain Grant.-The evidence of John Cooke Esqr.
  13. Signal were thrown out from every part of the Fort for the ships to come up again to their stations, in hopes they would have reflected (after the first impulse of their panic was over) how cruel: as well as shameful it was to leave their countrymen to the mercy of a babarous enemy; and for that reason we made no doubt they would have attempted to cover the retreat of those left behind, now they had secured their own but we deceived ourselves.—The evidence of John Cooke Esqr.
  14. A single sloop with ‘fifteen brave men on board, might in spite of all the eforts of the enemy, have come up, and, anchoring under the fort, have carried away all who suffered in the dungeonia Orme, vol. ii..78.
  15. Holwell's India Tracts, p. 930,
  16. রাজবল্লভের সহিত সন্ধিস্থাপন করিবার সময়ে সিরাজদ্দৌলা কৃষ্ণবল্লভের সকল অপরাধ ক্ষমা করিয়াছিলেন। তাহার পর ইংরাজেরা কৃষ্ণবল্লভকে বিনাদোষে কারারুদ্ধ করায় সিরাজদ্দৌলার সহানুভূতি কৃষ্ণবল্লভের কল্যাণকামরায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল;—ইহাই একমাত্র ঐতিহাসিক কারণ বলিয়া রোধ হয়।
  17. আছে। তাহার নায়ক ইংরাজ, সংযোগল স্কটলণ্ড; Massacre of Glenco নামে তাহা ইংলণ্ডের গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস-পৃষ্ঠা কলঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে।
  18. “Letter from J. Z. Holwell, Esq., to William Davis Esq., from on board the Syren sloop, the 28th of February 1757."—Printed in Holwell's Tracts.
  19. But that the hard treatment I met with, may truly be attributed in a great measure to Omichand's suggestion and insinuations I am well assured, from the whole of his subsequent conduct; and this further confirmed me in the three gentlemen selected to be my companions, against each of whom he had conceived particular resentment; and you know Omichand can never forgive.—Holwell's Letter.